সোমবার, ৩ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

‘আমি সিরাজুল আলম খান’

সেদিনের সশস্ত্র যোদ্ধারা আজ রাজনীতির মূলধারা থেকে ছিটকে পড়েছে, ৬ দফাকে সিআইয়ের দলিল শেখ মুজিবকে এজেন্ট বলা মেনন মতিয়া নিজামীরা মন্ত্রী হয়েছে

পীর হাবিবুর রহমান

‘আমি সিরাজুল আলম খান’

সিরাজুল আলম খান

রাজনীতিতে তাকে বলা হয় ‘রহস্য পুরুষ’। ’৬২ সালের ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে তিনি মরহুম আবদুর রাজ্জাক ও ঘাতকের হাতে নিহত কাজী আরেফ আহমেদ মিলে গড়ে তুলেছিলেন গোপন সংগঠন ‘নিউক্লিয়াস’ বা ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’। তাকে ঘিরে রাজনীতিতে আলোচনা বিতর্ক এক কথায় মিথেই পরিণত করেনি, জীবন্ত কিংবদন্তিতে পরিণত করেছে। তিনি হলেন ষাটের দশকে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক  ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অনন্য সাধারণ সংগঠক ও নেপথ্যের কুশীলব বা শক্তির উৎস মুজিব বাহিনীর অন্যতম প্রধান সিরাজুল আলম খান। এ দেশের রাজনৈতিক মহলেই নয়, পর্যবেক্ষকই নয়, অনুসন্ধিৎসু মানুষের কাছে তাকে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য প্রশ্ন, তীব্র কৌতূহল ও জানার অন্তহীন তৃষ্ণা। ’৮১ সালে সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভের পর রাজনীতির বাইরে থেকেও তিনি বরাবর রাজনীতিতে আলোচিত হয়েছেন।

ব্যাপক পড়াশোনা, পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটর অধ্যাপনা ও গবেষণাধর্মী লেখালেখিতে সময় কাটালেও ঘটনাবহুল রাজনীতি বা তার রাজনৈতিক জীবন নিয়ে কখনো কোথাও কোনো সাক্ষাৎকার যেমন দেননি, তেমনি কোনো বইও লিখেননি। তবে রাষ্ট্র সমাজ নিয়ে চিন্তাভাবনার গভীর থেকে বিভিন্ন সময় নানা রূপরেখা দিয়েছেন বুকলেট আকারে। শুক্রবার রাতে ষাটের দশকের প্রভাবশালী আরেক ছাত্রলীগ নেতা, সাবেক মন্ত্রী ও এক সময়ের দাপুটে জনপ্রিয় দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর বাসভবনে দীর্ঘদিন পর তার সঙ্গে দেখা হয়। এই মহান স্বাধীনতা সংগ্রামীর জবানবন্দিতে, তার এক সময়ের রাজনৈতিক শিষ্য মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক শামসুদ্দিন আহমেদ পেয়ারা ‘আমি সিরাজুল আলম খান’ বইটি লিখেছেন। মাওলা ব্রাদার্স বইটি প্রকাশ করেছে। সিরাজুল আলম খান সেই বইটিসহ তার আরেকটি বই আমাকে উপহার দেন। ‘আমি সিরাজুল আলম খান’ বইটি প্রকাশের পর তা পড়ার তীব্র আগ্রহ থাকলেও জোগাড় করা হয়নি। তিনি না দিলেও বইটি আমি যেভাবেই হোক সংগ্রহ করে পড়তাম।

’৯৮ সালে লন্ডনের বাঙালিপাড়া বা ব্রিকলেনে একবার তিনি কেন মুখ খুলছেন না এ নিয়ে অনেক প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি তখন বিরক্তও হয়েছিলেন। উত্তর দেননি। এ দেশের রাজনীতিবিদরা আত্মজীবনী বা রাজনীতির অন্দরে বাহিরে যা ঘটেছে তা নিয়ে কেন বই লিখেন না, এ নিয়ে আমার অভিযোগ আছে। রাজনীতিবিদদের আত্মজীবনী ও রাজনৈতিক ইতিহাসের বইয়ের আমি একজন নিবেদিতপ্রাণ পাঠক। একেকটি বই আমি কখনো-সখনো একাধিকবার পাঠ করি এবং আমার সামান্য মেধা দিয়ে তার গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করি। অনেক রাজনীতিবিদ ও সাহিত্যিকের আত্মজীবনী আমি পাঠ করেছি। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী আমি অনেকবার পাঠ করি। দর্শকনন্দিত অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন ও নোবেলজয়ী সাহিত্যিক পাবলো নেরুদার আত্মজীবনীর পাশে খুশবন্ত সিং আমাকে মুগ্ধ করেছে। এক সময়ে সংবিধান যেমন হাতের নাগালে থাকত তেমনি এখন বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী থাকে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী মাওলানা আবুল কালাম আজাদের আত্মজীবনীও একাধিকবার পাঠ করেছি। বারট্রান্ড রাসেল আমার জীবনের একজন অন্যতম প্রিয় লেখক, যাকে ব্রিটিশ ইউরোপের বাস্তববাদী দার্শনিক বলা হতো। তিনি একজন অহিংসবাদী ও যুদ্ধ এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী যুক্তিবিদ যিনি নোবেল জয় করেছিলেন। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু নিজেও দুইশ পৃষ্ঠার একটি আত্মজীবনী লিখে সম্পন্ন করেছেন। যার শুরুটাই হয়েছে ’৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এলে তার সঙ্গে সে রাতেই একান্ত কথা বলার ঘটনা নিয়ে। জানি না সে বই আনোয়ার হোসেন মঞ্জু জীবিতকালে প্রকাশ করবেন কি-না। শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাকসহ অনেক কালের সাক্ষী ও স্বাধীনতা সংগ্রামী চলে গেছেন। কিছু লিখে যাননি। আমির হোসেন আমু, খালেদ মোহাম্মদ আলী, তোফায়েল আহমেদ, নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রবসহ যারা জীবিত তাদের উচিত নির্মোহ সত্য লিখে যাওয়া।

সিরাজুল আলম খান এই বইয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে তার যুক্ত হওয়া, স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে উঠে আসাসহ দীর্ঘ কর্মকা , শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সাক্ষাৎ ছাড়াও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, সামরিক একনায়ক আইয়ুব খানের দুঃশাসন, বঙ্গবন্ধুসহ তাদের কারাবরণ, আন্দোলন সংগ্রাম এবং বামপন্থি রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের ছয় দফা থেকে অগ্নিঝরা ’৭১ এর মার্চ পর্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা, স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর কাছে তার ১৫ দফা প্রস্তাব, ছাত্রলীগের ভাঙনের মধ্য দিয়ে জাসদ সৃষ্টি, পরিবার-পরিজনসহ বঙ্গবন্ধু হত্যাকা , জিয়াউর রহমানকে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ও জাসদের নেতৃত্বে খালেদ মোশাররফের বন্দীদশা থেকে কর্নেল তাহেরের  নেতৃত্বে মুক্ত করে বিপ্লবী সরকার গঠনের ব্যর্থতাসহ সেই সময়কার ঘটনাবলিও উঠে এসেছে। উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, ‘জয় বাংলা’ পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সংগীত এবং ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর শেষ নির্দেশ ও স্বাধীনতার ঘোষণাও।

সিরাজুল আলম খান বলেছেন, ১৯৬২ সালে তার বয়স একুশ, আবদুর রাজ্জাকের কুড়ি ও কাজী আরেফ আহমেদের উনিশ বছর। ‘ঘটনাক্রমে একদিন আমি, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ একসঙ্গে কথাবার্তা বলার সময় স্বাধীনতার প্রসঙ্গটি আলোচনায় আসে। এভাবে অভিজ্ঞতা ছাড়া শুধু তারুণ্যের স্বপ্ন বা আকাক্সক্ষাকে সম্বল করে শুরু হয় স্বাধীনতার জন্য আমাদের পথ চলা। আমরা দশ বছরের মধ্যে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করব, এ সংকল্প নিয়ে কাজ শুরু করি। কিন্তু নয় বছরের মাথায়ই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। আমাদের এই নয় বছরের পথপরিক্রমাকে আজকের হিসেবে মনে হবে কয়েক যুগ।’ নিউক্লিয়াসের রাজনৈতিক উইং হিসেবে তারা বিএলএফ (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স) গঠন করেন। সেখানে পরবর্তীতে শেখ ফজলুল হক মণি ও তোফায়েল আহমেদ যুক্ত হন। কাজী আরেফ আহমেদ ছিলেন বিএলএফের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান। ’৭১ এর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলে বিএলএফ এবং তার সামরিক উইং ‘জয় বাংলা বাহিনী’। বিএলএফের সদস্য সংখ্যা তখন সাত হাজারের মতো। “নিউক্লিয়াস” “বিএলএফ” ও “জয় বাংলা বাহিনী” গঠনের মাধ্যমে তারা ছাত্র যুবকদের মধ্যে আন্দোলন সংগ্রামের মন মানসিকতা গড়ে তুললেন। তাদের সেই প্রয়াস প্রস্তুতি ও চলমান ঘটনাবলির পাশ কাটিয়ে দেশের একচোখা বুদ্ধিজীবীরা ’৭১ এর ২৫ মার্চের আগের দিনও বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে পেলেন না। সিরাজুল আলম খানের ভাষায় ‘এটা আমাদের জন্য এক লজ্জাকর কাহিনি’।

শুধু বুদ্ধিজীবীরাই নন, আওয়ামী লীগসহ এ দেশের ছোট-বড় কোনো রাজনৈতিক দলই মার্চ মাসের আগে স্বাধীনতার বিষয়টিকে সমর্থন করেননি। এমনকি তাদের রাজনৈতিক চিন্তার মধ্যেও ‘স্বাধীনতার বিষয়টি ছিল না। তবে এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থানটি ছিল একেবারেই ভিন্ন। ১৯৬৯ সালে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ থেকে মুক্তি লাভের পরই বঙ্গবন্ধুকে নিউক্লিয়াস ও বিএলএফ সম্পর্কে অবহিত করা হয়। তখন থেকে তিনি স্বাধীনতার প্রশ্নে শুধু আপসহীনই ছিলেন না, নিউক্লিয়াস ও বিএলএফের কর্মকা কে সমর্থন করতেন এবং আমাদের যে কোনো পদক্ষেপে উৎসাহ জোগাতেন। এখানে স্পষ্টভাবে বলা প্রয়োজন, দলগতভাবে আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার বিষয়টিকে সমর্থন করেনি। প্রথমদিকে আওয়ামী লীগ স্লোগান হিসেবে জয় বাংলার বিরোধিতা করলেও বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব ও অবস্থান এবং নিউক্লিয়াস ও বিএলএফের প্রচ  চাপ এবং সাংগঠনিক ক্ষমতার কারণে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে তারা মেনে নিতে বাধ্য হয়। এই ‘জয় বাংলা’ স্লোগানই স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে জনগণের মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণের প্রধান সহায়ক ছিল।’ সিরাজুল আলম খান বইটির প্রারম্ভে আমার সীমাবদ্ধতা লিখতে গিয়ে আরও বলেছেন, কাজী আরেফ আহমেদ আজ বেঁচে নেই। আবদুর রাজ্জাকও চলে গেছেন। তারা তিনজন সব বিষয়ে একমত পোষণ করতেন এবং একই পথে হাঁটতেন। ’৬২ থেকে ’৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনো বিষয়ে এক মুহূর্তের জন্য তাদের মধ্যে মতপার্থক্য হয়নি। তিনি আরও লিখেছেন, ‘৫ বছর জেলে থাকার পর ’৮১ সালে যখন মুক্তি লাভ করি, তখন বুঝতে পারলাম গোটা দেশটাই এক জেলখানায় পরিণত হয়েছে।’

বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬ দফা প্রসঙ্গে সিরাজুল আলম খান বলেছেন, ১৯৬৬ সালে একদিন শেখ ফজলুল হক মণি তাকে বললেন, দোস্ত চল এক জায়গায় যাব। নিয়ে গেল আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির অফিসে। সেখানে এর আগে একবার শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন তাকে নিয়ে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ করিয়ে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তখন ছিলেন ওই ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে কারা আসবেন সেটি নিয়ে শাহ মোয়াজ্জেম পরামর্শ করতে গিয়েছিলেন। যাক, শেখ মণি সেদিন সিরাজুল আলম খানকে ড্রইংরুমে বসিয়ে চায়ের অর্ডার দিয়ে ভিতরে গেলেন। ৫ মিনিটের মধ্যে চাও এলো, শেখ মণিও এলেন। শেখ মণি টাইপ করা একটি কাগজ তার হাতে দিয়ে ৫ মিনিটের মধ্যে ফিরছি বলে আবার ভিতরে গেলেন। দুবার কাগজটি পড়ে সিরাজুল আলম খানের আর চা পান করা হলো না। তিনি বলেছেন, ‘কাগজটা পড়ে আমি কেমন যেন হয়ে গেলাম। মণির ফেরত আসার অপেক্ষা না করেই আমি বেরিয়ে এলাম। তারপর কতক্ষণে কীভাবে যে ইকবাল হলে (বর্তমানে জহুরুল হক হল) ফিরে এসে রাজ্জাক ও আরেফকে খবরটা দিলাম, তা আমি বলতে পারব না! তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে আমরা প্রত্যেকে একবার করে কাগজটি পড়লাম। কারও মুখ থেকে কোনো কথা বেরোলো না। তিনজন পরস্পরের দিকে তাকালাম। তারপর একে অপরের হাতে হাত রেখে বললাম, এখন থেকে এটাই হবে আমাদের প্রথম কাজ।’ সেটি ছিল বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা প্রস্তাব। যা তাদের কাছে ছিল স্বাধীনতার প্রস্তাব।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ’৬৬ সালে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ৬ দফা প্রস্তাব পেশ করলেন। সে সময় এ দেশ থেকে বেশ কয়েকটি দৈনিক সংবাদপত্র বের হতো। এদের সবগুলোই ছিল পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি রক্ষার নিবেদিতপ্রাণ। এমনকি সে সময়ে আওয়ামী লীগপন্থি বলে পরিচিত পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাকও শেখ মুজিবের ৬ দফাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করল না। প্রথম পৃষ্ঠার মাঝামাঝি সিঙ্গেল কলামে কয়েক লাইনে খবরটি দিয়ে শিরোনাম করল ‘শেখ মুজিবের ৬ দফা’। ইংরেজি ও বাংলা অন্য পত্রিকাগুলো খবরটিকে কোনো গুরুত্ব দিল না। ছাপলেও চোখে প্রায় না পড়ার মতো করে ছাপল। কোনো কোনো পত্রিকা ৬ দফার দাবিগুলো উল্লেখ না করে একে দেশ দ্বিখি ত করার ষড়যন্ত্র বলতে দ্বিধা করল না। কয়েকদিনের মধ্যেই ৬ দফার বিরুদ্ধে প্রচার শুরু হয়ে গেল। বুনিয়াদি গণতন্ত্রের নামে দেশে একনায়কতন্ত্র চালানো সেনাশাসক আইয়ুব খান হুঙ্কার দিলেন, প্রয়োজনে অস্ত্রের ভাষায় ৬ দফার মোকাবিলা করা হবে। আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকেই ভয়ে চুপসে গেলেন। ৬ দফার প্রশ্নে দলের ভিতরে মতামত দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। এই পরিস্থিতিতে ৬ দফার পক্ষে ইতিবাচক সমর্থন এলো ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রস্তাবে।

ছাত্রলীগ সভাপতি সৈয়দ মাজহারুল হক বাকি ও সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক যৌথ বিবৃতিতে ৬ দফার প্রতি শর্তহীন ও পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করলেন। সিরাজুল আলম খান বলেছেন, মাজহারুল হক বাকি প্রথমদিকে একটু দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। তার সঙ্গে একাধিক বৈঠকে তিনি বিষয়টি পরিষ্কার করেন এবং বিবৃতিটি তিনি লিখে দেন। পরদিন দু-একটি পত্রিকায় বিবৃতিটির কথা ছাপা হলেও এর বিষয়বস্তুর কোনো উল্লেখ কোথাও ছিল না। এমনকি ইত্তেফাকেও ছাপা হলো ‘৬ দফাকে ছাত্রলীগের সমর্থন : বাকি ও রাজ্জাকের বিবৃতি’। তাও আবার ভিতরের পাতায়। মোটকথা সে সময়ের সংবাদপত্র ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণি ৬ দফার প্রতি কোনোভাবেই সমর্থন জ্ঞাপন করেননি, বরং বক্তৃতা-বিবৃতিতে, পত্রিকায় প্রকাশিত কলাম ও আলোচনার টেবিলে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার একটি ষড়যন্ত্র ৬ দফা বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা হয়েছে। এতে ‘আমাদের গোপন তৎপরতা ও সাংগঠনিক জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। আমাদের সামনে উপস্থিত হলো ইতিহাস রচনার এক নতুন সুযোগ। সেই সময় দু-একজন বাদে সাংবাদিকরা সবাই ছিলেন মস্কোপস্থি কিংবা চীনপন্থি। আইয়ুব খান ক্ষমতায় আসার পর চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গভীরে নেওয়ার চেষ্টা করেন। যদিও সম্পর্কের সূত্রপাত করেছিলেন আগের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। যদিও বামপন্থিরা সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে তার মৃত্যু অবধি মার্কিনপন্থি বলে অপবাদ দিয়ে গেছে। ভারতকে মোকাবিলা করার জন্য আইয়ুব চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বকে আরও উচ্চপর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেন। চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই পাকিস্তান সফরের অংশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিলেন। কূটনৈতিক পর্যায় ছাড়াও চীনপন্থি রাজনীতিবিদদের কাজে লাগানোর চিন্তা থেকে আইয়ুব খান মওলানা ভাসানীর সঙ্গে কয়েকটি বৈঠক করেন। এতে তার সরকারের সঙ্গে ভাসানী ও তার অনুসারীদের হৃদ্যতা সৃষ্টি হয়। ভাসানীর পরামর্শে ছয়জন কমিউনিস্ট ও কমিউনিস্টপন্থি রাজনীতিবিদদের ওপর থেকে হুলিয়া তুলে নেন। এদের মধ্যে ছিলেন, মোহাম্মদ তোয়াহা, আবদুল হক, অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ প্রমুখ। অধ্যাপক মোজাফফর ছিলেন মস্কোপন্থি। বাকিরা চীনপন্থি। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে চীনা কমিউনিস্ট বইপত্রের ছড়াছড়ি দেখা যায়। দোকানে দোকানে মাও সেতুংয়ের খুদে লাল বই দৃশ্যমান হতে থাকে। আইয়ুব-ভাসানীর সমঝোতার প্রধান বিষয় ছিল, শেখ মুজিবের ৬ দফার বিরোধিতা করা। ছাত্র ইউনিয়ন ও জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ ৬ দফাকে পাকিস্তান ধ্বংসের ষড়যন্ত্র এবং আমেরিকা বা সিআইএ’র দলিল হিসেবে চিত্রিত করত। তারা বলত, আমেরিকা ৬ দফার মাধ্যমে পাকিস্তানকে দুই টুকরো করে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানকে একটি মার্কিন উপনিবেশে পরিণত করতে চায়। তারা আরও বলতে থাকে, ৬ দফা শেখ মুজিব বা বাঙালিদের নয়, এটি যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু অর্থনীতিবিদ ও মার্কিন সামরিক বাহিনীর যৌথ চিন্তার ফসল। শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকে তারা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালাল বলত। সিরাজুল আলম খানের ভাষায়, তারা তখন এ অপপ্রচারের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করতেন।

সিরাজুল আলম খান বলেন, ৫০ বছরেরও পরে আজ আমরা কী দেখছি? সেদিন যারা ৬ দফার পক্ষে জীবন দিয়ে সংগ্রাম করেছিল, বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ করেছিল, তাদের অধিকাংই আজ ক্ষমতা এবং রাজনীতির মূলধারা থেকে অনেক দূরে ছিটকে পড়েছে। অথচ ৬ দফাকে সিআইএ’র দলিল এবং শেখ মুজিবকে সিআইএ’র দালাল বলা রাশেদ খান মেনন-মতিয়া চৌধুরীরা অনেকেই মন্ত্রী ও অন্যান্য পর্যায়ে রাষ্ট্র ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। এর আগের সরকারে ইসলামী ছাত্র সংঘের তৎকালীন সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী ও আরেক নেতা আলী আহসান মুজাহিদ পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। সেদিন তাদের অপপ্রচারের জবাবে ছাত্রলীগ ৬ দফাকে ‘ম্যাগনা কার্টা’ বা অধিকারের দলিল হিসেবে ঘোষণা দিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালায়।

সিরাজুল আলম খান বলেন, ৬ দফা দেওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায়। তখনো আওয়ামী লীগের অফিস ১৫, পুরানা পল্টনে। অফিস থেকে ফেরার পথে তিনি প্রায়ই গাড়িতে করে তাকে হলের কাছাকাছি অথবা ধানমন্ডির কোথাও নামিয়ে দিয়ে বাসায় যেতেন। এ পর্যায়ে তার সঙ্গে নিউক্লিয়াস নিয়ে কোনো আলাপ আলোচনা হয়নি। তবে তার কাজের গতি ও গভীরতা যে কোনো বিষয়ে তার আগ্রহ এসব শেখ মুজিবের নজরে পড়ত। একদিন বঙ্গবন্ধু তাকে বললেন, ‘সিরাজ, আমি হয়তো বেশিদিন বাইরে থাকতে পারব না’। কথাটা শুনে আমার ভালো লাগল না। চলবে........

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর