বৃহস্পতিবার, ১৭ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

ফের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে করোনা

সীমান্ত ছাড়িয়ে আবারও সংক্রমণ বাড়ছে ঢাকায়

নিজস্ব প্রতিবেদক

ফের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে করোনা

দেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি আবারও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৩ হাজার ৯৫৬ জন নতুন আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছেন, যা ৫৫ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ। নমুনা পরীক্ষায় শনাক্তের হার ছিল ১৬ দশমিক ৬২ শতাংশ, যা ৫৭ দিনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ৬০ জন। ৪ মের পর ৪৩ দিনের মধ্যে এটাই এক দিনে সর্বাধিক মৃত্যু। এ ছাড়া সীমান্তবর্তী খুলনা বিভাগে শনাক্তের হার ৪০ শতাংশের ওপরই রয়েছে। রংপুর বিভাগেও তান্ডব চালাচ্ছে ভাইরাসটি। সীমান্ত ছাড়িয়ে আবারও সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে দেশের মধ্যাঞ্চল ঢাকা বিভাগে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী গতকাল পর্যন্ত দেশে মোট করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছেন ৮ লাখ ৩৭ হাজার ২৪৭ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ১৩ হাজার ২৮২ জন। সুস্থ হয়েছেন ৭ লাখ ৭৩ হাজার ৭৫২ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত ৬০ জনের মধ্যে ৩৬ জন পুরুষ, ২৪ জন নারী। হাসপাতালে ৫৫ জন, বাড়িতে পাঁচজন মারা গেছেন। এর মধ্যে ২৩ জনই ছিলেন ষাটোর্ধ্ব। এ ছাড়া ১৬ জন পঞ্চাশোর্ধ্ব, ১০ জন চল্লিশোর্ধ্ব, সাতজন ত্রিশোর্ধ্ব, একজন বিশোর্ধ্ব ও তিনজনের বয়স ছিল ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে রাজশাহী বিভাগে। এ ছাড়া ১৪ জন খুলনা, আটজন করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম, ছয়জন সিলেট, চারজন রংপুর ও তিনজন ময়মনসিংহ বিভাগের বাসিন্দা ছিলেন।

গত ফেব্রুয়ারিতে দেশে করোনা পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। শনাক্তের হার নেমে আসে ৩ শতাংশের নিচে। মার্চে বাড়তে শুরু করে। মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে এপ্রিলজুড়ে চলে করোনার তান্ডব। শনাক্তের হার ২৩ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। দৈনিক মৃত্যু শতক পার হয়। মেতে সংক্রমণ আবার কিছুটা কমে জুনের শুরু থেকে অনেকটা টানা বাড়ছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় শনাক্ত হচ্ছে করোনার ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। সীমান্ত এলাকাগুলোয় চলছে ভাইরাসটির তান্ডব। এদিকে বেশ কিছুদিন ধরে ঢাকা বিভাগে শনাক্ত হার সবচেয়ে কম থাকলেও গত ২৪ ঘণ্টায় আবারও বেড়ে গেছে। এই সময়ে নমুনা পরীক্ষায় শনাক্তের হার ছিল যথাক্রমে খুলনা বিভাগে ৪০.৩৮, রংপুর বিভাগে ৩০.১৮, রাজশাহী বিভাগে ১৯.৭১, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৩.৮০, ময়মনসিংহ বিভাগে ১৩.৪৯, ঢাকা বিভাগে ১২.৩২, বরিশাল বিভাগে ১২ ও সিলেট বিভাগে ১১.৪১ শতাংশ। অথচ আগের দিনও ঢাকা বিভাগে শনাক্তের হার ছিল ৭.৫৬ শতাংশ, যা দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন।

করোনা সংক্রমণ বাড়ায় সারা দেশে চলমান বিধিনিষেধ আরও এক মাস বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয় প্রশাসন বিভিন্ন এলাকায় চলাফেরার ওপর আলাদাভাবে বিধিনিষেধ জারি করেছে। হু হু করে সংকটাপন্ন আক্রান্ত বাড়তে থাকায় চিকিৎসা সংকট দেখা দিয়েছে জেলা-উপজেলায়। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো আরও খবর-

রাজশাহী : রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে প্রতিদিনই করোনা আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে হাসপাতালে সাধারণ ও আইসিইউ মিলে ২৭২ শয্যার বিপরীতে আক্রান্ত ভর্তি আছেন ৩৪৪ জন। আক্রান্তের চাপে চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা। আইসিইউ সুবিধা ও অক্সিজেন পেতে করোনা আক্রান্তদের মধ্যে হাহাকার পড়ে গেছে। একটি আইসিইউর জন্য অন্তত ৭০ জন সিরিয়াল দিয়ে রাখছেন। ফলে অনেক সংকটাপন্ন আক্রান্ত আইসিইউর অভাবে মারা যাচ্ছেন। দিনাজপুর : গত ২৪ ঘণ্টায়  দিনাজপুর এম. আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ ল্যাবে ১৯৫ নমুনা পরীক্ষায় ৭৬টি পজিটিভ এসেছে। শনাক্তের হার ৩৯ শতাংশ। সংক্রমণের লাগাম টানতে দিনাজপুর সদর উপজেলায় কঠোর লকডাউন ঘোষণার দ্বিতীয় দিনেও বিভিন্ন ধরনের যানবাহন চলছে। তবে প্রয়োজন ছাড়া অন্য উপজেলা থেকে যানবাহন সদরে প্রবেশ করতে পারেনি। শহরে সব ধরনের দোকানপাট প্রায় বন্ধ ছিল। নাটোর : নাটোর সদর হাসপাতালে করোনায় দুজন মারা গেছেন। কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেও কমছে না সংক্রমণ। গত ২৪ ঘণ্টায় ৩০১ নমুনা পরীক্ষায় ১২০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ৩৯.৮৬ শতাংশ। আক্রান্তের চাপ বাড়ায় হিমশিম খাচ্ছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ৩১ শয্যার করোনা ইউনিটকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করার পরও মেঝেতে রাখতে হচ্ছে আক্রান্তদের।

বেনাপোল : গত ২৪ ঘণ্টায় যশোরের বেনাপোল ও শার্শায় ৩০ নমুনার মধ্যে ২২টি পজিটিভ আসে। শনাক্তের হার ৭৩.৩৩ শতাংশ। সংক্রমণ ঠেকাতে বেনাপোলে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে শার্শা উপজেলা প্রশাসন।

বাগেরহাট : জেলায় করোনায় আরও চারজনের মৃত্যু হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ২১৫ নমুনা পরীক্ষায় মোংলা ইপিজেডের পাঁচ আনসার সদস্যসহ ৭৬ জনের শরীরে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়েছে। শনাক্তের হার ৩৫.৩৪ শতাংশ। তবে জেলার সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা মোংলা উপজেলায় ২৩ নমুনা পরীক্ষায় ১৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ৬৫.২১ শতাংশ। এদিকে মোংলা ইপিজেডের চীনের নারী টেকনিশিয়ানের পর এবার পাঁচ আনসার সদস্যের করোনা শনাক্ত হওয়ায় ইপিজেডের বিভিন্ন কলকারখানার শ্রমিকের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

 

সাতক্ষীরা : গত ২৪ ঘণ্টায় করোনার উপসর্গ নিয়ে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনজন ও বুশরা হাসপাতালে একজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া ১৮৮ জনের নমুনা পরীক্ষায় ১০০ জনের করোনা পজিটিভ ধরা পড়েছে। শনাক্তের হার ৫৩ দশমিক ১৯ শতাংশ। জেলায় এ পর্যন্ত করোনায় মারা গেছেন ৫৫ জন। উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন আরও ২৫২ জন।

কুড়িগ্রাম : গত ২৪ ঘণ্টায় ৩২ জনের নমুনা পরীক্ষায় ১২ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ৩৭.৫ শতাংশ। গত এক সপ্তাহেই শতাধিক মানুষের করোনা শনাক্ত হয়েছে। পরীক্ষা বাড়লেই বাড়ছে আক্রান্ত।

বগুড়া : গত ২৪ ঘণ্টায় বগুড়ায় আরও চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া ২৬১ নমুনা পরীক্ষার ফলাফলে নতুন করে ৪১ জন শনাক্ত হয়েছেন। সীমান্ত এলাকা রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট অঞ্চলের মানুষ রাজশাহী মেডিকেলে করোনা আক্রান্তের ভিড়ে জায়গা না পেয়ে বগুড়ায় ছুটে আসছেন।

ময়মনসিংহ : ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালের করোনা ইউনিটে গত ২৪ ঘণ্টায় ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে দুজন করোনা পজিটিভ ছিলেন, বাকিরা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৪৪ জনের নমুনা পরীক্ষায় ২৮ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে।

যশোর : কঠোর বিধিনিষেধ চলার মধ্যেই যশোরে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বাড়ছে। ৯ জুন মধ্যরাত থেকে যশোরের দুটি পৌর এলাকায় সাত দিনের কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে প্রশাসন। এ সাত দিনে জেলায় করোনা ও উপসর্গ নিয়ে ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্তের হার ৪০ থেকে ৫০ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে। এর মধ্যে জেলায় মঙ্গলবার সর্বোচ্চ করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হয়। এদিন ৫২৮ জনের নমুনা পরীক্ষায় ২৪৯ জনের পজিটিভ আসে। শনাক্তের হার ৪৭ শতাংশের ওপরে। সংক্রমিতের মধ্যে ১৫ জনই ভারত থেকে ফেরা। এমন পরিস্থিতিতে লকডাউন আরও এক সপ্তাহ বাড়ানো হয়েছে।

রাজশাহীতে ‘বিশেষ লকডাউন’ বাড়ল : রাজশাহী থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ ঠেকাতে উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা রাজশাহীতে ‘বিশেষ লকডাউন’র মেয়াদ আরও এক সপ্তাহের জন্য বাড়ানো হয়েছে। গতকাল রাতে রাজশাহী সার্কিট হাউসে জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভা শেষে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন এই ‘বিশেষ লকডাউন’র মেয়াদ বাড়ানোর কথা গণমাধ্যমকে জানান। সভায় রাজশাহী জেলায় করোনা পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ও  মৃত্যু হার বিশ্লেষণ করেন- জেলা প্রশাসক আবদুল জলিল। পরে মেয়র এ সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন।

এর আগে গত ১০ জুন রাতে রাজশাহী সার্কিট হাউসে অনুষ্ঠিত জরুরি বৈঠক থেকে বিশেষ লকডাউনের আদলে কঠোর বিধিনিষেধ জারি করে জেলা প্রশাসন। ১১ জুন বিকাল ৫টা থেকে ১৭ জুন মধ্যরাত (১২টা) পর্যন্ত এক সপ্তাহের জন্য সর্বাত্মক এই লকডাউন দেওয়া হয়েছিল।

সর্বশেষ খবর