বৃহস্পতিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

রিয়ার চিৎকারে হামলা রেণুর ওপর

ছেলেধরা সন্দেহে হত্যায় ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আজ চার্জশিট

মাহবুব মমতাজী

রেণুকে জেরার একপর্যায়ে হঠাৎ রিয়া নামের এক অভিভাবক চিৎকার দিয়ে বলেন, ‘ছেলেধরা, ছেলেধরা।’ মুহূর্তেই এক থেকে দেড়শ লোক জড়ো হয়। এর পরই হামলা হয় রেণুর ওপর। ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে নির্মমভাবে নিহত হন তাছলিমা বেগম রেণু। এ ঘটনা গত বছর ২০ জুলাই সকালে রাজধানীর বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ছয় মাসের তদন্তে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) হত্যাকান্ডের রহস্য উদ্্ঘাটন করেছে। বহুল আলোচিত এই হত্যাকান্ডের চার্জশিটে পুরো ঘটনার সচিত্র বর্ণনাও দেওয়া হয়েছে। আজ আদালতে চার্জশিট দাখিল করবে ডিবির মতিঝিল বিভাগ। এতে ১৫ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। নাম-ঠিকানা না পাওয়ায় চারজনকে চার্জশিট থেকে বাদ   দেওয়া হয়েছে। তবে তাদের খোঁজ পাওয়া গেলে  সম্পূরক চার্জশিট দিয়ে অভিযুক্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন ডিবির তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। তদন্ত কর্মকর্তারা বলেন, স্কুলের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকসহ ১৫ জন সরাসরি হত্যাকান্ডে অংশ নেন। এদের মধ্যে অন্যতম আসামি হৃদয়, জাফর ও রিয়া দোষ স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দিয়েছেন। অন্য অভিযুক্তরা হলেন- ওয়াসিম, শাহীন, বাচ্চু মিয়া, বাপ্পী, কামাল হোসেন, আবুল কালাম আজাদ, মুরাদ, সোহেল রানা, বিল্লাল হোসেন, আসাদুল ইসলাম ও রাজু আহমেদ। তবে প্রথমে ছেলেধরা বলে চিৎকার দেন রিয়া। এরপর লোকজন নিয়ে হামলা শুরু করেন হৃদয়। এই ১৫ জনের মধ্যে ১৪ জন ইতিমধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন। মহিউদ্দিন নামের একজনকে চিহ্নিত করা গেলেও তার বাসার সঠিক ঠিকানা পাওয়া যায়নি বলে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। জানতে চাইলে ডিবি পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) আসাদুজ্জামান এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমাদের তদন্ত শেষ হয়েছে। এরপর পিপির মতামতের জন্য পাঠানো হয়েছিল। মতামত এসেছে। ওই মামলার চার্জশিট কাল (বৃহস্পতিবার) আদালতে জমা দেওয়া হবে। আমরা রেণু হত্যা ঘটনার নেপথ্যের বিষয়গুলো বের করতে সমর্থ হয়েছি। চমৎকার একটি চার্জশিট প্রস্তুত হয়েছে। একই সঙ্গে প্রকৃত অপরাধীরা বিচারের মুখোমুখি হবে।’ ডিবির অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঘটনার দিন সকাল সোয়া ৮টার দিকে বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে ঘোরাফেরা করেন রেণু। এ সময় দুজন অভিভাবকের সঙ্গে কথা হয় তার। তারা জানতে চান, রেণু কেন এখানে এসেছেন। রেণু জানান, তার সন্তানকে ভর্তি করাবেন স্কুলে এ জন্য খবর নিতে এসেছেন। কিন্তু ভর্তির সময় পার হওয়ার পরও ভর্তির জন্য স্কুলের সামনে আসায় সন্দেহ হয় অভিভাবকদের। এ সময় রেণু ফটকের দারোয়ানকে প্রধান শিক্ষকের কাছে যাওয়ার কথা বলে ভিতরে প্রবেশ করেন। চারতলা স্কুল ভবনের দ্বিতীয় তলার প্রধান শিক্ষিকার কক্ষে গিয়ে জানতে চান, এখন তার সন্তানকে ভর্তি করা যাবে কি না। প্রধান শিক্ষিকা জানান, ভর্তির সময় পার হয়ে গেছে। এরপর রেণু সেখান থেকে চলে আসেন। স্কুলের প্রধান ফটক দিয়ে বের হওয়ার সময় তার কাছে বেশ কিছু অভিভাবক জানতে চান বাসা কোথায়। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রিয়া। রেণু প্রথমে বলেন, তার বাসা স্কুলের পাশেই উত্তর বাড্ডা আলীর মোড়ে। তখন অভিভাবকেরা বলেন, স্কুলের পাশে বাসা অথচ জানেন না যে ভর্তির সময় পার হয়ে গেছে! জেরার মুখে রেণু জানান, তার বাসা মহাখালী ওয়েরলেস গেট। প্রথমে বাসার ঠিকানা ভুল বলায় সন্দেহ হয় অভিভাবকদের। রিয়া নামের ওই অভিভাবক তখন চিৎকার দিয়ে বলেন, ‘ছেলেধরা ছেলেধরা।’ রিয়ার চিৎকারে মুহূর্তেই এক থেকে দেড়শ লোক স্কুলের মধ্যে জড়ো হন। পরে রেণুকে তারা প্রধান শিক্ষিকার কক্ষে নিয়ে যান। পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় প্রধান শিক্ষিকা তার কক্ষ ভিতর থেকে বন্ধ করে দেন। তার নির্দেশে দারোয়ান স্কুলের মূল ফটকে তালা লাগিয়ে দেন। স্থানীয় কাউন্সিলরের মাধ্যমে বাড্ডা থানায়ও খবর দেওয়া হয়। এদিকে বাইরে অভিভাবকসহ হাজারখানেক মানুষ জড়ো হয়ে প্রথমে স্কুলের প্রধান ফটক ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করেন। পরে প্রধান শিক্ষিকার কক্ষের দরজা ভেঙে টেনেহিঁচড়ে বের করে আনেন রেণুকে। এ সময় প্রধান শিক্ষিকা অ্যাসেম্বলির মাইকে বারবার ঘোষণা দেন, ‘এই মহিলা ছেলেধরা নন, তিনি ভালো মানুষ, তাকে ছেড়ে দিন।’ কিন্তু কেউ তার কথায় কর্ণপাত করেননি। তারা স্কুলমাঠের শহীদ মিনারের সামনে বেদম মারধর করতে থাকেন রেণুকে। এ মারধরে ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যেই মারা যান রেণু। এ ঘটনায় রেণুর বোনের ছেলে সৈয়দ নাসিরউদ্দিন বাদী হয়ে বাড্ডা থানায় অজ্ঞাতনামা ৪০০ থেকে ৫০০ মানুষকে আসামি করে মামলা করেন। রেণুর বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে। মহাখালীতে পাঁচ বছরের মেয়ে তুবা, ১২ বছরের ছেলে তাহসিন ও মাকে নিয়ে থাকতেন রেণু। মৃত্যুর দুই বছর আগে স্বামীর সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর