শিরোনাম
সোমবার, ৩১ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

গ্রামবাসীই নির্মাণ করছেন বাঁধ

ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা উপকূলবাসীর

প্রতিদিন ডেস্ক

গ্রামবাসীই নির্মাণ করছেন বাঁধ

খুলনার কয়রায় বাঁধ নির্মাণে গ্রামবাসী -বাংলাদেশ প্রতিদিন

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন উপকূলের বাসিন্দারা। বিশেষ করে কোথাও কোথাও কারও সাহায্যের আশায় বসে না থেকে অনেকেই নিজেদের উদ্যোগে পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। যেমন খুলনার কয়রায় গ্রামবাসী নিজেরাই নেমে পড়েছেন প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণে। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

খুলনা : ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের পাঁচ দিন পরও জলোচ্ছ্বাসে ভেঙে যাওয়া খুলনার উপকূলের কয়েকটি পয়েন্টে বাঁধ মেরামত করা যায়নি। এ অবস্থায় গতকাল ভোর থেকে কয়েক হাজার গ্রামবাসী কয়রার মহারাজপুর দশহালিয়া বেড়িবাঁধ স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁশ, মাটি, সিমেন্টের বস্তা দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করেন। দুপুরে নদীতে জোয়ারের আগ পর্যন্ত এভাবে বাঁধের একাংশ মেরামত সম্ভব হয়। তবে পরে বাকি অংশ দিয়ে আবারও লবণপানি লোকালয়ে ঢুকতে শুরু করে বলে জানা গেছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, দশহালিয়া বাঁধ মেরামতে ভোর থেকেই দশহালিয়া, গোবিন্দপুরসহ আশপাশের ১৫টি গ্রামের মানুষ নিজেরা বাঁশ, কোদাল নিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছেন। শিক্ষক তারিক হোসেন বলেন, ফজরের নামাজ আদায় করে বিভিন্ন গ্রাম থেকে মানুষ এসে বাঁধ মেরামতের কাজ করছেন। এই বাঁধ আটকানো না গেলে লবণপানিতে ফসলি জমি, ঘরবাড়ি তলিয়ে যাবে। ফলে হাজার হাজার মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে টিকে থাকার লড়াইয়ে নেমেছেন।

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে দশহালিয়ার দুটি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। সেখান থেকে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে। এতে মহারাজপুর, কয়রা বাগালি ইউনিয়নের গ্রামগুলো তলিয়ে যায়। দশহালিয়া থেকে হোগলা অভিমুখের বাঁধ নির্মাণে বিভিন্ন গ্রামের হাজার হাজার মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ নির্মাণের চেষ্টা করছেন।

বাগেরহাট : ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের জলোচ্ছ্বাসে ভালো নেই ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি। প্রতিটি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে নিজে ক্ষতবিক্ষত হয়ে উপকূলবাসীকে মায়ের মতো আগলে রাখে সুন্দরবন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এবার ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ও অবকাঠামোর ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে হরিণসহ অনেক বন্যপ্রাণী ভেসে গেছে। এর মধ্যে ৪টি হরিণ ও বিশ্বের বিলুপ্তপ্রজাতির ১টি ইরাবতী ডলফিনের মৃতদেহ উদ্ধার করেছে সুন্দরবন বিভাগ। সুন্দরবনের ৪টি রেঞ্জের মধ্যে দুটি শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে ৬টি বন অফিস, ৭টি স্টাফ ব্যারাক হাউস, ২০টি জেটি, ১জি রেস্ট হাউস, সুন্দরবন পাহারার ১১টি জলযান, ১টি ওয়াচ টাওয়ার, ২টি পায়ে হাঁটা উঁচু করে তৈরি কাঠের রাস্তা, ২টি গোলঘর ও করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের কুমিরের ১১ পি প্যান উল্লেখযোগ্য। বন্যপ্রাণী, বন কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বনজীবীদের সুপেয় পানির জন্য পাড় উঁচু করে সদ্য খনন করা ১১টি পুকুরও সমুদ্রের তীব্র লবণাক্ত পানিতে তলিয়ে গেছে।

সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ ও সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণসহ বন্যপ্রাণী রক্ষা করতে বনের মধ্যে প্রচুর পরিমাণ মাটির টিলা তৈরি করতে হবে। যাতে করে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সময় ইই উঁচু টিলায় বন্যপ্রাণীরা আশ্রয় নিতে পারে। একইসঙ্গে বন অফিসসহ সব অবকাঠামো ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস সহনীয় শক্ত আরসিসি অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। এটা করা হলে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বার বার সুন্দরবনের অবকাঠামোর আর কোনো ক্ষয়ক্ষতি হবে না।

এদিকে বাগেরহাটে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও উপকূলীয় এলাকাকে দুর্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণার দাবিতে গতকাল মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। দুপুরে বাগেরহাট প্রেস ক্লাবের সামনে ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধনের আয়োজন করে জেলা জলবায়ু অধিপরামর্শ ফোরাম। এই মানববন্ধনে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজন অংশ নেন।

পাথরঘাটা (বরগুনা) : বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) পাথরঘাটার পানি পরিমাপক খায়রুল ইসলাম জানিয়েছেন, পাথরঘাটার বলেশ্বর ও বিষখালী নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় নদ-নদীতে বিপৎসীমার ১২৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবাহিত হয়েছে। এতে পদ্মা, জিনতলা, পশ্চিম কাঁঠালতলী ও উত্তর কাঁঠালতলী বেড়িবাঁধ নতুন করে ভেঙে  গেছে। বলেশ্বর নদের তীরের পশ্চিম কাঁঠালতলী ও উত্তর কাঁঠালতলী  বেড়িবাঁধের আধা কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে গেছে। এ কারণে তিন দিন ধরে পানি ঢুকে লোকালয় ও নিম্নাঞ্চলের বাড়িঘর তলিয়ে গেছে। পাথরঘাটা সদর ইউনিয়ন পরিষদের দুই ইউপি সদস্য আবদুস সত্তার খান বলেন, বাঁধ ভেঙে এ নিম্নাঞ্চলের কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছেন। ফলে এসব মানুষের রান্নাবান্না বন্ধ রয়েছে।

কলাপাড়া (পটুয়াখালী) : কলাপাড়ায় বানভাসি এলাকা থেকে  জোয়ারের পানি কমতে শুরু করেছে। ঘরের ভিতরে পানি থাকায় এখনো অনেকে আশ্রয় নিয়ে আছেন বাঁধের ওপর। উপজেলার চারটি ইউনিয়নের ২৫টি গ্রামে অন্তত ৩০ হাজার মানুষ এবার ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার অস্বাভাবিক জোয়ারের তান্ডবের পর অসহায় হয়ে পড়েছেন। সব কিছু হারিয়ে গ্রামের মানুষ চোখে অন্ধকার দেখছেন। অধিকাংশ গ্রামে দেখা দিয়েছে স্থায়ী জলাবদ্ধতা।

বরিশাল : মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব রওনক মাহমুদ বলেছেন, ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ এর প্রভাবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের মন্ত্রণালয়ের চলমান প্রকল্প থেকে মাছ চাষের জন্য জরুরিভাবে মাছের পোনা এবং প্রণোদনা দেওয়া হবে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে জোয়ারের পানি বৃদ্ধির কারণে গবাদি পশু হারিয়ে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন- তাদেরও সরকারিভাবে নানা সহায়তা দেওয়া হবে। তিনি গতকাল দুপুরে বরিশাল নগরীর কাশীপুর মৎস্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আয়োজিত ‘ইউনিয়ন পর্যায়ে মৎস্য চাষ প্রযুক্তি সেবা সম্প্রসারণ প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়) এবং ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের আওতায় সুফলভোগীদের সঙ্গে আলোচনা সভা ও উপকরণ বিতরণ অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।

সাতক্ষীরা : খুব দ্রুত টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকাকে দুর্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণার দাবিতে গতকাল শ্যামনগর প্রেস ক্লাবের সামনে ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন করেছেন উপকূলবাসী। মানববন্ধনে  সংহতি প্রকাশ করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা লিডার্স, সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলন এবং উদয়ন বাংলাদেশ।

অপরদিকে এর আগে শরীরে কাঁফনের কাপড় জড়িয়ে পদ্মপুকুরের ভাঙনকবলিত বেড়িবাঁধে দাঁড়িয়ে মানববন্ধন করার ঘটনায় উপকূলীয় জলবায়ু যোদ্ধাদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছনার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে সাতক্ষীরা জেলা। ঘটনায় জড়িত স্থানীয় পদ্মপুকুর ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান আতাউর রহমান ও পাউবো কর্মকর্তা আলমগীর কবিরের বিচারের দাবিতে গতকাল  মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে সাতক্ষীরা জেলা শহরে। সম্মিলিত সামাজিক সংগঠন জোটের আয়োজনে সাতক্ষীরা প্রেস ক্লাবের সামনে এই বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়।

সর্বশেষ খবর