বুধবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

বাজেট ব্যয় সামলাতে হিমশিম সরকার

মানিক মুনতাসির

বাজেট ব্যয় সামলাতে হিমশিম সরকার

করোনা মহামারীর ভয়াবহতা কমে এলেও রাজস্ব আয়ের বেলায় কাক্সিক্ষত গতি আসেনি। রেমিট্যান্সেও বিরাজ করছে ধীরগতি। বৈদেশিক সহায়তা ও ঋণ দুটিই বেড়েছে। অন্যদিকে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপও রয়েছে। বাজারে বেশির ভাগ পণ্যের দামেও ঊর্ধ্বমুখিতা। ফলে মূল্যস্ফীতির চাপও বাড়ছে ধারাবাহিকভাবে। করোনার কারণে সরকারের পরিচালন ব্যয়ের লাগাম টানার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে আরও আগেই। কৃচ্ছ্রসাধনা অবলম্বনের পথ ধরলেও তার সাফল্য দৃশ্যগোচর নয়। অন্যদিকে উন্নয়ন ব্যয়ের চাকা সচল রেখে কর্মসংস্থান ও বাজারে টাকার প্রবাহ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে সরকার। ফলে বাজেট ব্যয়ের চাপ সামলাতে সরকারকে কিছুটা হিমশিম খেতে হচ্ছে। সঠিক সময়ে প্রকল্প শেষ করতে অর্থের প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বাজেট বাস্তবায়ন ও সম্পদ ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিচ্ছে সরকার। এজন্য ‘আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল’ এবং ‘বাজেট ব্যবস্থাপনা ও সম্পদ কমিটি’র বৈঠক ডাকা হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে এ দুটি বৈঠক আজ হওয়ার কথা। অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা অবশ্য একে নিয়মিত কর্মসূচিই বলছেন। সূত্র জানান, করোনাভাইরাস মহামারীর ফলে সরকারের আয় কমছিল গত অর্থবছর থেকেই। ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে বিপুল রাজস্ব ঘাটতি তৈরি হয়। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসেও (জুলাই-নভেম্বর) রাজস্ব ঘাটতি রয়েছে ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। ফলে বাজেট ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে সরকার ব্যয় সংকোচন নীতি অনুসরণ করে চলেছে। প্রকল্পের গাড়ি ও অন্যান্য সরঞ্জাম কেনা, অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফরসহ আরও কয়েকটি খাতে ব্যয় সংকোচন নীতি মেনে চলে সরকার। ফলে জুলাই-২০২১ পর্যন্ত শুধু ভ্রমণ খাতেই সাশ্রয় হয়েছে ২ হাজার কোটি টাকা। চলতি ডিসেম্বর পর্যন্ত সাশ্রয় হওয়া এ অর্থের পরিমাণ ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি হতে পারে বলে ধারণা করছে অর্থ বিভাগ। সূত্র জানান, রাজস্ব আয় ও রেমিট্যান্সের নিম্নগতি সরকারকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। একদিকে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় সম্ভব হচ্ছে না, অন্যদিকে প্রবাস আয় রেমিট্যান্স প্রবাহও ধারাবাহিকভাবে কমে যাচ্ছে। রপ্তানি বাড়লেও আমদানি বেড়েছে আরও বেশি। বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য নেতিবাচক অবস্থায় রয়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার মানও কমে যাচ্ছে। এই যখন পরিস্থিতি তখন করোনাভাইরাসে নতুন ধরন ওমিক্রম দেশের অর্থনৈতিক খাতের ওপর চোখ রাঙাচ্ছে। ফলে চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ২ অর্জিত হবে কি না তা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।

অবশ্য অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘চলতি ২০২১-২২ অর্থবছর ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির যে প্রাক্কলন করা হয়েছে তা অর্জন করাই সম্ভব। বর্তমান অর্থবছরে আমাদের বাজেটের আকার যা রয়েছে সেখানে প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধি রয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। আমরা বিশ্বাস করি ৭ দশমিক ২ শতাংশ অর্জন করতে পারব। আপনারা জানেন বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ সব সময় এ বিষয়ে একটু অন্যরকম। তবে ভালো খবর হলো আমরা ৭ দশমিক ২ অর্জন করতে পারব। আমরা যদি কাছাকাছি সময় দেখি তাহলে দেখতে পাই প্রতিটি খাতেই আমাদের প্রবৃদ্ধি আছে। ভালোভাবে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছি। আমাদের এক্সপোর্টও বেড়েছে। এক্সপোর্টে যা আশা করেছিলাম তার চেয়ে বেশি হয়েছে।’

অর্থ বিভাগ বলছে, অর্থবছরের মাঝামাঝি এসে দেখা যাচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক খাতে বেশ কয়েকটি ঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছে। সরকারকে বেশি ভাবাচ্ছে রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ। রপ্তানি কিছুটা বাড়লেও আগামী কয়েক মাসে মোড় কোন দিকে নেবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। কারণ ইউরোপে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রম এখন প্রায় মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার উপক্রম। পরিস্থিতি যা দাঁড়াচ্ছে তাতে ইইউ দেশগুলো যদি লকডাউনে যায় তাহলে দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক রপ্তানি মারাত্মক ব্যাহত হবে। কারণ এসব দেশে তৈরি পোশাক বেশি রপ্তানি হয়। অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বাজেটে রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে দেওয়া হলেও কাক্সিক্ষত হারে আদায় করা যাচ্ছে না। আগামীতে রাজস্ব আদায় কতখানি বাড়বে সে বিষয়ে আমরা চিন্তিত। বৈঠকে এ বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। অর্থ বিভাগের সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করা হবে।’ এদিকে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাবে মূল্যস্ফীতির চাপও ঊর্ধ্বমুখী। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের তথ্যানুযায়ী গত অক্টোবরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি) বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। আর ১২ মাসের গড় হিসাবে এ হার ছিল ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ। পণ্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ। এতে সাধারণ মানুষের ব্যয় বাড়লেও গত কয়েক বছরে আয় বাড়েনি। যদিও একটা শ্রেণির মানুষের আয় বাড়ায় মাথাপিছু আয় বাড়ছে ক্রমাগত। অথচ বেশির ভাগ মানুষেরই আয় বাড়ছে না। ফলে আয়-বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে বলে মনে করেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা-সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আর্থিক তথ্য ম্যাক্রো অর্থনীতির মূল ভিত্তি যেখানে আর্থিক নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে তথ্যের ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। অর্থনীতিতে যখনই চাহিদা কম ছিল তখনই সরকার ব্যয় বাড়িয়ে চাহিদা তৈরি করেছে।’ কভিড-১৯ মহামারী চলাকালে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ বলেছিলেন, ‘বিশ্বব্যাপী উৎপাদন ও সরবরাহ চেন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাহিদা হ্রাস পায়। ওই পরিস্থিতিতে সরকারের ব্যয় বাড়াতে হয়, যা এখনো বহাল রয়েছে। অথচ সে হারে সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়ছে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তহবিলের ঘাটতি থাকলেও বাংলাদেশ সরকারের তহবিলের অভাব না থাকা খুবই আশ্চর্যের বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা ছিল সেই তহবিল ব্যয় করা।’ প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থ অনেক সুবিধাভোগীর কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। ফলে এখানেও সমস্যা রয়ে গেছে বলে তিনি মনে করেন।

সর্বশেষ খবর