বুধবার, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

অনলাইন নয় অফলাইন

মির্জা মেহেদী তমাল

অনলাইন নয় অফলাইন

মোস্তাফা হাসান ব্যবসা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত থাকেন। পরিবারকে সময় দেওয়ার সময়টুকু তিনি কম পান। সেই যে এক বছর আগে স্ত্রী ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ঢাকার বাইরে বেড়াতে গিয়েছিলেন, এরপর আর যাওয়া হয়নি। এ নিয়ে মাঝে মধ্যেই স্ত্রী ছেলে-মেয়ে মন খারাপ করে মোস্তাফা হাসানের সঙ্গে। ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা শেষ। তারা এবার তাদের বাবাকে বললেন, ঢাকার বাইরে বেড়াতে যাবে। কোনোভাবেই এড়াতে পারলেন না মোস্তাফা হাসান। বললেন, ঠিক আছে, এবার আমরা কক্সবাজার বেড়াতে যাব। ভীষণ খুশি তার স্কুলপড়ুয়া ছেলে-মেয়ে। রাজি হওয়ার পর থেকেই তারা গোছগাছ করতে শুরু করেছেন। মোস্তাফা হাসানের স্ত্রীও খুশি। অনেকদিন পর তারা এক সঙ্গে একটু বাইরে বেড়াতে যাবেন।

কিন্তু সমস্যা হলো টিকিট কেনার সময় বের করতে পারছেন না মোস্তাফা হাসান। আকাশপথে বেড়াতে যাওয়ার মতো আর্থিক অবস্থা তাদের নেই। যে টাকা আকাশপথের টিকিটে খরচ হবে, সেই টাকায় তারা ঘোরার অর্ধেক খরচ মেটাতে পারবে। এসব চিন্তা-ভাবনায় তারা ঢাকা থেকে ট্রেনে চট্টগ্রাম এবং সেখান থেকে বাসে কক্সবাজার যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। মোস্তাফা তার স্ত্রীকে টাকা দিয়ে বললেন, তিনি যেন ট্রেনের টিকিট কিনে নিয়ে আসেন। সে মতে স্টেশনে গিয়ে টিকিটের খোঁজ করলেন। কিন্তু হায়! টিকিট নেই। নির্ধারিত তারিখের কোনো টিকিট তিনি পেলেন না। ছুটির এই সময়ে সবাই যাচ্ছে ঘুরতে। এ সময় একটু ভিড় বেশি। তাদের ধারণা ছিল না। মন খারাপ করে ফিরে আসলেন মিসেস মোস্তাফা।

এসব শুনে মোস্তাফা হাসান এবার বাসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এ সময় তাদের বড় ছেলে কামরান তার বাবাকে বললেন, আব্বু অনলাইনে বাসের টিকিট পাওয়া যায়। সেখান থেকেও টিকিট কিনতে পারি। কোনো ঝক্কি-ঝামেলা নেই। এ কথা শুনে মোস্তাফা হাসানের মন ভালো হয়ে গেল। তিনি তার ছেলেকে এ বিষয়ে খোঁঝখবর নিতে বললেন। কামরান তার বাবাকে ফেসবুকে এ সম্পর্কে একটি পেজ দেখালেন। তাতে লেখা রয়েছে, এখন আর কষ্ট করে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটার দিন শেষ। ঘরে বসেই পাচ্ছেন স্বনামধন্য বিভিন্ন কোম্পানির বাসের টিকিট।

খুশিতে আত্মহারা হয়ে ওঠে পুরো পরিবার। ছেলে-মেয়েরা ভাবছিলেন, ট্রেনের টিকিট পাওয়া যায়নি বলে, তাদের বাবা আবার ট্রিপ বাতিল করে দেয় নাকি। সেটি আর হচ্ছে না বলে আবারও খুশিতে তারা আত্মহারা। ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে যোগাযোগ করে মোস্তাফা হাসান কেটে ফেলেন পুরো পরিবারের ভ্রমণ টিকিট। বিকাশের মাধ্যমে পরিশোধ করেন ভাড়ার পুরো টাকা। এরপর আসে কক্সবাজার যাত্রার সেই কাক্সিক্ষত দিন। পুরো পরিবার চার দিনের প্রস্তুতি নিয়ে পান্থপথে একটি বাস কাউন্টারে গিয়ে হাজির। যেন মাথায় বাজ পড়ে মোস্তাফা হাসানের। তার নামে কোনো টিকিটই বরাদ্দ নেই! অনলাইনে তিনি যে টিকিট কিনেছেন, তার পুরোটাই ভুয়া। মন খারাপ করে পুরা পরিবার ফিরে যান বাসায়। বাতিল হয়ে যায় তার সেই আনন্দ ভ্রমণ। ‘এখন আর কষ্ট করে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটার দিন শেষ। ঘরে বসেই পাচ্ছেন স্বনামধন্য বিভিন্ন কোম্পানির বাসের টিকিট। ঘরে বসে ফেসবুকেই যদি পাওয়া যায় কাক্সিক্ষত টিকিট, তাহলে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে, রোদ-ঝড়- বৃষ্টি উপেক্ষা করে কেন কাউন্টারে গিয়ে টিকিট কাটবেন?’- এমন বিজ্ঞাপন দেখে শুধু মোস্তাফা হাসানই নন, অনলাইনে টিকিট কেটে প্রতারিত হচ্ছেন হাজারো মানুষ। এমন আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপনে সাত-পাঁচ না ভেবেই ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে যোগাযোগ করে কেটে ফেলেন ভ্রমণ টিকিট। টিকিটের পুরো টাকাও পরিশোধ করেন বিকাশ বা রকেটের মাধ্যমে। এরপর আসে যাত্রার সেই কাক্সিক্ষত দিন। কাউন্টারে গিয়ে তারা দেখতে পান তাদের নামে কোনো টিকিট কাটা নেই। ব্যস মাথায় হাত! বুঝতে আর বাকি নেই অনলাইনে টিকিট কিনে তারা প্রতারিত হয়েছেন।

রিটায়ার্ড সরকারি কর্মকর্তা আবদুস সালাম সাহেবও এই প্রতারকদের হাত থেকে রেহায় পেলেন না! সদ্য বিবাহিত মেয়ে ও মেয়ের জামাইকে হানিমুনে পাঠাবেন দার্জিলিং। অনলাইনে বিভিন্ন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের অফার ও অ্যাড দেখে অনলাইনে যোগাযোগ করলেন একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। দুজনের দার্জিলিং ট্যুরের জন্য ধার্যকৃত ফির এক- তৃতীয়াংশ বিকাশের মাধ্যমে পরিশোধের পর বাকি টাকা ও পাসপোর্টসহ সালাম সাহেব, তার মেয়ে ও মেয়ের জামাইকে ডাকা হলো ঢাকার একটি ঠিকানায়। নির্ধারিত দিনে আবদুস সালাম ওই ঠিকানায় উপস্থিত হয়ে খুঁজে পেলেন সেই ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস প্রতিষ্ঠান। তবে সেখান থেকে জানানো হলো, আবদুস সালাম তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি বা বিকাশে অর্থ গ্রহণের কোনো সিস্টেম তাদের প্রতিষ্ঠানে নেই। যে বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠিয়েছেন আবদুস সালাম সেটা তো তাদের নয়ই বরং বিকাশ নম্বরটিও বন্ধ। পাশাপাশি যে ফেসবুক পেজে যোগাযোগ করেছিলেন সেটাও আর খুঁজে পাওয়া গেল না। বুঝতে আর বাকি রইল না, অনলাইনে প্রতারকের খপ্পরে পড়েছেন তিনি।

পুলিশ বলছে, কর্মব্যস্ত মানুষ খুব সহজেই আকৃষ্ট হতো অনলাইনে প্রতারক চক্রের এসব চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে। বিকাশ রকেটে টাকা দিয়ে কেটেও ফেলতেন ভুয়া টিকিট। অসংখ্য মানুষ অনলাইনে এই ধরনের প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তারা প্রতারিত হয়ে শুধু অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, হারিয়েছেন মূল্যবান সময় ও মর্যাদা। মুখোমুখি হতে হয়েছে অনেক অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির।

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ইং তারিখ এনা ট্রান্সপোর্ট তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় এমন একটি মামলার তদন্ত করে পুলিশ প্রতারক চক্রের সন্ধান পান। এনা ট্রান্সপোর্টের আপডেটেড তথ্যাদি সংবলিত ভুয়া ফেসবুক পেজের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন রুটে যাত্রীদের কাছ থেকে অনলাইনে এনা ট্রান্সপোর্টের টিকিট বিক্রির নাম করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। পাশাপাশি ধ্বংস করছে এনা ট্রান্সপোর্টের সুনাম। এমন অভিযোগের ভিত্তিতে তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোনের এসি সালমান হাসানের নেতৃত্বে একটি টিম ডেমরার সারুলিয়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে এই প্রতারক চক্রের মূল হোতা নোকরুজ্জামান নতুনকে (২৫) গ্রেফতার করে। উদ্ধার করা হয় ব্যবহৃত ২১টি মোবাইল সিমকার্ড। নোকরুজ্জামান ঢাকা ও ঢাকার পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করে বেশ কিছুদিন থেকেই সে কিছু সুপ্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের নামে অনলাইনে প্রতারণা করে আসছিল। সে প্রতারণার কাজে ১৩০টি মোবাইল সিম ব্যবহার করে বিকাশ ও রকেটের মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করেছে। সে বিভিন্ন পরিবহনের তথ্যাদি ব্যবহার করে ফেসবুক পেজে আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করত।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর