তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে নেওয়া ২৫ হাজার কোটি টাকার ২২ প্রকল্পের অর্ধেকই লুট করা হয়েছে। এ চিত্র দেখে বিস্মিত তদন্ত কমিটি। এসব লুটপাট হয়েছে সাবেক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের নেতৃত্বে। তদন্ত কমিটি জানিয়েছে, প্রায় প্রতিটি প্রকল্পে পাওয়া গেছে লুটপাটের চিত্র। কেনাকাটা হয়েছে আকাশচুম্বী দামে। খরচ হয়েছে বেশুমার। কী চাতুরী করে কত কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে এখন সে হিসাব কষছেন তাঁরা।
শিগগিরই চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা দেওয়া হবে। তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, তদন্তে টাকার কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। ২২ প্রকল্পের প্রতিটির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখতেন প্রতিমন্ত্রী। তাঁর নির্দেশের বাইরে ওইসব প্রকল্পের কোনো টাকা ছাড় হতো না। প্রকল্প পরিচালকরা (পিডি) নিয়মিত হাজিরা দিতেন প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরে। সেখানে তিনি রুদ্ধদ্বার বৈঠক করতেন। বৈঠকের কোনো সিদ্ধান্ত বাইরে প্রকাশ করা মানা ছিল। তাই বিড়ালকে থলে ভরে মুড়ে রাখা হয়েছে এতদিন। ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের ফলে বিশাল অঙ্কের প্রকল্পের দুর্নীতি নামক থলের বিড়াল বেরিয়ে আসছে।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে ডাক, টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের প্রকল্পের অনিয়ম ও দুর্নীতি খতিয়ে দেখতে অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের সাত সদস্যের কমিটি করে। কমিটিতে অডিট বিশেষজ্ঞ, আইন বিশেষজ্ঞরাও আছেন। সূত্র জানান, তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পরপরই উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম সংবাদ সম্মেলন করে দুর্নীতির বিস্তারিত তুলে ধরবেন। তদন্তের সার্বিক দিক প্রসঙ্গে তদন্ত কমিটির প্রধান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন অনুবিভাগ) মাহবুবুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘২১ জন পিডিকে ডাকা হয়েছিল। তাঁদের বক্তব্য শোনা হয়েছে। আমরা দেখেছি প্রায় প্রতিটি প্রকল্পে নানা ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়েছে। তদন্তের সময়ই বেশির ভাগ প্রকল্পের অপ্রয়োজনীয় টাকার অঙ্ক বাদ দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এতে সরকারের বিপুল পরিমাণ টাকা সাশ্রয় হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘প্রায় সব প্রকল্পের বাজেটে কতিপয় অঙ্কের ব্যাপারে বিস্ময়কর কিছু আছে। আমরা দেখছি দুর্নীতির থলের বিড়াল বেরিয়ে আসছে। চলমান প্রকল্পের বাইরে হাতে নেওয়া হয়েছে এমন বেশ কয়েকটি ভবিষ্যৎ প্রকল্পেরও তদন্ত করা হচ্ছে। সেসব প্রকল্পেও হরিলুটের চিত্র পাচ্ছি। এরই মধ্যে ১০-১২টি প্রকল্প বাদ দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘যদি সংস্কারের কথা বলা হয় তাহলে বলব এ খাতে আসল সংস্কার হচ্ছে।’ প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, তদন্ত কমিটির কাছে তাঁরা জবাবদিহি করছেন। কমিটির পক্ষ থেকে কোনো কোনো প্রকল্পের বাজেট কাটছাঁট করার নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। এসব প্রকল্পের কেনাকাটা নিয়ে তাঁরা প্রশ্ন তুলছেন। পাশাপাশি যাঁদের বিভিন্ন কাজ দেওয়া হয়েছে তাঁদের বিষয়েও বিশদ খোঁজখবর নিচ্ছেন।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নেওয়া হয়েছিল ২২ প্রকল্প। এসব প্রকল্পের মধ্যে ১৯ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের অধীনে। সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার ছয়টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি)। অনুসন্ধানে জানা যায়, ২২ প্রকল্পের বেশির ভাগ নেওয়া হয় ২০১৬ সালে। কয়েকটি প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৭ সাল পর্যন্ত। কয়েকটি প্রকল্পে টাকা বরাদ্দের পরিমাণ কয়েক ধাপে বাড়ানো হয়। প্রতিটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে সরকারের নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্তে। এসব প্রকল্পের টাকা ছাড় হতো তাদের সরাসরি সিদ্ধান্তে। প্রকল্পের সরঞ্জামাদি সরবরাহের কাজ দেওয়া হতো তাদের পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে। কারণ মনপছন্দ প্রতিষ্ঠান থেকে কেনার ব্যবস্থায় থাকে লুণ্ঠনের নিশ্চিত সুযোগ।
তদন্ত চলছে যেসব প্রকল্পে : ৩৩০ কোটি টাকার মোবাইল গেম ও অ্যাপ্লিকেশনের দক্ষতা উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্প, ৮৫৫ কোটি টাকার অ্যাসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই), ২৭ কোটি টাকার দীক্ষা-দক্ষতা উন্নয়নে শিক্ষা অনলাইনে, ৪৪২ কোটি টাকার উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন একাডেমি প্রতিষ্ঠাকরণ (তৃতীয় সংশোধিত), ১৫৮ কোটি টাকার গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধিকরণ (প্রথম সংশোধিত), ৩০ কোটি টাকার ডিজিটাল সিলেট সিটি শীর্ষক প্রকল্প (দ্বিতীয় সংশোধিত), ৫০৪ কোটি টাকার টেলিযোগাযোগ সুবিধাবঞ্চিত এলাকাসমূহে কানেকটিভিটি স্থাপন (কানেকটেড বাংলাদেশ) প্রকল্প, ১৬৭ কোটি টাকার বিজিডি-ই-গভর্নমেন্টের সক্ষমতা বৃদ্ধি শীর্ষক প্রকল্প, ২ হাজার ৫৪১ কোটি টাকার ইনহ্যানচিংডিজিটাল গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ইকোনমি (ইডিজিই) শীর্ষক প্রকল্প, ৪৯ কোটি টাকার সরকারের ভিডিও কনফারেন্সিং প্ল্যাটফরম শক্তিশালীকরণ শীর্ষক প্রকল্প, ৮ কোটি টাকার পার্টনারশিপস ফর এ মোর টলারেন্ট, ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ (পিটিআইবি)। এ ছাড়া বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের অধীনে ৮৩৭ কোটি টাকার শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার (১১টি) প্রকল্প (প্রথম সংশোধিত), ১ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকার জেলা পর্যায়ে আইটি/হাই-টেক পার্ক স্থাপন (১২ জেলায়) (প্রথম সংশোধিত), ৫৩৩ কোটি টাকার শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন (দ্বিতীয় সংশোধিত) প্রকল্প, ৪৩১ কোটি টাকার বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটি-২-এর সহায়ক অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প (দ্বিতীয় সংশোধিত), ৩৫৩ কোটি টাকার ডিজিটাল উদ্যোক্তা এবং উদ্ভাবন ইকো-সিস্টেম উন্নয়ন প্রকল্প, ৭৪ কোটি টাকার বাংলাদেশ-ভারত ডিজিটাল সেবা ও কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ (বিডিসেট) কেন্দ্র প্রতিষ্ঠাকরণ শীর্ষক প্রকল্প, ১ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকার শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউট অব ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি, ১ হাজার ১১৪ কোটি টাকার শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন (১৪টি) প্রকল্প। এ ছাড়া তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তর তিনটি প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ৯৩৬ কোটি টাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়), ৫ হাজার ৯২৩ কোটি টাকার ডিজিটাল সংযোগ স্থাপন (ইডিসি) প্রকল্প ও ২৮৭ কোটি টাকার হার পাওয়ার প্রকল্প : প্রযুক্তির সহায়তায় নারীর ক্ষমতায়ন-দ্বিতীয় পর্যায় প্রকল্প। বিসিসির ছয় প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ২৭১ কোটি টাকার উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন একাডেমি প্রতিষ্ঠাকরণ প্রকল্প, ১৫৯ কোটি টাকার গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধিকরণ প্রকল্প, ৫০৪ কোটি টাকার কানেকটেড বাংলাদেশ প্রকল্প, ২ হাজার ১৪১ কোটি টাকার বিজিডি ই-গভ. শার্ট প্রকল্প, ৪৭ কোটি টাকার সরকারের ভিডিও কনফারেন্সিং প্ল্যাটফরম শক্তিশালীকরণ প্রকল্প ও ২ হাজার ৫৪১ কোটি টাকার ডিজিটাল সরকার ও অর্থনীতি শক্তিশালীকরণ প্রকল্প।