শুক্রবার, ২৮ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

সুন্দরবনের মালিকানা দাবি করে সাইনবোর্ড পরে অপসারণ

শেখ আহসানুল করিম, বাগেরহাট

ব্রিটিশ আমলের জমিদারি প্রথা বাতিল হলেও বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার পিসি বারুইখালী গ্রামের আবদুস সামাদ হাওলাদার ওরফে সামাদ চাপরাশি নামে এক ব্যক্তি নিজেকে ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড সুন্দরবনসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পাঁচ জেলার সব জমির বৈধ মালিক দাবি করে জমিদার সেজে বসেছিলেন। এ দাবি অনুযায়ী তিনি সাইনবোর্ডও লাগিয়েছিলেন। যদিও পরে প্রশাসন এসব সাইনবোর্ড অপসারণ করেছে। জানা গেছে, সামাদ চাপরাশি বিভিন্ন স্থানে ‘সুন্দরবন লর্ড প্রজাস্বত্ব এস্টেট’ নামে অফিস খুলে বসেন। একশ্রেণির দালাল-টাউটকে কমিশন এজেন্ট নিয়োগ দিয়ে তিনি বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর ও বরগুনা জেলার সহজ-সরল কৃষককে টাকার বিনিময়ে ধরিয়ে দেন তথাকথিত সুন্দরবন লর্ড প্রজাস্বত্ব এস্টেটের জমির মালিকানা। দেওয়া হয় জমির মাঠ পরচা ও দাখিলা। এভাবে স্বঘোষিত জমিদার সামাদ চাপরাশি কয়েক বছর ধরে মোরেলগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম পিসি বারুইখালীতে বসে সাধারণ কৃষকের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন কয়েক কোটি টাকা। গত ২৪ আগস্টও বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলা সদর রায়েন্দা বাজারের পাঁচরাস্তা এলাকায় সুন্দরবন লর্ড প্রজাস্বত্ব এস্টেটের অফিস খুলে সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়। সামাদ চাপরাশির এজেন্টরা মাইকিং করে মানুষদের জানিয়ে দেন- শরণখোলা উপজেলার সব জমির মালিক সুন্দরবন লর্ড প্রজাস্বত্ব এস্টেটের জমিদার আবদুস সামাদ হাওলাদার। এখন জমির মালিকানা পেতে হলে জমিদারের কাছ থেকে নিতে হবে বন্দোবস্তের মাঠ পরচা ও দাখিলা। এ অবস্থায় শরণখোলা উপজেলাজুড়ে সাধারণ মানুষের মাঝে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। টনক নড়ে প্রশাসনের। গত বুধবার বিকালে শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী অফিসার সরদার মোস্তফা শাহিন পুলিশ নিয়ে তথাকথিত সুন্দরবন লর্ড প্রজাস্বত্ব এস্টেটের অফিস সিলগালা করে নামিয়ে ফেলেন সাইনবোর্ড। শরণখোলায় অফিস সিলগালা করে সাইনবোর্ড নামিয়ে ফেলা হলেও তথাকথিত সুন্দরবন লর্ড প্রজাস্বত্ব এস্টেটের স্বঘোষিত জমিদার ও তার নিয়োগকৃত দালাল-টাউটদের কমিশন এজেন্টকে এখনো করা হয়নি গ্রেফতার। এমনকি বন্ধ করা হয়নি মোরেলগঞ্জ পিসি বারুইখালীর সদর দফতর। শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী অফিসার সরদার মোস্তফা শাহিন জানান, খবর পেয়ে তথাকথিত সুন্দরবন লর্ড প্রজাস্বত্ব এস্টেটের নামে স্থাপিত সাইনবোর্ড অপসারণ ও তাদের অফিস তালাবদ্ধ করা হয়েছে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা, সুন্দরবনসহ পাঁচ জেলার সব জমির মালিকানা দাবি করে রাষ্ট্রদ্রোহ করায় তার বিরুদ্ধে মামলা করতে শরণখোলার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

 তিনি আরও বলেন, লর্ড প্রজাস্বত্ব এস্টেটের নামে শরণখোলায় বেআইনি কার্যকলাপ চালিয়ে মানুষের মাঝে বিভ্রান্তি ও আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে। স্বাধীন দেশে এখন আর কোনো জমিদারি প্রথা নেই। সব জমির মালিক সরকার। সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত না হতে প্রচার চালাতে ইউপি চেয়ারম্যানদের বলা হয়েছে। এদিকে মোরেলগঞ্জের নিশানবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান আবদুর রহিম বাচ্চু গতকাল সন্ধ্যায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, তথাকথিত সুন্দরবন লর্ড প্রজাস্বত্ব এস্টেটের স্বঘোষিত জমিদার হতদরিদ্র সামাদ চাপরাশি তার ইউনিয়নের পিসি বারুইখালী গ্রামের মৃত আকব্বর চাপরাশির ছেলে। পাঁচ বছর আগেও খালে জাল ধরে সংসার চালাতেন। সামাদ চাপরাশির দাদা আফসার আলী চাপরাশি ছিলেন মোরেলগঞ্জের এসি লাহা এস্টেটের ব্রিটিশ জমিদারের ধানসাগর কাচারিবাড়ির পিওন। বছর চার আগে সামাদ চাপরাশি তার বাড়ির ট্রাংকে পাওয়া এসি লাহা এস্টেটের ব্রিটিশ জমিদার আমলের একটি বন্দোবস্ত কাগজ পেয়ে সুন্দরবনসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পাঁচ জেলার সব জমির বৈধ মালিক দাবি করেছেন। এসব জেলার কোথাও কোথাও অফিস খুলে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে একশ্রেণির দালাল-টাউটকে কমিশন এজেন্ট নিয়োগ দিয়ে সহজ-সরল কৃষককে ভুল বুঝিয়ে তার কাছে নিয়ে আসছিলেন। জমি রক্ষা বা জমি পেতে জনপ্রতি কৃষকের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা ও প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার জমিদারের দরবারে সশরীরে হাজির হয়ে নজরানা দিলে মিলছে জমির কথিত মাঠ পরচা ও দাখিলা। গ্রামের সহজ-সরল অশিক্ষিত কৃষককে বলা হচ্ছে, আইন-আদালতের মাধ্যমে সরকারকে পরাজিত করে তিনি পেয়েছেন সুন্দরবন লর্ড প্রজাস্বত্ব এস্টেটের মালিকানা। জমির কাগজপত্রের জন্য এখন এসিল্যান্ড অফিসে যেতে হবে না। ওসব অফিসের সব কাগজপত্র ভুয়া। এসব কথা বলে এখন কারুকার্যখচিত মোগল বাদশাহদের মতো চেয়ারের সিংহাসন বানিয়ে তাতে বসে কৃষক প্রজাদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে সাপ্তাহিক নজরানা। প্রতি শুক্রবার তার বাড়িতে বসছে জলসা। গত চার বছর এভাবে প্রতারণা করে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে কয়েক কোটি টাকা।

সর্বশেষ খবর