রবিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

পরিবারের বাইরে আওয়ামী লীগ

উপনির্বাচনে ২৪ মন্ত্রী-এমপির পরিবার পায়নি মনোনয়ন

রফিকুল ইসলাম রনি

পরিবারের বাইরে আওয়ামী লীগ

নাটোর-৪ আসনের আসন্ন উপনির্বাচনে দলীয় মনোনয়নে জোর আলোচনায় ছিলেন প্রয়াত এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আবদুল কুদ্দুসের মেয়ে কোহেলী কুদ্দুস মুক্তি। কিন্তু দলীয় মনোনয়ন মেলেনি। মুক্তি জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও যুব মহিলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি। এ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন বড়াইগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী।

এতে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ইতিবাচক সাড়া পড়েছে। তারা অনেকাংশেই উজ্জীবিত।

অধ্যাপক আবদুল কুদ্দুস পাঁচবারের নির্বাচিত এমপি এবং সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী আবদুল কুদ্দুস ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বৃহত্তর রাজশাহী জেলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সভাপতি, রাজশাহী জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, দুবার নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। সবার ধারণা ছিল, পিতার ভার কন্যার কাঁধেই উঠছে। কিন্তু তা হয়নি। পরিবার থেকে বেরিয়ে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে দলের এক প্রবীণ নেতাকে। একাদশ জাতীয় সংসদের মোট ২৮ জন এমপি মারা গেছেন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ২৬ জন। তার মধ্যে চারটি বাদে বাকিগুলোয় এমপি-মন্ত্রীদের পরিবারের বাইরে গিয়ে ত্যাগী-পরীক্ষিত প্রবীণ-নবীন নেতাদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এক এমপির পদত্যাগ ও আরেকজনের আইনি প্রক্রিয়ায় শূন্য হওয়া আসনেও তাঁদের পরিবারের কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশের ইতিহাসে একাদশ জাতীয় সংসদেই সবচেয়ে বেশি উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

সূত্রমতে, আওয়ামী লীগ অতীতে অধিকাংশ সময়ই এমপি-মন্ত্রী মারা গেলে তাঁদের স্ত্রী, পুত্র বা কন্যাদের দলীয় মনোনয়ন দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সেই ধারা থেকে বেরিয়ে আসছে দলটি। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘অনেক সময় এমন হয়েছে, দেখা গেছে একজন এমপি মারা যাওয়ার পর ওই নির্বাচনী এলাকায় তাঁর স্ত্রী বা সন্তান বেশি জনপ্রিয়। দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক। তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে। এমপি মারা গেছেন, তাঁর আত্মীয় হিসেবে দেওয়া হয়নি। আমরা দেখেছি কে যোগ্য, তাঁকে দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের এমপি মারা গেলে তাঁর পরিবারের সদস্যদের পরবর্তী নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হয়, এটা সত্য নয়। আমাদের মনোনয়ন দেওয়া হয় প্রার্থীর ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয়তা, যোগ্যতা এবং সাধারণ মানুষের মাঝে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা বিবেচনায়।’ ঢাকা-১৭ আসনের এমপি চিত্রনায়ক আকবর হোসেন পাঠান ফারুক মারা যাওয়ার পর এ আসনে নৌকা চান তাঁর ছেলে রৌশন হোসেন পাঠান। কিন্তু ছেলেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। এ আসনে নৌকা পান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আলী আরাফাত (মোহাম্মদ এ আরাফাত)। নেত্রকোনা-৪ আসনের এমপি রেবেকা মমিনের মৃত্যুর পর এ আসনে নৌকা দেওয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব সাজ্জাদুল হাসানকে। জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট মো. ফজলে রাব্বি মিয়ার মৃত্যুতে শূন্য হওয়া গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে মনোনয়ন পান ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহমুদ হাসান রিপন। এ আসনে ফজলে রাব্বি মিয়ার মেয়ে ফুলছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফারজানা রাব্বি বুবলীও মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। ঢাকা-১৪ আসনের এমপি আসলামুল হকের মৃত্যুর কারণে শূন্য আসনে মনোনয়ন চান তাঁর স্ত্রী মাকসুদা হক। আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেয় দলের থানা পর্যায়ের সভাপতি আগা খান মিন্টুকে। কুমিল্লা-৭ আসনের উপনির্বাচনে মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত। এ আসনের প্রয়াত এমপি অধ্যাপক আলী আশরাফের ছেলে মুনতাকিম আশরাফ টিটুও দলের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। একই অবস্থা কুমিল্লা-৫ আসনের পাঁচবারের এমপি আবদুল মতিন খসরুর আসনে। তাঁর মৃত্যুর পর শূন্য আসনে ছেলে মুনেফ ওয়াসিফ, মেয়ে ডা. উম্মে হাবিবা দিলশাদ মুনমুন, প্রয়াত এমপির সহোদর কুমিল্লা বারের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুল মমিন ফেরদৌস, স্ত্রী সালমা সোবহান খসরু মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু মনোনয়ন দেওয়া হয় বুড়িচং উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও কুমিল্লা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট আবুল হাসেম খানকে। সিরাজগঞ্জ-৬ আসনে হাসিবুর রহমান স্বপনের মৃত্যুতে শূন্য আসনে মনোনয়ন পান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য অধ্যাপক মেরিনা জাহান কবিতা। পাবনা-৪ আসনের পাঁচবারের নির্বাচিত এমপি শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর মৃত্যুতে শূন্য আসনে মনোনয়ন পান নুরুজ্জামান বিশ্বাস। এ আসনে প্রয়াত মন্ত্রী ডিলুর ছেলে গালিবুর রহমান শরীফসহ অনেকেই মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। ঢাকা-৫ আসনের এমপি প্রয়াত শ্রমিকনেতা হাবিবুর রহমান মোল্লার মৃত্যুতে শূন্য আসনে মনোনয়ন পান যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী মনিরুল ইসলাম। এ আসনে সবার ধারণা ছিল প্রয়াত এমপি হাবিবুর রহমান মোল্লার ছেলে ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান সজল নৌকা পাবেন। গাইবান্ধা-৩ আসনে ডা. ইউনূস আলী সরকারের মৃত্যুতে শূন্য আসনে মনোনয়ন পান উম্মে কুলসুম স্মৃতি। সদ্যপ্রয়াত এমপি ইউনুস আলী সরকারের ছেলে ড. ফয়সাল ইউনুস মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। নওগাঁ-৬ আসনে ইসরাফিল আলমের মৃত্যুতে শূন্য আসনে মনোনয়ন পান আনোয়ার হোসেন হেলাল। এ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন ইসরাফিলের স্ত্রী পারভীন সুলতানা বিউটি। বাগেরহাট-৪ আসনে এমপি ডা. মোজাম্মেল হোসেনের মৃত্যুতে শূন্য আসনে মনোনয়ন পান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য আমিরুল আলম মিলন। ওই আসনে মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছেন প্রয়াত সংসদ সদস্যের পুত্রবধূ ইসমত আরা শিরিন চৌধুরী। যশোর-৬ আসনে ইসমত আরা সাদেকের মৃত্যুতে শূন্য আসনে মনোনয়ন পান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার। মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হন প্রয়াত এমপি ইসমত আরা সাদেকের কন্যা নওরীন সাদেক। টাঙ্গাইল-৭ আসনে একাব্বর হোসেনের মৃত্যুতে শূন্য আসনে মনোনয়ন পান খান আহমেদ শুভ। ঢাকা-১৮ আসনে অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের মৃত্যুর পর মনোনয়ন পান ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাবিব হাসান। সিলেট-৩ আসনে মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী কয়েসের মৃত্যুতে শূন্য আসনে মনোনয়ন পান হাবিবুর রহমান হাবিব। এ আসনে মাহমুদ উস সামাদের স্ত্রী ফারজানা সামাদ মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। চট্টগ্রাম-১০ আসনে ডা. আফছারুল আমীনের মৃত্যুতে শূন্য আসনে মনোনয়ন পান মহিউদ্দিন বাচ্চু। এ আসনে প্রয়াত ডা. আফছারুল আমীনের স্ত্রী কামরুন নেছা, ছেলে মো. ফয়সাল আমীন, ভাই মো. এরশাদুল আমীন মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। চট্টগ্রাম-৮ আসনে জাসদের এমপি মাঈনুদ্দিন খান বাদলের মৃত্যুতে শূন্য আসনে মনোনয়ন পান আওয়ামী লীগ নেতা মোছলেম উদ্দিন আহমেদ। একই আসনে পরে মোছলেম উদ্দিন আহমেদের মৃত্যুতে শূন্য আসনে মনোনয়ন পান আরেক আওয়ামী লীগ নেতা নোমান আল মাহমুদ। ঢাকা-১০ আসনে ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস পদত্যাগ করে মেয়র নির্বাচন করেন। এ শূন্য আসনে মনোনয়ন পান ব্যবসায়ী নেতা শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। লক্ষ্মীপুর-২ আসনে স্বতন্ত্র এমপি মো. শহিদ ইসলাম পাপুলের আইনি প্রক্রিয়ায় শূন্য আসনে মনোনয়ন পান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুদ্দিন চৌধুরী নয়ন। এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জাতীয় বিশ্বিবদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. হারুন-অর রশিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এমপি-মন্ত্রীদের পরিবারের বাইরে পুরনো, ত্যাগী, পরীক্ষিত নেতা-কর্মীদের দলীয় মনোনয়ন দেওয়া দলের জন্য ইতিবাচক দিক। শুধু উপনির্বাচনেই নয়, প্রতিটি নির্বাচনেই দলের পুরনো, পরীক্ষিত, সৎ, যারা দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ কে ধারণ করেছে, তাদেরকে মনোনয়ন দেওয়া উচিত। তাহলে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা উজ্জীবিত হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমনভাবে নেতৃত্ব সৃষ্টি করেছেন। ইউনিয়ন থেকে উপজেলা, জেলা থেকে জাতীয় পর্যায়ে এনেছেন। এগুলো কেউ বঙ্গবন্ধুর আত্মীয় নন। এতে করে দলটি এগিয়েছে। তৃণমূলের কর্মীদের যদি যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়, তাহলে সার্বিক প্রভাব দলের ওপর পড়বে। তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা মনে করবেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে লেগে থাকলে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তাদের মূল্যায়ন করে। তাহলে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে। এটাই আওয়ামী লীগের আদর্শ। এ ধারা আগামী জাতীয় নির্বাচনেও হওয়া উচিত।’

সর্বশেষ খবর