বিষমুক্ত সবজি চাষ করে একজন আদর্শ কৃষক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন নিজেকে। সবজিকে বিষমুক্ত করতে আবিষ্কার করেছেন ভেষজ কীটনাশক। তাকে এখন অনুসরণ করছেন আশপাশের গ্রামসহ বিভিন্ন জেলার কৃষকরা। নিচ্ছেন পরামর্শ ও সহযোগিতা। দুই দশকেরও বেশি সময় সবজি চাষ করে নিজেকে স্বাবলম্বী করেছেন। একাধিকবার উপজেলা ও জেলার শ্রেষ্ঠ আদর্শ কৃষক হিসেবে হয়েছেন পুরস্কৃত। এতক্ষণ যার কথা বলছিলাম তিনি হলেন আকলু মিয়া চৌধুরী। বাড়ি মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার সদর ইউনিয়নের কর্ণিগ্রামে। ৪৫ বছর বয়সী আকলু মিয়া দুই দশক ধরে নিজের বাড়ির পাশের জমিতে সবজি চাষ করে আসছেন। গত কয়েক বছরে তিনি একজন আলোকিত সবজিচাষি হিসেবে নিজেকে পরিচিত করে তুলেছেন। নিজের সাফল্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে আকলু মিয়া বলেন, ১৯৯১ সালে শখের বশে ১৫ শতক জমিতে দেশি জাতের টমেটো চাষ করেন। আশানুরূপ ফলন হওয়ায় উৎসাহিত হয়ে ওঠেন। পরের বছর ১৯৯২ সালে রবিশস্য মৌসুমে রাজনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শে এক বিঘা জমিতে দেশি জাতের টমেটো রতন, মানিক ও পোষা চাষ করেন। এ থেকে তার আয় হয় প্রায় ২০ হাজার টাকা। ১৯৯৩ সালে তার শখ পরিণত হয় নেশায়। ওই বছর টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, আলু, ক্ষেতলাউ, মিষ্টিকুমড়া, ঢেঁড়স, ফরাশ, বেগুন, বরবটি, শিম, শসাসহ বিভিন্ন জাতের সবজি চাষ করেন। আকলু মিয়া বলেন, 'এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। শখ থেকে নেশা, অতঃপর পেশায় পরিণত হয় সবজি চাষ। ১৯৯৫ সালে মৌলভীবাজার জেলা সদরে কর্মরত উদ্ভিদ-বিশেষজ্ঞ মো. শাহজাদার উৎসাহ ও পরামর্শে টমেটো গাছে বাঁশের খুঁটি বা মাচার প্রচলন শুরু করি।' তিনি বলেন, '১৯৯৬ সাল থেকে শুরু করি বাণিজ্যিকভাবে উচ্চ ফলনশীল সব ধরনের সবজির উৎপাদন।' সাফল্যের পেছনে জেলা ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের সর্বাত্দক সহযোগিতা এবং স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণের কথা বলেন আকলু মিয়া। সফল এই কৃষক জানান, নিজস্ব জমি, নানা উপকরণ ও সেচসুবিধা নাগালের মধ্যে থাকায় তাকে কোনো অসুবিধায় পড়তে হয় না। শ্রমিকদের পাশাপাশি তিনি সার্বক্ষণিক সময় দেন সবজি বাগানে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে পাঁচ বিঘা জমিতে উচ্চ ফলনশীল কিং, লাভলি, যমুনা ও ইপক, এক বিঘা জমিতে হোয়াইট এঙ্লে ফুলকপি, এক বিঘায় বাঁধাকপি ও ২৫ শতক জমিতে স্থানীয় জাতের লম্বা বেগুন, ২৫ শতকে ডায়মন্ড আলু, ২০ শতকে মিষ্টিলাউ ও এক বিঘা জমিতে ঝিঙা, বরবটি, শিম, শসাসহ অন্যান্য ফসল চাষ করেন। এ জন্য তার ব্যয় হয় মাত্র এক লাখ ৮৬ হাজার টাকা। আর আয় হয় ১১ লক্ষাধিক টাকা! এ বছর গেল মৌসুমে তিনি প্রায় ১০ বিঘা জমিতে বিভিন্ন জাতের সবজি চাষ করেন, যাতে তার উৎপাদন খরচ ছিল এক লাখ ৯২ হাজার টাকা। আর এ থেকে তিনি সবজি বিক্রি করেছেন ১৬ লাখ টাকার। আকলু মিয়া জানান, তার এ সবজি চাষে অভাবনীয় সাফল্য আসায় এখন আশপাশের গ্রামের অনেকেই তাকে অনুসরণ করছেন। প্রতি বছর সবজি চাষের মৌসুমের শুরুতেই উপজেলার বিভিন্ন এলাকার কৃষকরা তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সহযোগিতা ও পরামর্শ নেন। আকলু মিয়া বলেন, তাকে অনুসরণ করে অন্যরা যখন সফলতা পান, তখন বেশ আনন্দ লাগে। এই কৃষক জানান, তার উৎপাদিত সবজি বিষমুক্ত হওয়ায় মৌলভীবাজারের বিভিন্ন উপজেলার হাট-বাজারসহ পাশের সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জের হাট-বাজারে তার উৎপাদিত সবজি বিক্রি হয়। চাহিদাও ব্যাপক।
আকলু বলেন, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রকল্পের কর্মকর্তারা প্রতি বছরই তার সবজি বাগানগুলো পরিদর্শনে আসেন। বিশেষ করে তার উদ্ভাবিত জৈব কীটনাশকের আবিষ্কার ও ব্যবহারে মুগ্ধ হন সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তারা। গবেষক ও কর্মকর্তারা বলেন, তার উদ্ভাবিত জৈব কীটনাশকের শতকরা ৯০ ভাগ কার্যকর।
নেপথ্যে নিজ উদ্ভাবিত ভেষজ কীটনাশক : বিষমুক্ত সবজি চাষে আকলু মিয়ার এ সাফল্যের নেপথ্য তারই উদ্ভাবিত ভেষজ কীটনাশকের ব্যবহার। তিনি এ কীটনাশক তৈরি করেন মেহগনি গাছের ফল থেকে। এ কারণেই তিনি একাধিকবার উপজেলার শ্রেষ্ঠ সবজিচাষি হিসেবে পুরস্কার জিতেছেন। আকলু মিয়া জানান, তার নিজের গ্রাম কর্ণিগ্রাম, পাশের ক্ষেমসহস্র, পার্শ্বিপাড়া, বাজুয়া, রাজনগর, মজিদপুরসহ আশপাশ এলাকায় বহুকাল ধরে বিভিন্ন সবজির চাষ হয়ে আসছে। কিন্তু রোগ-বালাই ও ছত্রাকের আক্রমণে এলাকার ৭০ ভাগ ফসলই প্রায় সময় নষ্ট হয়ে যেত। এ অবস্থায় তিনি দীর্ঘদিন নিমপাতা, আতাফলের পাতা, বাটীগাছের ফল, তামাকপাতা ও মেহগনি গাছের ফলের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা করতে থাকেন। সাফল্য মেলে ২০০২ সালে। মেহগনি গাছের ফল থেকে তৈরি করতে সক্ষম হন ভেষজ কীটনাশক। ওই বছরই প্রাথমিকভাবে ১৫ শতক জমিতে লাগানো টমেটোর ওপর পরীক্ষামূলকভাবে মেহগনির তৈরি কীটনাশক ব্যবহার শুরু করেন। এতে পোকামাকড় দমনে ব্যাপক সাফল্য পান আকলু।
যেভাবে তৈরি ভেষজ কীটনাশক : আকলু মিয়া দেশের অন্যান্য অঞ্চলের কৃষকদের জন্য মেহগনির ফল থেকে ভেষজ তৈরির টিপস দিয়েছেন। বলেছেন, পরিবেশবান্ধব এই ভেষজ কীটনাশক তৈরির জন্য এক কেজি ফল সংগ্রহ করে কেটে কুচি কুচি করে বা পিষে (বাটা) একটি পাত্রে পাঁচ লিটার পানির সঙ্গে ভিজিয়ে রাখতে হবে। চার-পাঁচ দিন পর এটি তুলে ভালোভাবে সুতিকাপড় দিয়ে ছেঁকে নিতে হবে। প্রাপ্ত পানির নির্যাসই হচ্ছে কীটনাশক। এ নির্যাসের সঙ্গে ২০ গ্রাম সাবান বা ডিটারজেন্টের পানি এবং পাঁচ গ্রাম সোহাগা মিশিয়ে ২০-২৫ মিনিট আগুনের তাপে ফুটিয়ে নিতে হবে। তারপর তা হবে পোকামাকড় প্রতিরোধ ও প্রতিকারে ব্যবহার-উপযোগী মেহগনি জৈব কীটনাশক। এ নির্যাস ঠাণ্ডা হলে এতে পাঁচ গুণ পরিমাণ পানি মিশিয়ে ব্যবহার করা যাবে।
এ কীটনাশক ব্যবহারে ধানের মাজরা পোকা, পাতামোড়া রোগ, বাদামি গাছ, ফড়িং, জাব পোকা, পাতা ছিদ্রকারী পোকা দমনে ভালো ফল পাওয়া যায়। সবজিতে পোকামাকড় দমনসহ ছত্রাক নাশ ও নানা রোগব্যাধি দূর করে। এটি ভালো জৈব সার হিসেবেও কাজ করে, যা বাজারে পাওয়া ইউরিয়ার চেয়ে বেশি কার্যকর।
আকলু মিয়া জানান, ২০১২-১৩ অর্থবছরে কৃষিক্ষেত্রে জেলা ও জাতীয় পর্যায়ে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে 'ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল অধিদফতর (ডিএই)' খামারবাড়ী, ঢাকার ব্যবস্থাপনায় ২০১৩ সালের মার্চে কৃষিতে আধুনিক ও উচ্চতর প্রযুক্তির প্রশিক্ষণের জন্য তাকে থাইল্যান্ডে পাঠানো হয়। ২০১৩ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কারের জন্য মৌলভীবাজার জেলা তথা সিলেট বিভাগের শ্রেষ্ঠ সবজিচাষি হিসেবে আকলু মিয়াকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল।