শনিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

দুয়ার খুলেছে ঐতিহ্যের শালবন বিহারের

রাসেল মাহমুদ ভূঁইয়া

দুয়ার খুলেছে ঐতিহ্যের শালবন বিহারের

শালবন বৌদ্ধ বিহার। দেশের অন্যতম প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন। প্রতœতাত্ত্বিক স্থানগুলোর মধ্যে এটি বিখ্যাত। কুমিল্লা জেলার কোটবাড়ী ও লালমাই পাহাড়ের মাঝামাঝি এলাকায় বিহারের অবস্থান। আশপাশে শাল আর গজারি বৃক্ষের বন থাকায় বিহারটির নামকরণ করা হয় শালবন বিহার।

১৮৭৫ সালের শেষের দিকের কথা। বর্তমান কোটবাড়ী এলাকায় সড়ক নির্মাণের সময় উন্মোচিত হয় একটি ইমারতের ধ্বংসাবশেষ। সে সময় ধ্বংসাবশেষটিকে অনুমান করা হয়েছিল দুর্গ বলে। ১৯১৭ সালে ঢাকা জাদুঘরের অধ্যক্ষ নলিনীকান্ত ভট্টশালী এলাকাটি পরিদর্শনে যান। তখন তিনি এটিকে রণবংকমল্ল হরিকেল দেবের তাম্রশাসনের দুর্গ ও বিহার বলে ধারণা করেন।

প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের আঞ্চলিক পরিচালক (চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগ) মো. আতাউর রহমান জানান, শালবন বৌদ্ধবিহারের প্রথম খননকাজ শুরু হয় ১৯৫৫ সালে। মাঝে বিরতি দিয়ে পরে আবার  খননকাজ শুরু হয় ২০০৮ সালে, যা এখনো চলমান। ২০০৮ থেকে এ পর্যন্ত খনন করে বিহারের চারপাশে পাওয়া গেছে ছোট ছোট ৯টি মন্দির ও ৬টি স্তূপ। ২০১৪ সালে খনন করা হয় মূল বৌদ্ধবিহারের উত্তর-পূর্ব কোণ। ওই সময় একটি স্থানে পাওয়া যায় কূপের সন্ধান, যা ইট ও কাদামাটি দিয়ে তৈরি। এ কূপটিকেও প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। প্রত্নতত্ত্বের সন্ধানে খননকালে এ বিহরে বিভিন্ন সময় ১৫৫টি কক্ষ আবিষ্কৃত হয়। ধারণা করা হয়, সেখানে বৌদ্ধভিক্ষুরা থাকতেন এবং ধর্মচর্চা করতেন। এ ছাড়া বিহারটির ধ্বংবশেষ থেকে আটটি তাম্রলিপি, ৪০০টির মতো স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, অসংখ্য পোড়ামাটির ফলক, সিলমোহর, ব্রৌঞ্জ ও মাটির মূর্তি পাওয়া গেছে। আর এগুলো প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে বিহারের পাশে অবস্থিত ময়নামতি জাদুঘরে। ফুলে ফুলে ভরে আছে বিহারের আঙিনা। হাসি ছড়াচ্ছে কসমস, ডালিয়া, জিনিয়া, গোলাপ, সিলভিয়া, ক্যালান্ডোলা। বছরজুড়ে এখানে লাগানো হয় ঋতুভিত্তিক নানা প্রজাতির ফুলের গাছ। শালবন বিহারের পাশে রয়েছে ময়নামতি জাদুঘর ও নব শালবন বৌদ্ধমন্দির। এ ছাড়া পর্যটন এলাকা কোটবাড়ীতে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড), ইটাখোলা মুড়া, রূপবান মুড়া, আনন্দ বিহারসহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান বেশ জনপ্রিয়। এসব জায়গায় প্রতিদিন দেশের নানা প্রান্ত থেকে বিপুলসংখ্যক পর্যটক ঘুরতে আসেন। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের আঞ্চলিক পরিচালক মো. আতাউর রহমান বলেন, যে কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ এখন ঘুরতে পছন্দ করেন। করোনা মহামারীর কারণে দীর্ঘ ছয় মাস বন্ধ থাকার পর সেপ্টেম্বরের ১৬ তারিখ সব প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান খুলে দেওয়া হয়। এর পর থেকে শালবন বিহারে শুরু হয় দর্শনার্থীদের আগমন, যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি বলেন, পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। এখানে রয়েছে অডিটরিয়াম ও রেস্টহাউস। এ ছাড়া বৃষ্টির সময় দর্শনার্থীরা যেন আশ্রয় নিতে পারেন, সে জন্য কিছু শেড নির্মাণের জন্য প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরে আবেদন করা হয়েছে।

শালবন বিহারে ঘুরতে আসা বেশ কয়েকজন দর্শনার্থী জানান, প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলো ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পরিচয় বহন করে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর শালবন বিহার খুলছে শুনে পারিবার নিয়ে ঘুরতে এসেছেন। বেড়ানোর পাশাপাশি দেশের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কেও জানতে পারছেন তারা। ময়নামতি জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান হাসিবুল হাসান সুমি জানান, শালবন বিহারকে ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইট বা বিশ^ ঐতিহ্য হিসেবে মনোনয়নের জন্য কাজ চলছে। দিন দিন এখানে পর্যটকদের আগমন বাড়ছে। ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে সরকারের রাজস্ব আয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে শালবন বিহার ও ময়নামতি জাদুঘর থেকে রাজস্ব আয় হয়েছে ১ কোটি ২২ লাখ টাকা। করোনার কারণে পরের অর্থবছর রাজস্ব আয় কিছুটা কমে যায়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাজস্ব আয় হয় ৯৮ লাখ টাকা। করোনার কারণে মার্চ মাসে পর্যটন কেন্দ্রগুলো বন্ধ না হলে ওই বিগত অর্থবছর রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা দেড় কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সাদেকুজ্জামান তনু বলেন, কুমিল্লার লালমাই ও ময়নামতি পাহাড় ঘিরে রয়েছে অসংখ্য প্রত্নসম্পদ ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। একসময় এ অঞ্চল শাসকদের প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রবিন্দু ছিল। বৌদ্ধবিহারগুলোতে যেমন ধর্মচর্চা হতো, তেমনি এখানে প্রদান করা হতো শিক্ষা। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো থেকে প্রাপ্ত সম্পদই বলে দিচ্ছে এখানকার ইতিহাস ও সংস্কৃতি কতটা পুরনো আর সমৃদ্ধ ছিল। শালবন বিহারে যাওয়া জন্য প্রথমেই আসতে হবে কুমিল্লা শহরে। ঢাকা থেকে কুমিল্লায় ট্রেন বা বাসে আসা যায়। বাসে এলে কুমিল্লার কোটবাড়ী বাসস্ট্যান্ডে নেমে সিএনজি বা রিকশায় নব শালবন বিহার যাওয়া যাবে। শালবন বিহারে প্রবেশের সময় সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত। দেশি পর্যটকদের প্রবেশ ফি জনপ্রতি ২০ টাকা, শিক্ষার্থী হলে মাধ্যমিকের নিচে ৫ টাকা, এর ওপরে ২০ টাকা। সার্কভুক্ত আটটি দেশের পর্যটকদের জন্য ১০০ টাকা এবং অন্যান্য দেশের জন্য ২০০ টাকা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর