দৃষ্টিহীন মানুষের অর্ধেক পৃথিবী সীমিত হয়ে পড়ে। কেননা পৃথিবীর আলো-বাতাস থেকে সে বঞ্চিত থাকে। কিন্তু বিশ্বে এমন অনেক মানুষ জন্মগ্রহণ করেছেন, যারা মহামূল্যবান এই অঙ্গের সাহায্য ছাড়াই আত্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। রাজনৈতিক অঙ্গনেও দৃষ্টিহীন মানুষের সাফল্যগাথা অমর হয়ে রয়েছে। যাদের খবর আমরা রাখি না বললেই চলে? আর সেইসব মানুষের কাছ থেকে আমরা পেতে পারি লক্ষ্য অর্জনের অনুপ্রেরণা।
অন্ধ হয়েও রাজনীতিতে অনবদ্য অবদান রেখেছেন এমন কয়েকজন রাজনীতিকের তথ্য নিচে দেওয়া হলো:
আবদুর রাহমান ওয়াহিদ (গুস দুর)
অন্ধ নেতাদের নাম নিতে গেলে সবার আগে যার নাম মুখে আসে তিনি হলেন গুস দুর। এটি তার ডাক নাম। তাঁর প্রকৃত ও পুরো নাম আবদুর রহমান আদ দাখিল ওয়াহিদ। ১৯৯৮ সালে জেনারেল সুহার্তোর মৃত্যুর পর তিনিই ইন্দোনেশিয়ার প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। ধর্মীয় নেতা হিসেবে জনপ্রিয় গুস দুর দীর্ঘ সময় ধরে ‘নাহদালাতুল উলামা’ নামের ইসলামি সংগঠনের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। national awakening party প্রতিষ্ঠা করা সফল এই রাষ্ট্রনায়ক এক চোখে অন্ধত্ব নিয়েই পৃথিবীতে আসেন। এক চোখ অন্ধ হওয়ার পরও নেতৃত্বের কারণে তিনি শুধু ইন্দোনেশীয়দের জয় করেননি, বিশ্বে অনুপ্রেরণার অনির্বান উৎস হয়ে আছেন তিনি। ২০০৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাকার্তায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন গুস দুর।
ডেভিড ব্লাঙ্কেট
ব্রিটিশ লেবার পার্টি থেকে নির্বাচিত এমপি ছিলেন ডেভিড ব্লাঙ্কেট। তিনি ২০০১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন টনি ব্লেয়ার। এ ছাড়া জন্মান্ধ এই রাজনীতিবিদ বিভিন্ন মেয়াদে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত শেফিল্ড সিটি কাউন্সিলের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
ভ্যাক বেলা
১১০৯ সালে হাঙ্গেরির এক রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ভ্যাক বেলা। হাঙ্গেরিয়ান ভাষায় তিনি এই নামে পরিচিত। রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করেও তিনি বাবার দ্বারা নির্যাতিত হতেন। কারণ তাকে মনে করা হত তিনি মায়ের নিষিদ্ধ সন্তান। তার বাবা আল্মস এতই বদমেজাজি ছিলেন যে, তার কারণেই একদিন তাকে অন্ধত্ব বরণ করতে হয়। কিন্তু ওই সময়ে তার চাচা হাঙ্গেরির বিখ্যাত রাজা দ্বিতীয় স্টিফেন বেলাকে নিজের কাছে রেখে লালন পালন করেন। এর পেছনে অবশ্য একটি কারণও ছিল। রাজা ছিলেন নিঃসন্তান। এদিকে বেলার ২০ বয়স বছর পূর্ণ হলে তাকে হেলেনা নামেে এক বুদ্ধিমতী মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেন তার চাচা। দ্বিতীয় স্টিফেনের মৃত্যুর পর স্ত্রীর সহায়তায় বেলা ১১৩১ থেকে ১১৪১ সাল পর্যন্ত হাঙ্গেরি ও ক্রোয়েশিয়ার রাজা হিসেবে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। অন্ধ হয়েও রাজা হয়ে নজির রেখে গেছেন ভ্যাক বেলা। যিনি ক্রোয়েশিয়ানদের কাছে বেলা সিলেজিপি নামে পরিচিত ছিলেন। আর স্লোভাকরা তাকে ডাকতো বেলো স্লিপি নামে। যার অর্থ ‘ঘুমন্ত বেলা’।
কলিন ল
কলিন লয়ের পুরো নাম কলিন ম্যাকেনজি ল। তিনি একজন বিখ্যাত ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ। এডিনবার্গে তার জন্ম। তিন বছর বয়স থেকেই ছিলেন অন্ধ। তবু তিনি অন্ধত্বকে জয় করে অক্সফোর্ড এবং ক্যামব্রিজের মতো বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব অর্জন করে নিজের মেধাকে প্রমাণ করেন। কলিন ল লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের লেকচারার হিসেবে ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত দায়িত্বরত ছিলেন। নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করায় তিনি ব্রিটিশ হাউজ অব লর্ডসের সদস্য নির্বাচিত হন।
ডেভিড পিটারসন
ডেভিড পিটারসনের পুরো নাম ডেভিড আলেকজান্ডার পিটারসন। জন্ম থেকেই বাঁ চোখের সমস্যায় ভুগেছেন পিটারসন। তবে এই সমস্যা দমাতে পারেনি তাকে। নিউ ইয়র্কের ৫৫তম গভর্নর নির্বাচিত হয়ে সে প্রমাণই দিয়েছেন তিনি। ২০০৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত এই পদে দায়িত্ব পালন করেন পিটারসন। তিনিই সর্বপ্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান।
১৯৮৫ সালে ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে নিউ ইয়র্কের সিনেটর হিসেবে তিনি তার বাবার স্থলাভিষিক্ত হয়ে ২০০৬ সাল পর্যন্ত অধিষ্ঠিত ছিলেন । এ ছাড়া ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত নিউ ইয়র্ক সিনেটের মনিটারি লিডার হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।
ফ্লয়েড মরিস
ফ্লয়েড এমারসন মরিস হলেন সিনেট অব জ্যামাইকার বর্তমান এবং ১১তম প্রেসিডেন্ট। স্কুলে পড়াকালীন তিনি তার চোখের রোগে ভুগেন এবং এর ছয় বছর পর তিনি দৃষ্টিশক্তি হারান। ১৯৯৮ সালে তিনি জ্যামাইকার সর্বপ্রথম অন্ধ সিনেটর হিসেবে শপথ নিয়ে দেশের সেবায় নিয়োজিত হন। কিন্তু তার দল ন্যাশনাল পিপলস পার্টি ২০০৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে পরাজিত হলে তিনি সিনেটের সদস্যপদ হারান। তবে ২০১১ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর ২০১২ সালে তিনি আবার সদস্যপদ ফিরে পান। ২০১৩ সাল থেকে তিনি সিনেটের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পান।
আইয়ান ফ্রাসার
আইয়ান ফ্রাসার ছিলেন ব্রিটিশ কনজারভেটিভ পার্টির একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ এবং বিবিসির একজন গভর্নর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ফ্রাসার তার দৃষ্টিশক্তি হারান। তিনি ১৯২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন কিন্তু কিছুদিন এই দায়িত্ব পালন করার পর ১৯২৯ সালে তিনি তার সদস্যপদ হারান। তবে ১৯৩১ সালে পুনরায় তিনি পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন। ফ্রাসারের আত্মজীবনীমূলক দুটি বই আছে। বই দুটির নাম যথাক্রমে Whereas I was Blind : Autobiography Hodder (1942) ও My Story of St Dunstan`s Harrap (1961)।
লুইস দ্য ব্লাইন্ড
ইতালির রাজা তৃতীয় লুইস অন্ধ হওয়ার কারণে তাকে ডাকা হতো লুইস দ্য ব্লাইন্ড নামে। তার বাবা বোসো ছিলেন প্রোভেন্সের রাজা। ফ্রান্স ও ইতালির একটি বিশাল অঞ্চলকে বলা হতো প্রোভেন্স। বাবার মৃত্যুর পর ৮৮৭ সালে প্রোভেন্সের রাজা হিসেবে সিংহাসনে বসেন তিনি। ৯০০ সালে ইতালির পুরো রাজত্ব দখল করে ৯০৫ সালে পর্যন্ত সমগ্র ইতালি পরিচালনা করেন। তিনি ৯২৮ সালে প্রোভেন্সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। লুইস দ্যা ব্লাইন্ডের কোনো ভাস্কর্য বা ছবি সংরক্ষিত নেই।
ম্যাথিউ এ ডান
ম্যাথিউ অ্যানথনি ডান (সংক্ষেপে ম্যাথিউ এ ডান) ডেমোক্রেটিক পার্টির পেনসিলভানিয়া থেকে নির্বাচিত যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভের একজন সদস্য। এক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ১২ বছর বয়সে তিনি তার বাঁ চোখ হারান এবং অসুস্থতা তার ডান চোখটাও কেড়ে নেয়। তখন তিনি ২০ বছর বয়সী যুবক। দারিদ্র্যের কষাঘাতে তিনি পেশা হিসেবে পত্রিকার হকার হিসেবে নামতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিছুটা স্বচ্ছলতা এলে শুরু করেন ইনস্যুরেন্সের বিজনেস। এরপর তাকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। ওই সময় থেকে যুক্ত ছিলেন ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে। যার ফলে ১৯২৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৩২ সাল পর্যন্ত এই পদে দায়িত্বরত ছিলেন। ডান ১৯৪২ সালে ৫৫ বছর বয়সে পেনসিলভানিয়া পিটার্সবার্গে মৃত্যুবরণ করেন।
থমাস গোর
থমাস গোর ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক পার্টির একজন রাজনীতিবিদ। তিনি দুই মেয়াদে ওকলাহোমা থেকে সিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। গোর ছেলেবেলায় দুটি আলাদা দুর্ঘটনার শিকার হয়ে তার দৃষ্টিশক্তি হারান। কিন্তু তিনি স্বপ্ন দেখতে ভোলেননি। ফলে তিনি ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতাদের কাছে ‘প্রোগ্রেসিভ উইং’ নামে খ্যাত ছিলেন। যথাক্রমে ১৯০৭ থেকে ১৯২১ এবং ১৯৩১ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৪৯ সালে ৭৮ বছর বয়সে ওয়াশিংটনে মারা যান তিনি।
ভ্যাসিলিইয়েভিচ তিওমনয়
ভ্যাসিলি দ্বিতীয় নামে যার শাসনামল রাশিয়ার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে তার প্রকৃত নাম ভ্যাসিলিইয়েভিচ তিওমনয়। তিনি তার বাবা ভ্যাসিলি প্রথমের কনিষ্ঠ সন্তান ছিলেন। অন্ধ হয়েও রাজা হওয়ায় সেই সময়ে বিশ্ব রাজনীতিতে বেশ নজর কেড়েছিলেন ভ্যাসিলি দ্বিতীয়। তিনি ১৪২৫ সাল থেকে মৃত্যু অবধি অর্থাৎ ১৪৬২ সাল পর্যন্ত গ্র্যান্ড প্রিন্স অব মস্কো হিসেবে রাশিয়া শাসন করেন।
এ ছাড়া মেরিল্যান্ডের ক্যাবিনেট সেক্রেটারি ক্রিস্টেন, ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের সদস্য হেনরি ফাউকেট, আমেরিকান আইনজীবী শেলি ডেভিস, ফরাসি লেখক এবং রাজনীতিবিদ জেকুয়িচ লেসারিয়ানের মতো নেতারা দৃষ্টিহীন হয়েও রাজনীতিতে বিশেষ অবদান রাখায় স্মরণীয় হয়ে আছেন।
বিডি-প্রতিদিন/ ২৭ জুন, ২০১৫/ রোকেয়া।