বহুল আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্তকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করেছিলেন গ্রেপ্তার রিয়ার অ্যাডিমিরাল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) এম সোহায়েল এবং মেজর জেনারেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) জিয়াউল আহসান। হত্যাকাণ্ডের আগে থেকেই এ বিষয়ে অনেক কিছু তারা অবগত থাকলেও তাতে বাধা দেননি। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে থাকা শেখ হাসিনা সরকারের এই দুই প্রভাবশালী কর্মকর্তাসহ অনেকে জিজ্ঞাসাবাদে এমনই ইঙ্গিত দিয়েছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
গত ১৬ আগস্ট ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে জিয়াউলকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। গত ২০ আগস্ট রাতে রাজধানীর বনানী থেকে গ্রেপ্তার করা হয় এম সোহায়েলকে। পরবর্তীতে তাদের আট এবং চার দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বহুল আলোচিত এবং চাঞ্চল্যকর সাগর-রুনি হত্যা মামলাটির রহস্য উন্মোচনে র্যাবের ওপর আস্থা রেখেছিলেন আদালত। তবে এ ঘটনায় যদি র্যাবেরই সাবেক কোনো কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা থাকে তাহলে কোনোভাবেই মামলার তদন্ত তাদের কাছে রাখা উচিত হবে না। নিশ্চয়ই আদালতের নজরে বিষয়টি আনা উচিত হবে। নয়তো ইহ জনমেও এর রহস্য উন্মোচন
হবে না। মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং তার স্ত্রী এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে ভাড়া বাসায় নৃশংসভাবে খুন হন। সবশেষ গত ৩০ জুন পর্যন্ত এ হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় ১১১ বার পিছিয়েছে তদন্তকারী সংস্থা। আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় বারবার পেছাতে সময় চাইছে শুরুর দিক থেকে এ মামলা তদন্তের দায়িত্বে থাকা র্যাব। এক যুগ আগে খুন হওয়া সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্তে বিলম্ব দেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার সঙ্গে ‘ক্রমাগত উপহাস’ বলে হাই কোর্টের একটি রায়ের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। চলতি বছরের ১৩ মে মৃত্যুদ াদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে আসামিদের কনডেম সেলে বন্দি রাখা যাবে না বলে দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো. বজলুর রহমানের হাই কোর্ট বেঞ্চ এ পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। জানা গেছে, শেখ হাসিনা সরকারের সময় এলিট ফোর্স র্যাবের প্রভাবশালী কর্মকর্তা ছিলেন বাহিনীর সাবেক আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক সোহায়েল। ২০১০ সাল থেকে পরবর্তী দুই বছর র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক ছিলেন। ওই সময় থেকেই তার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক গুম, হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে।
২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সোহায়েল কমোডর থেকে রিয়ার অ্যাডমিরাল হিসেবে পদোন্নতি পান। অভিযোগ ওঠে, কোনো জাহাজ বা ঘাঁটি কমান্ড কিংবা গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কোর্স না করেই শেখ হাসিনা সরকারের আনুকূল্যে রিয়ার অ্যাডমিরাল হিসেবে পদোন্নতি পান তিনি। গত বছরের ১২ এপ্রিল চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার আগে ২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ছিলেন। অন্যদিকে, নিউমার্কেট থানার শাহজাহান আলী হত্যা মামলায় আদালতের নির্দেশে আট দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয় জিয়াউল আহসানকে। ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালক ছিলেন জিয়া। গত ১৫ বছর আলোচিত ও প্রভাবশালী এই কর্মকর্তাকে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পরদিন চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন পাওয়া জিয়াউল ২০০৯ সালে মেজর থাকাকালে র্যাব-২ এর উপ-অধিনায়ক হন। ওই বছরই তিনি পদোন্নতি পেয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হন এবং র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখার পরিচালকের দায়িত্ব পান। পরে কর্নেল পদে পদোন্নতি পেয়ে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে তিনি র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হন। ২০১৬ সালে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি পান। এর পর কিছুদিন তিনি জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দার (এনএসআই) পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। ২০১৭ সালে তাকে এনটিএমসির পরিচালক করা হয়। ২০২২ সালে সংস্থাটিতে মহাপরিচালক পদ সৃষ্টি করে তাকে এনটিএমসির পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়।