অসম্মান ও লাঞ্ছনা ইহকালীন জীবনে হোক বা পরকালীন জীবনে হোক তা কারো কাম্য নয়। কিন্তু তার পরও সমাজে বহু মানুষকে লাঞ্ছনার জীবন কাটাতে দেখা যায়। এমন জীবনের মুখোমুখি হওয়ার হয়তো বাহ্যিক অনেক কারণ থাকে। তবে এর প্রকৃত কারণ পাপ ও মন্দ কাজে লিপ্ত হওয়া।
আল্লামা ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, ‘আরেফরা (যারা আল্লাহর পরিচয় লাভ করেছে) এ বিষয়ে একমত যে প্রত্যেক কল্যাণের মূল হলো আল্লাহ কর্তৃক বান্দাকে ভালো কাজের সুযোগ দেওয়া। আর প্রতিটি অকল্যাণের মূল হলো আল্লাহ কর্তৃক বান্দাকে লাঞ্ছিত করা।’
(ফি রিহাবিত তাফসির, পৃষ্ঠা-৩৭০২)
লাঞ্ছিত হওয়ার অর্থ
আরবি ভাষায় অপমান ও লাঞ্ছিত হওয়া বোঝাতে ‘খাসলান’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। ইমাম রাগেব ইস্পাহানি (রহ.) বলেন, খাসলান হলো এমন ব্যক্তি কর্তৃক পরিত্যক্ত হওয়া, যার কাছ থেকে সাহায্য পাওয়া যাবে বলে ধারণা করা হয়েছিল।
ইমাম নববী (রহ.) বলেন, খাসলুন হলো সাহায্য-সহযোগিতা ছেড়ে দেওয়া।
(আল মুফরাদাত, পৃষ্ঠা-২২৭;
শরহুল মুসলিম : ১৬-১২০)
লাঞ্ছিত হওয়ার কারণ
কোরআন ও হাদিসের আলোকে পার্থিব জীবনে লাঞ্ছিত হওয়ার কয়েকটি কারণ তুলে ধরা হলো—
১. শিরক করা : আল্লাহর সঙ্গে প্রকাশ্যে বা গোপনে শিরক করলে আল্লাহ পার্থিব জীবনে তাঁকে অপদস্থ করেন। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে অপর কোনো ইলাহ সাব্যস্ত কোরো না, করলে নিন্দিত ও লাঞ্ছিত হয়ে পড়বে।’
(সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ২২)
২. শয়তানের আনুগত্য করা : শয়তান মানুষের চিরশত্রু। সে মানুষকে দুনিয়া ও আখিরাতে অপদস্থ ও লাঞ্ছিত করতে চায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমাকে সে বিভ্রান্ত করেছিল আমার কাছে উপদেশ আসার পর। শয়তান মানুষের জন্য লাঞ্ছনাকারী।’ (সুরা : ফোরকান, আয়াত : ২৯)
৩. অত্যাচারীর আনুগত্য করা : অত্যাচারীর আনুগত্য মানুষকে পার্থিব জীবনে লাঞ্ছিত করে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা সীমা লঙ্ঘন করেছে তোমরা তাদের প্রতি ঝুঁকে পোড়ো না; পড়লে আগুন তোমাদের স্পর্শ করবে। এ অবস্থায় আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কোনো অভিভাবক থাকবে না এবং তোমাদের সাহায্য করা হবে না।’ (সুরা : হুদ, আয়াত : ১১৩)
৪. ভ্রাতৃত্ব রক্ষা না করা : যারা পৃথিবীতে সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ব রক্ষা করে চলে না, তারা পৃথিবীতে লাঞ্ছিত হয়। জ্ঞানীরা বলেন, ‘যে তিনটি বিষয়ে যত্নবান নয়, সে ছয়টি পরীক্ষার মধ্যে পড়ে। যে ভ্রাতৃত্ব রক্ষা করে না সে শত্রু ও অসম্মানের শিকার হয়। যে সুস্থতা ও নিরাপত্তার প্রতি যত্নশীল নয়, সে কঠিন পরিস্থিতি ও নানা পরীক্ষার মুখোমুখি হয়। যে ভালো কাজের প্রতি যত্নবান নয়, সে লজ্জা ও ক্ষতির শিকার হয়।’ (আদাবুদ দুনিয়া ওয়াদ দ্বিন, পৃষ্ঠা-১২৪)
৫. পার্থিব জীবনের মোহ : মহানবী (সা.) বলেন, “খাদ্য গ্রহণকারীরা যেভাবে খাবারের পাত্রের চতুর্দিকে একত্র হয়, অচিরেই বিজাতিরা তোমাদের বিরুদ্ধে সেভাবেই একত্র হবে। এক ব্যক্তি বলল, সেদিন আমাদের সংখ্যা কম হওয়ার কারণে কি এরূপ হবে? তিনি বললেন, তোমরা বরং সেদিন সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে; কিন্তু তোমরা হবে প্লাবনের স্রোতে ভেসে যাওয়া আবর্জনার মতো। আর আল্লাহ তোমাদের শত্রুদের অন্তর থেকে তোমাদের পক্ষ থেকে আতঙ্ক দূর করে দেবেন, তিনি তোমাদের অন্তরে ‘ওয়াহান’ ভরে দেবেন। এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! ‘ওয়াহান’ কী? তিনি বললেন, দুনিয়ার মোহ এবং মৃত্যুকে অপছন্দ করা।” (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৪২৯৭)
৬. ভুল সিদ্ধান্ত : ভুল সিদ্ধান্তের কারণে মানুষ লাঞ্ছিত হয়। আল্লামা ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, সঠিক সিদ্ধান্ত সাহসিকতার রেণুর মতো। যখন উভয়ের পরাগায়ণ হয়, তখন সাহায্য ও সাহস বৃদ্ধি পায়। যখন উভয়ের সাক্ষাৎ হয় না, তখন অপমান ও পরাজয় ভর করে। (আল ফাওয়ায়িদ, পৃষ্ঠা-২৯০)
৭. ভাগ্য অস্বীকার করা : যে ব্যক্তি ভাগ্যে বিশ্বাস করে না, আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত বিষয়ের বিরুদ্ধাচরণ করতে চায় এবং গায়ের জোরে সব উল্টে দিতে চায় তারা পৃথিবীতে লাঞ্ছিত হয়। ইমাম মাওয়ার্দি (রহ.) বলেন, ভাগ্য অস্বীকারকারী ও বিরোধিতাকারী অপদস্থ হয়। (তাসহিলুন নজর, পৃষ্ঠা-৭৮)
লাঞ্ছনা থেকে মুক্তির উপায়
পার্থিব জীবনে অসম্মান ও লাঞ্ছনার হাত থেকে বাঁচার উপায় হলো আল্লাহমুখী হওয়া এবং তাঁর দ্বিন মেনে চলা। কেননা সম্মান ও অসম্মান মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করলে তোমাদের ওপর জয়ী হওয়ার কেউ থাকবে না। আর তিনি তোমাদের পরিত্যাগ তথা সাহায্য না করলে তিনি ছাড়া কে এমন আছে, যে তোমাদেরকে সাহায্য করবে? মুমিনরা আল্লাহরই ওপর নির্ভর করুক।’
(সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৬০)
আল্লাহ সবাইকে লাঞ্ছনার জীবন থেকে রক্ষা করুন। আমিন।
বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ