৯ মে, ২০২২ ১৭:০৪

পঞ্চগড়ের যে গ্রামে হারিয়ে গেছে জনবসতি

সরকার হায়দার, পঞ্চগড়

পঞ্চগড়ের যে গ্রামে হারিয়ে গেছে জনবসতি

বিশাল একটা এলাকা জুড়ে শুধু বাঁশঝাড়। আছে বিভিন্ন প্রজাতির ফলদ ও বনজ বৃক্ষ। গাছ গাছে ঝুলে আছে আম, কাঠাল, নারিকেল। কয়েকটি শুকনো পুকুর। আশে পাশে বিস্তির্ণ ফসলের ক্ষেত। ক্ষেতের মাঝদিয়ে চলে গেছে একটি কাঁচা সড়ক। কৃষি কাজে নিয়োজিত গুটি কয়েক মানুষ রাস্তাটি ব্যবহার করছে। পাশেই ভারতের বিস্তৃর্ণ এলাকা জুড়ে বেশ বড় কয়েকটি চা বাগান। কাঁটাতারের ওপারে ভারতের চান্দাপাড়া গ্রাম। সবুজ প্রকৃতির সুনসান নিরবতায় মোহবিষ্ট করে তোলে সীমান্তের এপার-ওপারে উড়ে চলা হরেক রকম পাখির কলকাকলি। যেন দু'দেশের একসাথে চলার একটি ছবির মতো দৃশ্য। 

জনবসতিহীন চমৎকার এ দৃশ্যটি পঞ্চগড় সদর উপজেলার গরিনাবাড়ি ইউনিয়নের ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষে হারিয়ে যাওয়া গ্রাম চান্দাপাড়ার। দুই দশক আগে বিলুপ্ত হয়ে যায় এই গ্রাম। ঠিক কবে এই চান্দাপাড়া গ্রাম গড়ে ওঠে তার ইতিহাস কেউ বলতে পারে না। তবে দেশ ভাগের আগে ভারত বাংলাদেশের বিরাট এলাকা জুড়ে চান্দাপাড়া গ্রামের বিস্তৃতির কথা শোনা যায়। দেশ ভাগের সময় এই গ্রাম দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। এক অংশ ভারতে এবং অপর অংশটি বাংলাদেশের মধ্যে পড়ে। দেশ বদলালেও গ্রামের নাম বদলায়নি। কিন্তু ভারতীয় চান্দাপাড়া টিকে থাকলেও বাংলাদেশের চান্দাপাড়া গ্রামে এখন জনবসতি নেই। শুধু টিকে আছে প্রায় শত বছরের পুরোনো চান্দাপাড়া জামে মসজিদ। তবে এখন কেউই এই মসজিদে নামাজ আদায় করেন না। মসজিদের ভেতরে বাস করছে বাদুড় আর চামচিকে। স্থানীয়রা বলছেন চান্দাপাড়া একটি ঐতিহাসিক গ্রাম। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে ভারত বাংলাদেশের হাট বসতো। হাটটির নাম ছিলো জয়বাংলা হাট। দুই দেশের নাগরিকরা এই হাটে কেনা-বেঁচা করতো। এই গ্রামের তারা পকুরীর মাঠে সপ্তাহে দুই দিন বসতো জয়বাংলা হাট।    

গত দুই দশক আগেও গ্রামটিতে বংশপরম্পরায় কৃষক, ব্যবসায়ী, শ্রমজীবীসহ বিভিন্ন পেশার প্রায় শতাধিক পরিবার বাস করতো। বিভিন্ন উৎসবে হতো নানান আয়োজন। গ্রামের সবাই ইসলাম ধর্মাবলম্বী হওয়ায় গ্রামের ঠিক মাঝ বরাবর নির্মাণ করা হয় একটি জামে মসজিদ। স্থানীয়দের মতে আশপাশের কয়েক গ্রামের মধ্যে এটিই প্রথম আধাপাকা মসজিদ। মসজিদটি প্রাত্যহিক নামাজের পাশাপাশি ধর্মীয় পাঠশালা হিসেবেও সমধিক প্রসিদ্ধ ছিল। 

ওই গ্রামে এক সময় বাস করত বয়ঃবৃদ্ধ আফাজউদ্দীন (৯২)। তিনি বলেন, সীমান্তের খুব কাছে চান্দাপাড়া গ্রামটি ছিলো অনেক সুন্দর। মুক্তিযুদ্ধের সময় দুই দেশের হাট বসতো এখানে। নাম ছিলো জয়বাংলা হাট। কিন্তু চুরি ডাকাতি বেড়ে গেলো। খুন খারাবি হতো। নিরাপত্তা ছিলো না। পাশেই ভারতীয় চা বাগান। বিশেষ করে ভারতীয় চোর ডাকাতের উৎপাত ছিলো বেশি। এখনো ওই এলাকা থেকে দিনের বেলা গরু, ছাগল নিয়ে যায় ভারতীয়রা। তাই গ্রামের লোকজন আস্তে আস্তে আশে পাশের গ্রামগুলোতে জমি কিনে বাড়ি করা শুরু করলো। এখন আর এই গ্রামে কেউ নেই। কাগজে কলমে গ্রামের নাম আছে, তবে বসতি নেই।
 
গরিনাবাড়ি ইউনিয়নের চেয়রম্যান মনোয়ার হোসেন দিপু বলেন, গ্রামটিতে ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনগোষ্ঠি শতবছর ধরে বাস করতো। গ্রামে থাকা মসজিদে ছোট ছেলেমেয়ের ধর্মীয় শিক্ষাদানও করা হতো। শতবছরের পুরোনো মসজিদটি গ্রামের স্মৃতি ধরে রেখেছে। এখানে জয়বাংলা হাট বসতো। তাই এই গ্রাম একটি ঐতিহাসিক গ্রাম । বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ও ভারতীয় সরকার সীমান্ত হাটের উদ্যোগ নিয়েছে। এই কর্মসূচীতে জয়বাংলা হাটটিকে আবারও চালু করা হলে ঐতিহ্য ফিরে আসার পাশাপাশি দুদেশের মানুষ উপকৃত হবে। 

বিডি প্রতিদিন/হিমেল

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর