স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠকারী, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, চার বারের সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী শাজাহান সিরাজ গতকাল ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন। তিনি দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভুগছিলেন। গতকাল বিকাল ৩টা ২৫ মিনিটে রাজধানীর এভার কেয়ার হাসপাতালে (সাবেক এ্যাপোলো) তিনি মারা যান। শাজাহান সিরাজের বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। তিনি স্ত্রী রাবেয়া সিরাজ, মেয়ে সারওয়াত সিরাজ ও ছেলে রাজীব সিরাজকে রেখে গেছেন। তার পারিবারিক সূত্র জানায়, ২০১২ সালে শাজাহান সিরাজের ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়ে। এরপর তা মস্তিষ্কেও ছড়িয়ে পড়ে। তখন থেকে তিনি রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। তার অবস্থার অবনতি ঘটলে গত সোমবার তাকে এভার কেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। শাজাহান সিরাজের মৃত্যুর খবরে রাজনৈতিক মহলসহ সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। খবর পেয়ে তার গুলশানের বাসায় ছুটে যান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসসহ দলের নেতা-কর্মীরা। এ সময় তারা মরহুমের লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সে শেষ শ্রদ্ধা জানান। কেউ কেউ তৎক্ষণাৎ ছুটে যান এভার কেয়ার হাসপাতালেও। বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস উইং সদস্য শায়রুল কবির খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বুধবার সকালে টাঙ্গাইলের কালিহাতী লাশ নেওয়া হবে। এলেঙ্গা ও কালিহাতীতে দুই দফা নামাজে জানাজা শেষে তাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হবে। বাদ এশা গুলশান কেন্দ্রীয় মসজিদে (আজাদ মসজিদ) নামাজে জানাজা শেষে তাকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে। মুক্তিযোদ্ধা শাজাহান সিরাজের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। শোক জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শোক বার্তায় তারা শাজাহান সিরাজের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনার পাশাপাশি শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সমবেদনা জানান। এ ছাড়া বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লাহ বুলু, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুও গভীর শোক প্রকাশ করেন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব, স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না গভীর শোক প্রকাশ করেন। এ ছাড়া জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদেরর সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল হাই ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব শফিকুল বাহার মজুমদার টিপু শোক প্রকাশ করেন। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে জাসদ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল শাজাহান সিরাজের। এরপর জাসদের নানা ভাঙনের মধ্যে নিজে একটি অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি। ’৯০-এর দশকে এসে বিএনপিতে যোগ দেন শাজাহান সিরাজ। মৃত্যুর সময় দলটির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। ২০০১ সালে খালেদা জিয়ার সরকারে তিনি বন ও পরিবেশমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
জীবন বৃত্তান্ত : শাজাহান সিরাজের জন্ম ১৯৪৩ সালের ১ মার্চ টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে। তার বাবার নাম আবদুল গনি মিয়া ও মারহিমা বেগম। ছাত্রলীগের মাধ্যমে রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয় শাজাহান সিরাজের। টাঙ্গাইলের করটিয়া সাদত কলেজ ছাত্র সংসদের দুই বার ভিপি ছিলেন তিনি। ষাটের দশকে উত্তাল সময়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব পর্যায়ে চলে আসেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের আগে তিনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তখন ছাত্র আন্দোলনের পুরোধা হিসেবে ছাত্রলীগের যে চারজনকে ‘চার খলিফা’ বলা হতো, তাদের একজন হলেন শাজাহান সিরাজ। অন্য তিনজন ছিলেন ডাকসুর তখনকার ভিপি আ স ম আবদুর রব, ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী এবং ডাকসুর তৎকালীন জিএস আবদুল কুদ্দুস মাখন (প্রয়াত)। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ‘ছাত্র আন্দোলনের নিউক্লিয়াস’র পক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। সেদিন পতাকা উড়িয়েছিলেন আ স ম রব, আর ইশতেহার পড়েছিলেন শাজাহান সিরাজ। স্বাধীনতার পর রব-সিরাজের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের ভাঙন থেকে জাসদ গঠিত হলে সেই দলের সহ সাধারণ সম্পাদক হন শাজাহান সিরাজ। তখন তাকে কিছু দিন কারাগারেও থাকতে হয়েছিল। পরে জাসদ ভাঙতে ভাঙতে কয়েকটি ভাগ হলে একটি অংশের নেতৃত্ব ধরে রাখেন শাজাহান সিরাজ। প্রথম হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে হাত মেলানো নিয়ে রবের সঙ্গে দ্বন্দ্বে আলাদা হয়ে যান তিনি। তখন শাজাহান সিরাজের সঙ্গে ছিলেন হাসানুল হক ইনু। ইনু পরে আলাদা জাসদ গড়লে একা হয়ে পড়েন শাজাহান সিরাজ। কয়েক বছর পর ১৯৯৫ সালে তিনি দল বিলুপ্ত করে বিএনপিতে যোগ দেন। পরে ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকারে মন্ত্রী হন। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে গ্রেফতার হন শাজাহান সিরাজ। তখন দুর্নীতির মামলায় তার সাজার রায়ও হয়েছিল। রাবেয়া সিরাজও তখন মামলায় জড়িয়েছিলেন। রাবেয়া বিএনপির সহযোগী সংগঠন মহিলা দলের নেত্রী থেকে পরে কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ তাঁতীবিষয়ক সম্পাদকও হয়েছিলেন। সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে কিছু দিন কারাগারে থেকে মুক্তি পেলেও অসুস্থতার কারণে আর রাজনীতিতে সক্রিয় হতে পারেননি শাজাহান সিরাজ। শাজাহান সিরাজ জাসদ ও বিএনপি উভয় দল থেকেই টাঙ্গাইল থেকে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। তিনি ১৯৭৯ সালে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জাসদ থেকে। এরপর ১৯৮৬ এবং ১৯৮৮ সালের সংসদেও জাসদ থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৬ সালের বিতর্কিত ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি বিএনপি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।