বৃহস্পতিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

পুরান ঢাকার অক্সিজেন বলধা গার্ডেন

মোস্তফা কাজল

পুরান ঢাকার অক্সিজেন বলধা গার্ডেন

পুরান ঢাকার প্রায় সাত লাখ লোকের প্রতিদিনের অক্সিজেন ভাণ্ডার বলধা গার্ডেন। সবুজে ঘেরা এ উদ্যানটি ওয়ারী এলাকায় অবস্থিত। গাছপাগল জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায়চৌধুরী তৈরি করেন বলধা গার্ডেন। বর্তমানে এটি দেখাশোনা করছে বাংলাদেশ সরকারের বন অধিদফতর। এ উদ্যানটি দুইটি অংশে বিভক্ত। সাইকি এবং সিবিলি নামে পরিচিত। রাজধানী ঢাকায় যে কটি উদ্যান সবুজ নৈসর্গিকের জন্য বিখ্যাত তার অন্যতম হচ্ছে বলধা গার্ডেন। ঘিঞ্জি এই পুরান ঢাকার অক্সিজেন বা ফুসফুস যে নামেই ডাকা হোক না কেন তাও এই বলধা গার্ডেনকে বুঝায়। কারণ পুরান ঢাকায় এত বেশি গাছের সমাহার আর কোথাও  নেই। ১৯২৬ সালে ঢাকা সফরকালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাগিচাটি পরিদর্শনে আসেন। ক্যামেলিয়া ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এই হাউসে বসেই তিনি রচনা করেন ‘ক্যামেলিয়া’ কবিতাটি। ১৯০৯ সালে কাজ শুরু হয়। শেষ হয়েছিল ২৭ বছর পর ১৯৩৬ সালে। অথচ জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায়চৌধুরী ছিলেন না স্থপতি না উদ্ভিদবিজ্ঞানী। অথচ তিনিই গড়ে তুলেছিলেন উপমহাদেশের সেরা উদ্ভিদ বাগান। তিনি ছিলেন গাজীপুরের বলধা গ্রামের শেষ জমিদার। জন্মেছিলেন ১৮৮০ সালে গাজীপুরের গাছার জমিদার মহিম চন্দ্রের ঘরে। বলধার বাইরে দার্জিলিং, কলকাতা, পুরী ও ঢাকার ওয়ারীতে বাড়ি তৈরি করেন তিনি। ওয়ারীর বাড়িটির নাম ছিল ‘কালচার হাউস’। পরে এই কালচার হাউস ধীরে ধীরে বলধা হাউস নামে পরিচিতি লাভ করে। সাইকি ও সিবিলি মিলিয়ে ৭২০ প্রজাতির প্রায় পঁচিশ হাজার উদ্ভিদ রয়েছে বলধা গার্ডেনে। এ উদ্যানটি সাড়ে তিন একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এর মধ্যে রয়েছে- জ্যাকুইনিয়া, শারদমল্লিকা, কণ্টকলতা, গুস্তাভা, শ্বেতচন্দন, সাইকাস, স্বর্ণ অশোক, ভুজপত্র, লতাবট, লতাচালতা, ক্যানেঙ্গা, নবমল্লিকা, ওলিও গ্রেগরেন্স, আফ্রিকান বকুল, নাগলিঙ্গম, উদয়পদ্ম, রাজ অশোক, অ্যারোপয়জন, লতা জবা, স্কারলেট, কপসিয়া, হলুদ, দেবকাঞ্চন, কনকসুধা, কনকচাঁপা, জিঙ্গো বাইলোবা, গড়শিঙ্গা, মাধবী, পান্থপাদপ, ঘৃতকুমারী, তুড়কচ াল, শতায়ু উদ্ভিদ, রুদ্র পলাশ, আমাজন লিলি, পিয়াল, পাখিফুল, কৃষ্ণবট আরও কত কি। এছাড়া নানারকমের লতাজাতীয় ও জলজ উদ্ভিদ। ঔষধি বৃক্ষ তো রয়েছেই। গ্রিক শব্দ সিবিলি অর্থ প্রকৃতি এবং সাইকি অর্থ আত্মা।

এ উদ্যানে বিভিন্ন ধরনের অর্কিড, ক্যাকটাস, জলজ উদ্ভিদসহ যে গাছপালা আছে তা শুধু এদেশের জন্যই বিরল সম্পদ নয়, বিশ্বের উদ্ভিদবিশারদদের কাছেও অনেকটা বিরল সম্পদ। পৃথিবীর প্রায় ৫০টি দেশের দুর্লভ ও মূল্যবান গাছ আছে এখানে। একসময় গোলাপের বাগানে ছিল প্রায় ২০০ জাতের গোলাপ। এর অধিকাংশই এখন বিলুপ্ত। অর্কিড হাউসে প্রায় ২০০ জাতের অর্কিড আছে। বলধা গার্ডেনকে বৃক্ষ, জলাশয়, অর্কিড হাউস ও অন্যান্য উদ্ভিদ কর্নার মিলে এক অপূর্ব উদ্যান বলা চলে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর বাগানের অবক্ষয় শুরু। এ বাগানকে রক্ষা করার জন্য ১৯৫১ সালে কোর্ট অব ওয়ার্ডস ও ১৯৬২ সালে বন বিভাগের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। বর্তমানে তা চলছে লিজের মাধ্যমে। পাঁচ টাকা টিকিটে বেড়াতে যেতে পারেন বলধা গার্ডেন। একসময় এখানেই মেলা বসত ঢাকার অভিজাতদের। আজ তার স্মৃতিবহ শতবর্ষী এই গার্ডেন ঢাকাবাসীর গৌরবের অংশ হয়ে টিকে আছে। প্রধান ফটক দিয়ে উদ্যানের প্রবেশপথে আফ্রিকার বাওবাব গাছ দেখা যাবে। একটু সামনে এগোলেই চোখে পড়বে সিলভার ওক, জাকারান্ডা ও ট্যাবে বুইয়া, জাপানের কর্পূর, মালয়েশিয়ার ওয়েল পাম। গতকাল গুলশান থেকে সপরিবারে আসা আমিরুল ইসলাম জানান, পুরো উদ্যানের ভিতরে কোনো নিরাপত্তাকর্মীর দেখা নেই। সবুজে ঘেরা এ উদ্যান দেখে আগত সবার মন ভালো হয়ে যাবে। বলধা গার্ডেনের সিবিলি অংশের প্রধান আকর্ষণ শঙ্খখনদ পুকুর। পুকুরের দুই পাশে সান বাঁধানো ঘাট। সিঁড়ির ধাপগুলো চওড়া। পুকুরের পাশেই বিখ্যাত হাউস। বলধা গার্ডেনে একসময় সব বয়সী মানুষের ভিড় লেগে থাকত। ভোর হলেই শরীরচর্চার জন্য ছুটে আসতেন শিশু থেকে প্রৌঢ়রা। তবে নানা অব্যবস্থাপনায় পার্কটি তার স্বকীয়তা হারাচ্ছে। সকাল থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খোলা থাকলেও দর্শনার্থীদের দুপুর একটায় বের করে দেওয়া হয়। আবার নতুন করে ২০ টাকার টিকিট নিয়ে  ভিতরে প্রবেশ করতে হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর