মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ পাওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছেন। তাঁর সেই আগ্রহের সূত্র ধরে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি জানিয়েছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে খনিজ সম্পদ দিতে রাজি। তবে বিনিময়ে ওয়াশিংটনকে ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশনায় রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধেও রাজি।
গত শুক্রবার (৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫) রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জেলেনস্কি ইউক্রেনের একটি গোপন মানচিত্রের ওপর দৃষ্টিপাত করেন, যেখানে ইউক্রেনের বিরল মৃত্তিকা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খনিজের বিশাল মজুত চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, জেলেনস্কির এই প্রচেষ্টা মূলত ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যবসায়িক মনোভাবকে আকর্ষণ করার লক্ষ্যে।
মার্কিন প্রশাসনের যুদ্ধ সমাপ্তির উদ্যোগ
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ দ্রুত সমাপ্তির জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। গত সপ্তাহে এক বক্তব্যে ট্রাম্প বলেন, তিনি চান ইউক্রেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিরল মৃত্তিকা এবং অন্যান্য খনিজ সরবরাহ করুক। বিনিময়ে ওয়াশিংটন ইউক্রেনের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে আর্থিকভাবে সহায়তা করবে।
এই প্রসঙ্গে জেলেনস্কি বলেন, ‘যদি আমরা চুক্তি নিয়ে কথা বলি, তাহলে চলুন একটি চুক্তি করি, আমরা এর পক্ষে।’ তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, যেকোনো সমঝোতার অংশ হিসেবে ইউক্রেনের নিরাপত্তা গ্যারান্টি নিশ্চিত করতে হবে।
ইউক্রেনের খনিজ সম্পদের গুরুত্ব
ইউক্রেনের খনিজ সম্পদগুলোর ২০ শতাংশের কম বর্তমানে রাশিয়ার দখলে রয়েছে। বিরল মৃত্তিকা খনিজগুলো উচ্চ শক্তির চৌম্বক, বৈদ্যুতিক মোটর এবং দৈনন্দিন ব্যবহার্য ইলেকট্রনিকসের উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ। জেলেনস্কি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, মস্কো এই খনিজগুলো তার মিত্র উত্তর কোরিয়া এবং ইরানকে দিতে পারে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের পুতিনকে থামাতে হবে এবং যা আমাদের কাছে আছে, তা রক্ষা করতে হবে। বিশেষ করে মধ্য ইউক্রেনের দিনিপ্রো অঞ্চল খুবই সমৃদ্ধ। এই অঞ্চলকে রক্ষা করতে হবে।’
রাশিয়ার সামরিক অগ্রগতি ও ইউক্রেনের চ্যালেঞ্জ
এদিকে, রাশিয়ার সেনারা কয়েক মাস ধরে ইউক্রেনের পূর্ব দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং ব্যাপক গোলাবারুদের সহায়তায় নিরলস আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। কিয়েভের সীমিত সৈন্য সংখ্যা এবং অস্ত্র সরবরাহের অনিশ্চয়তা তাদের চাপের মুখে ফেলছে।
সাক্ষাৎকারে জেলেনস্কি কিয়েভের প্রেসিডেন্ট অফিসে একটি টেবিলের ওপর একটি মানচিত্র মেলে ধরেন, যেখানে অনেকগুলো খনিজ মজুত দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে বিস্তৃত পূর্ব ইউক্রেনে বিরল মৃত্তিকা ধাতুর মজুত রয়েছে, যার প্রায় অর্ধেকই বর্তমানে রাশিয়ার দখলে।
তিনি আরও দাবি করেন, ‘ইউক্রেনে ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাইটানিয়াম মজুত রয়েছে। এই টাইটানিয়াম বিমান ও মহাকাশ শিল্পে অপরিহার্য। এ ছাড়া পারমাণবিক শক্তি ও অস্ত্র উৎপাদনে ব্যবহৃত ইউরেনিয়ামেরও বিশাল মজুত আছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অংশীদারত্বের পরিকল্পনা
ইউক্রেন দ্রুত পররাষ্ট্রনীতি পুনর্নির্ধারণ করেছে, যাতে দেশটি মার্কিন প্রেসিডেন্টের ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সংগতি বজায় রাখতে পারে। তবে জেলেনস্কি জোর দিয়ে বলেন, ‘কিয়েভ তার সম্পদ অন্যকে দিয়ে দেবে’—এমন কোনো প্রস্তাবনা দেয়নি, বরং একটি পারস্পরিক সুবিধাজনক অংশীদারত্বের প্রস্তাব দিচ্ছে, যাতে এই সম্পদগুলোকে যৌথভাবে ব্যবহার করা যায়।
তিনি আরও বলেন, ‘আমেরিকানরা সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে এবং তাই আমেরিকানদের সবচেয়ে বেশি উপার্জন করা উচিত এই খাত থেকে। তাদের এই অগ্রাধিকার থাকতে হবে এবং তা থাকবে। আমি এই বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা করতে চাই।’
জেলেনস্কি আরও জানান, ‘কিয়েভ এবং হোয়াইট হাউস ইউক্রেনের বিশাল ভূগর্ভস্থ গ্যাস স্টোরেজ সাইটগুলো ব্যবহার করে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সংরক্ষণের বিষয়ে আলোচনা করছে।’
শান্তি আলোচনা ও ট্রাম্পের মধ্যস্থতা
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হওয়ার আগেই জেলেনস্কি ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। আগামী ১৪-১৬ ফেব্রুয়ারি মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে পশ্চিমা দেশগুলোর কর্মকর্তারা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করবেন।
জেলেনস্কি জানান, তিনি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করবেন। এই সম্মেলনে ট্রাম্পের বিশেষ দূত কিথ কেলোগও উপস্থিত থাকবেন।
তিনি আরও বলেন, ‘ট্রাম্পের সঙ্গে আমার সরাসরি সাক্ষাৎ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তাঁর সঙ্গে বৈঠকের আগে ট্রাম্প রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করবেন। অন্যথায় এটি ইউক্রেন ছাড়া ইউক্রেন সম্পর্কে একটি সংলাপ হয়ে যাবে।’
ট্রাম্প শুক্রবার (৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫) জানান, তিনি আশা করছেন যে, পরবর্তী সপ্তাহে জেলেনস্কির সঙ্গে কথা বলবেন।
সূত্র: রয়টার্স
বিডি প্রতিদিন/আশিক