ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় ইন্টারনেট বন্ধের নেপথ্য কারিগর ছিলেন সাবেক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং জাতীয় টেলিযোগাযোগ মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)-এর সাবেক মহাপরিচালক বহিষ্কৃত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান। ইন্টারনেট বন্ধ করার পেছনে মূল লক্ষ্য ছিল দেশে তরুণদের আন্দোলনের খবর চেপে রাখা। পলক ও জিয়ার দেওয়া নির্দেশনা তিন-চারটি ধাপে অপারেটরদের কাছে যায়। তবে ১৮ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে জিজ্ঞাসাবাদে সাবেক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক স্বীকার করেন, ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল। ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের জন্য যেসব কারণ তখন দেখানো হয়েছিল সবই ছিল সাজানো ও মিথ্যা।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এ-সংক্রান্ত একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলেও সে কমিটির রিপোর্টেও স্পষ্ট হয়নি কোনো কিছুই। তবে সে সময় দেওয়া সরকারি আদেশ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে করা অনুসন্ধানে প্রকৃত চিত্র উঠে এসেছে। সম্প্রতি ওই অনুসন্ধানের বিস্তারিত জানানো হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়কে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই ইন্টারনেট সীমিতকরণ শুরু হয়। প্রথমে মোবাইল অপারেটররা বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোয় ইন্টারনেট সেবা সীমিত করে। এনটিএমসির নির্দেশে ১৭ জুলাই থেকে মোবাইল অপারেটররা সম্পূর্ণভাবে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। ১৮ জুলাই তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী পলক আগারগাঁওয়ের আইসিটি টাওয়ারে প্রেস ব্রিফিংয়ে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করার বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আন্দোলনকেন্দ্রিক অনিশ্চিত পরিস্থিতির কারণে মোবাইল ইন্টারনেট সেবা সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে। পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে আমরা দ্রুত সংযোগ পুনরুদ্ধার করব।’ ওই নির্দেশের পর বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সমস্ত গেটওয়ে অপারেটরকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। বিটিআরসি প্রথমে সমস্ত আন্তর্জাতিক টেরিস্ট্রিয়াল কেবল (আইটিসি) অপারেটরের সঙ্গে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি করে। পরে ওই গ্রুপে দেওয়া নির্দেশনা অনুসরণ করার জন্য আইটিসি অপারেটরদের নির্দেশ দেয়। নির্দেশনা পালন না করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ারও হুমকি দেয় বিটিআরসি। এ ছাড়া বিটিআরসি আইটিসি অপারেটরদের সঙ্গে গ্রুপ কলে সম্পূর্ণ আইটিসি সেবা বন্ধ করার জন্য নির্দেশনা জারি করে। একই ধরনের নির্দেশ বিটিসিএল (বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি লিমিটেড) এবং বিএসসিপিএলসি (বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল পিএলসি)-কেও দেওয়া হয়। একই দিনে বিটিআরসি সমস্ত আইআইজি (ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে) অপারেটরকে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। এতে ইন্টারনেট সেবা পুরোপুরি অচল হয়ে যায়। অন্যদিকে, একই ধরনের নির্দেশনা মোবাইল অপারেটরদের ক্ষেত্রেও জারি করে বিটিআরসি। অবশ্য ১৮ জুলাই বিটিআরসির ওই নির্দেশনা জারির এক দিন আগে প্রতিমন্ত্রী পলক ও জিয়াউল আহসানের মৌখিক নির্দেশে ১৭ জুলাই থেকেই ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রেখেছিলেন মোবাইল অপারেটররা। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ২৩ জুলাই বিটিআরসি বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি, সব আইটিসি অপারেটর, আইআইজি এবং আইএসপি অপারেটরের সঙ্গে একটি সভা আয়োজন করে। ওই সভায় আইটিসি এবং সাবমেরিন ক্যাবল অপারেটরদের সেবা পুনরায় চালু করার নির্দেশ দেওয়া হয়। আইএসপিদের জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ সেবা, যেমন হাসপাতাল, কূটনৈতিক অঞ্চল, আদালত, দূতাবাস, বিমানবন্দর, ব্যাংক, বিদ্যুৎ ও গ্যাস অফিস, রেলওয়ে স্টেশনসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সেবা প্রদান করার জন্য সীমিত ইন্টারনেট অ্যাকসেস দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। আইএসপিরা তাদের নিজ নিজ আইআইজির সঙ্গে সমন্বয় করে এ সেবা প্রদান করতে থাকেন, যার ফলে কিছু এলাকায় ন্যূনতম ইন্টারনেট অ্যাকসেস পুনরুদ্ধার হয়। পরদিন ২৪ জুলাই বিটিআরসি আইআইজি অপারেটরদের ইন্টারনেট সেবা পুনরুদ্ধারের নির্দেশ দেয়, তবে ইউটিউব, ফেসবুক এবং টিকটকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফরমগুলো বাদ রাখা হয়। পরদিন ইউটিউব অ্যাকসেস পুনরায় চালু করা হয়। ২৮ জুলাইয়ের মধ্যে মোবাইল ইন্টারনেট সেবা সম্পূর্ণরূপে পুনরুদ্ধার হয় এবং বিটিআরসির নির্দেশনায় ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে ব্রডব্যান্ড সেবা, যার মধ্যে সব সমাজমাধ্যম অন্তর্ভুক্ত ছিল, আইআইজি অপারেটরদের মাধ্যমে পুনরায় চালু হয়। এরপর তৎকালীন সরকারের ওই দুই কর্মকর্তার নির্দেশে মোবাইল অপারেটররা আবারও ইন্টারনেট সেবা স্থগিত করেন। তবে আইএসপিদের ইন্টারনেট সেবা সীমিত আকারে চালু ছিল। এর পরের দিন ৫ আগস্ট সকালে বিটিআরসির নির্দেশে আইটিসি এবং আইআইজি অপারেটরদের মাধ্যমে ব্রডব্যান্ড সেবাও বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে কিছুক্ষণ পরই তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হলে বিকালের মধ্যে সমস্ত ইন্টারনেট সেবা পুনরুদ্ধার করা হয়।
ইন্টারনেট বন্ধের এ ঘটনাক্রম পর্যালোচনায় স্পষ্ট হয় যে, বাংলাদেশে সরকার যে কোনো সময় ইন্টারনেট বন্ধের পদক্ষেপ নিতে পারে তার আইনি কাঠামো এখনো বিদ্যমান আছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, যেহেতু সরকার বিভিন্ন খাতে সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করছে, তাই ইন্টারনেট শাটডাউনসংক্রান্ত বিদ্যমান আইনগুলো পুনর্মূল্যায়ন করা অত্যন্ত জরুরি। এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ও স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন অফিসার তানভীর হাসান জোহা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘গণহত্যা নিয়ে একটি মামলা ট্রাইব্যুনালে চলছে। ওই মামলায় ইন্টারনেট বন্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্ট। এ বিষয়ে সরকারকে প্রয়োজনীয় নীতিমালা এবং বিদ্যমান আইনে যেসব ফাঁকফোকর আছে সেসব বিষয়ে অবহিত করব। ইন্টারনেট বন্ধের কারণে আমাদের ব্যক্তিগত যেসব সমস্যা হয়েছে তার বাইরে ইন্টারনেটভিত্তিক ফ্রিল্যান্সিং ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের বেশির ভাগ গ্রাহক চলে গেছেন ফিলিপাইন ও চীনে। এটা অনেক বড় ক্ষতি।’