রশিদুল ইসলাম। বাড়ি নীলফামারীতে। একটি ওয়ারেন্ট হাতে নিয়ে স্থানীয় থানা পুলিশ যায় তার বাসায় তাকে গ্রেফতার করতে। হঠাৎ করেই পুলিশ আসার কারণ জানতে চেয়ে অবাক হন তিনি নিজেও। রশিদুল ইসলামকে পুলিশ সদস্যরা জানান, তার নামে ঢাকার সিএমএম আদালত থেকে ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়েছে। অথচ রশিদুলের নামে কোনো মামলাই নেই। তিনি পুলিশকে জানান, তার নামে একটি এনআই অ্যাক্টের মামলা ছিল। বাদী প্রত্যাহার করায় সেটি আগেই নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। পরে এ-সংক্রান্ত পরোয়ানা ফেরতের কাগজপত্র পুলিশকে দেখিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি। তাকে টেনেহিঁচড়ে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পুলিশ।
পরদিন রশিদুলকে নীলফামারীর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। আইনজীবী রশিদুল নিরপরাধ উল্লেখ করে তার জামিন আবেদন করেন। পরোয়ানা ফেরত সংক্রান্ত সব কাগজপত্র আদালতে দাখিল করেন। তবে মামলার নম্বর ঠিক না থাকায় বিচারক জানান, মামলার নম্বর এক নয়। তাকে আর একটি মামলায় ওয়ারেন্ট দেওয়া হয়েছে। পরে জামিন নামঞ্জুর হলে রশিদুলকে কারাগারে যেতে হয়। রশিদুলের স্বজনরা ঢাকা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মঞ্জুরুল ইসলাম সুমনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি জুনিয়রদের বিষয়টি খোঁজ নিতে বলেন। যোগাযোগ করা হলে ঢাকা মহানগরের ২১ নম্বর আদালতের পেশকার এ ওয়ারেন্ট বিষয়ে কোনো ধরনের তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানান। মামলার নথি দেখাতেও তিনি টালবাহানা করতে থাকেন। পরে আইনজীবী নিজে আসেন। মামলার নথি পাওয়ার পর দেখা যায়, যে মামলায় রশিদুলকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাতে তার নামই নেই। এরপর আইনজীবীরা রশিদুলের রিলিজ অর্ডার ছাড়তে বলেন। তা না হলে ভুয়া ওয়ারেন্টের বিষয়ে সিএমএম কোর্টে অভিযোগের কথা জানান। এরপর ডাক মারফত রিলিজ অর্ডার পাঠানো হয়। এরই মধ্যে বিনা অপরাধে রশিদুল ইসলামের ১২ দিন জেলে থাকা হয়ে গেছে। এ বিষয়ে আইনজীবী মঞ্জুরুল ইসলাম সুমন বলেন, ‘রশিদুল এলাকার সম্মানিত ব্যক্তি। ভুয়া ওয়ারেন্টে ১২ দিন জেলে তিনি। সামাজিকভাবে হেয় হলেন, এর দায় কে নেবে?’ সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব ভুয়া ওয়ারেন্ট নিয়ে কোর্ট এলাকায় একটি চক্র সক্রিয় রয়েছে। শুধু রশিদুল নন, তাদের ফাঁদে পড়ে জেল খেটেছেন কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের দক্ষিণপাড়া বালিয়ারদী সরকার বাড়ির কাঞ্চন মিয়া। ঢাকার সিজেএম আদালত থেকে তার নামেও ভুয়া ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হয়। এরপর আদালতে হাজির করা হলে কাঞ্চন মিয়াকে কারাগারে পাঠায় কিশোরগঞ্জের দুই নম্বর জিআর আদালত। পরে তার জামিনের জন্য স্বজনরা ঢাকায় এসে দালালের খপ্পরে পড়েন। কোর্টের দালাল কাঞ্চন মিয়ার স্বজনদের আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তার (এও) কাছে নিয়ে যান। তাদের জানানো হয়, এটা অনেক কঠিন কাজ। তারপরও ব্যবস্থা করা যাবে। কিন্তু জামিনের জন্য ১৫ হাজার টাকা লাগবে। এরপর কাঞ্চন মিয়ার স্বজনরা নগদ ৪ হাজার টাকা দেন। পরে আদালতে শুনানির সময় তারা জানতে পারেন, এটা ভুয়া ওয়ারেন্ট এবং সঙ্গে সঙ্গে জামিন দেন বিচারক। এরপরও দালাল চক্রটি কাঞ্চন মিয়ার পরিবারকে ছাড়েনি। বাকি ১১ হাজার টাকা না দিলে জামিনের কাগজপত্র দিতে অস্বীকৃতি জানান। এক পর্যায়ে তারা লোকজন ডাকাডাকি শুরু করলে জামিনের কাগজসহ এবং সেই ৪ হাজার টাকা ফেরত দেওয়া হয়। পরে ভুক্তভোগী কাঞ্চন মিয়া সুপ্রিম কোটের রেজিস্ট্রার, আইন সচিব, ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এবং ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগ এলেও এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। এ বিষয়ে ঢাকার দ্রুত বিচার আদালতের পিপি আবু আবদুল্লাহ ভূইয়া বলেন, ‘নিরীহ লোকদের বিনা অপরাধে হয়রানি-মানহানি করতে একটি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র তৎপর রয়েছে। তারাই ভুয়া ওয়ারেন্ট ইস্যু করছে। ভুয়া ওয়ারেন্টের বিষয়ে তদন্ত করে অপরাধীদের শনাক্ত এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি বলে তিনি জানান।