ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ২০১৮ সাল থেকে ফাঁস হতে থাকে নিয়োগের প্রশ্নপত্র। জনতা ও রূপালী ব্যাংকের দুজন কর্মকর্তাসহ ১৫ জনের গত বছর ১০ নভেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে ২৫ কোটি টাকা আয় করার তথ্য পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ৮ জুন রাজধানীর বাড্ডা থানায় ওই ১৫ জনের নামে মানি লন্ডারিং আইনে সিআইডির করা মামলায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে। তদন্তের পর টাকার পরিমাণ আরও বাড়তে পারে বলেও জানানো হয়েছে। তবে ডিবি পুলিশের মামলা-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম সদস্য হলেন রূপালী ব্যাংকের জানে আলম, আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকেনোলজির দেলোয়ার, পারভেজ ও মুক্তারুজ্জামান। দেলোয়ার ছিলেন আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির অফিস সহকারী। ব্যাংকসহ বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছাপার দায়িত্ব পায় এ বিশ্ববিদ্যালয়। প্রশ্নপত্র ছাপা হতো আহছানিয়া মিশনের নিজস্ব ছাপাখানায়। সেখানে নজরদারি ও নিরাপত্তার অভাব ছিল। এ সুযোগে দেলোয়ার লুকিয়ে সেখান থেকে প্রশ্ন নিয়ে আসতেন। তিনি অন্তত চার-পাঁচটি নিয়োগ পরীক্ষার প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র এনেছিলেন। আর পরীক্ষার আগে রূপালী ব্যাংকের শামসুল হক প্রশ্নপত্র পাওয়ার পর তা সমাধান করে চুক্তিবদ্ধ পরীক্ষার্থীদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। সিআইডির মানি লন্ডারিং মামলায় এদের সবাইকে আসামি করা হয়েছে। মামলার আসামিরা হলেন- জনতা ব্যাংকের অফিসার সিরাজগঞ্জের শামসুল হক শ্যামল, রূপালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার সিরাজগঞ্জের জানে আলম মিলন, আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির টেকনিশিয়ান দিনাজপুরের মুক্তারুজ্জামান রয়েল এবং জামালপুরের রাইসুল ইসলাম স্বপন। এ ছাড়া রাজশাহীর দেলোয়ার হোসেন, দিনাজপুরের পারভেজ মিয়া, রাজশাহীর মোবিন উদ্দিন, রংপুর কোতোয়ালির রাশেদ আহমেদ বাবলু, একই এলাকার মিজানুর রহমান মিজান, কুড়িগ্রামের রবিউল ইসলাম রবি, রংপুরের জাহাঙ্গীর আলম জাহিদ, জামালপুরের আবদুল্লাহ আল জাবের জাহিদ, মানিকগঞ্জের রবিউল আউয়াল, ঠাকুরগাঁও সদরের রবিউল আউয়াল ও টাঙ্গাইলের কায়ছার আলম।
এর আগে ডিবির তদন্ত কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, ডিবির তেজগাঁও অঞ্চলের একজন সদস্য ছদ্মবেশে পরীক্ষার্থী সেজে প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম হোতা রাইসুল ইসলাম ওরফে স্বপনকে অগ্রিম টাকা পরিশোধ করলে পরীক্ষার্থীকে বুথে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে পরীক্ষার উত্তরপত্রসহ রাইসুলকে হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয়। রাইসুলের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে চক্রের হোতা মুক্তারুজ্জামান রয়েলসহ অন্যদের গ্রেফতার করা হয়। রাজধানীর বাড্ডা, ভাটারা, উত্তরা, মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুর, রূপনগর, মিরপুর, মাতুয়াইল, শেওড়াপাড়া, শেরেবাংলা নগর ও পলবী এলাকায় বুথ বসিয়ে (যেখানে পরীক্ষার ৫-৬ ঘণ্টা আগে নিজস্ব লোকের মাধ্যমে) পরীক্ষার্থীদের ফাঁস করা প্রশ্ন ও উত্তরপত্র মুখস্থ করানো হয়। সিআইডির মানি লন্ডারিং মামলার বাদী সংস্থাটির এসআই মেহেদী হাসান এ প্রতিবেদককে জানান, তারা প্রাথমিকভাবে ২৫০ থেকে ৩০০ পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে টাকা নেওয়ার তথ্য পেয়েছেন। প্রায় সবার কাছ থেকে কিস্তিতে সর্বনিম্ন ৭ লাখ টাকা করে নেওয়া হয়েছে। প্রশ্নফাঁসের এসব টাকা রাশেদ তার স্ত্রী ও শাশুড়ির অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে অনেক জমিজমা কিনেছেন। অন্যরা এলাকায় ইটভাটা, ভেষজ ওষুধের কোম্পানি ও মাছের ঘের করেছেন। ডিবি সূত্র বলছে, গত বছর ৬ নভেম্বর রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়। পরীক্ষা অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটির অফিস সহকারী দেলোয়ার হোসেন গ্রেফতারের পর আদালতে দেওয়া ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে বলেছেন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক অধ্যাপক নিখিল রঞ্জন ধর প্রতিবার প্রশ্ন ছাপানোর পর একটি করে প্রশ্ন নিয়ে যেতেন। তদন্তে ওই অধ্যাপকের ব্যাংক হিসাবেও ১০ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পায় ডিবি। মূলত প্রশ্ন ছাপানোর প্রযুক্তিগত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক নিখিল রঞ্জন ধর। অভিযোগ ওঠার পর ওই বছর ২১ নভেম্বর অধ্যাপক নিখিল রঞ্জন ধরকে বুয়েটের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধানের পদ থেকে অব্যাহতি দেয় বুয়েট প্রশাসন। এ ছাড়া তাকে কোনো পরীক্ষায় দায়িত্ব পালন না করারও নির্দেশ দেওয়া হয়। এ বিষয়ে এসআই মেহেদী হাসান বলেন, অধ্যাপক নিখিলের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে যথেষ্ট লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। অথচ তিনি ব্যাংক নিয়োগ পরীক্ষার কোনো কমিটির সদস্য ছিলেন না। তবে তিনি দাবি করেছেন, এক্সটারনাল কমিটির সদস্য ছিলেন। আহসানউল্লাহ কর্তৃপক্ষও বলেছে, তিনি এক্সটারনাল কমিটির সদস্য ছিলেন। কিন্তু তারা কোনো কাগজপত্র দিতে পারেননি। বাংলাদেশ ব্যাংকও অধ্যাপক নিখিলের বিরুদ্ধে অস্বাভাবিক লেনদেনের প্রতিবেদন দিয়েছে। তার অ্যাকাউন্টে ১১ কোটি টাকা জমা হওয়ার তথ্য মিলেছে। সবগুলো আহসানউল্লাহ থেকে চেকের মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে। কী কারণে টাকা দেওয়া হয়েছিল সে সম্পর্কে তদন্ত চলছে। তদন্তে আমরা যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহের চেষ্টা করছি।
আইনের ফাঁকে পার পাচ্ছেন অভিযুক্তরা : আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১৩ বছরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) বিভিন্ন থানায় পাবলিক পরীক্ষা ও চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ বিভিন্ন অপরাধে ২০০টি মামলা হয়েছে। নিষ্পত্তি হয়েছে ৪৫টি মামলা। এর মধ্যে মাত্র একটিতে এক আসামির ৫ হাজার টাকা জরিমানা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশ্ন ফাঁসের যে আইন আছে তা পাবলিক পরীক্ষা-সংক্রান্ত। এখানে নিয়োগ পরীক্ষা-সংক্রান্ত কোনো কিছু বলা নেই। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন অভিযুক্তরা। এখন করণীয় হলো, নতুন অপরাধটা বিদ্যমান দন্ডবিধিতে একটা বা দুটা উপধারার মাধ্যমে যোগ করে দেওয়া। পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনটি-১৯৮০ সালের। প্রশ্নপত্র ফাঁস, বইপত্র কিংবা যান্ত্রিক উপায়ে পরীক্ষার্থীকে সহায়তা করা, অন্যের হয়ে পরীক্ষা দেওয়া, ভুয়া সার্টিফিকেট বানানো ও পরীক্ষায় বাধা দেওয়ার মতো অপরাধে এ আইনে মামলা করা হয়।