রবিবার, ২১ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা
বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত

আমদানি-নির্ভরতার মূল্য দিচ্ছে বাংলাদেশ

♦ তেল, গ্যাস, কয়লা ও বিদ্যুৎ আমদানি করতে হচ্ছে ♦ নিজস্ব উৎস অনুসন্ধানের চেয়ে আমদানিতে বেশি আগ্রহ

জিন্নাতুন নূর

খুবই ধীরগতিতে চলছে দেশের খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলন কার্যক্রম। জ্বালানি অনুসন্ধানেও নেই সঠিক কোনো পরিকল্পনা। এ জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সরকারের দিন দিন বাড়ছে আমদানি-নির্ভরতা। সম্প্রতি বিশ্ববাজারে সব ধরনের জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির কারণে সরকারকেও দিতে হচ্ছে বড় অঙ্কের ভর্তুকি। আর খরচ সামলাতে বারবার বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও তেলের দাম; যার মূল্য দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। সরকার চাহিদা মেটাতে এখন তেল, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), বিদ্যুৎ ও কয়লা আমদানি করছে। কিন্তু দেশীয় জ্বালানির জোগান না থাকায় এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য না আসায় আমদানি করা জ্বালানি দিয়েই বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ প্রয়োজনীয় কাজ করা হচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সার ও শিল্প উৎপাদনে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের নিজস্ব গ্যাস উত্তোলনের আগ্রহ খুব কম। এর চেয়ে আগ্রহ বেশি আমদানিকৃত জ্বালানিতে। কিন্তু উচ্চমূল্যের এই জ্বালানি ক্রয়ের সামর্থ্য সরকারের এখন নেই। সুতরাং কোনো অর্থেই আমদানি-নির্ভরতা যুক্তিসঙ্গত নয়।

তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্স জ্বালানির উৎস অনুসন্ধানে আশা দেখাতে পারছে না। কয়েক বছরে স্থলভাগে বড় কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়নি। সমুদ্রেও গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমে গতি নেই। ২০১৪ সালে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ মিটলেও বাংলাদেশ এখনো সমুদ্রসম্পদ বিষয়ে প্রাথমিক অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভের জন্য বিদেশি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ পেলেও দুই বছরেও কাজ শুরু করা যায়নি। অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে মজুদ গ্যাসক্ষেত্রগুলোর উৎপাদন কমেছে। দেশীয় সংকট সামলাতে সরকার বিদ্যুৎ আমদানিতেও জোর দিয়েছে। জ্বালানি নীতিতে দেশের মোট ব্যবহৃত বিদ্যুতের ১৫ শতাংশ আমদানির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যে, বর্তমানে ভারত থেকে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে নেপাল থেকেও জলবিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা আছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশে গ্যাসক্ষেত্রের সম্ভাবনা বিষয়ে বিভিন্ন বিদেশি এজেন্সি, অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান ও যেসব মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে এতে দেশের অনাবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র নিয়ে তিন-চারটি মূল্যায়ন হয়েছে। এগুলোতে বলা হয়েছে, দেশের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গ্যাস এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। এগুলো উত্তোলন করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হলে দেশে গ্যাস সংকট হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বর্তমান প্রশাসনের নিজস্ব গ্যাস উত্তোলনের আগ্রহ খুব কম। এর চেয়ে আগ্রহ বেশি আমদানি করা এলএনজিতে। কিন্তু এলএনজি ক্রয়ের সামর্থ্য সরকারের এখন নেই। সুতরাং কোনো অর্থেই আমদানি-নির্ভরতা যুক্তিসঙ্গত নয়। এটি সরকার ও দেশ কারও জন্য ভালো নয়। এখানে সরকারের উচ্চমহলে আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের অভাব রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মহল অভিজ্ঞ বিভিন্ন দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মূল্যায়নকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। ধারণা করা হচ্ছে এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান দায়িত্বপ্রাপ্তদের এলএনজি ক্রয়ের ব্যাপারে প্রভাবিত করছে।

ঝোঁক এলএনজি আমদানিতে : দেশের জ্বালানি খাত এককভাবে গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। জ্বালানির প্রায় ৭৩ শতাংশ মেটানো হয় গ্যাস থেকে। পেট্রোবাংলা বলছে, দেশে গ্যাসের মজুদ আছে ৩৫ দশমিক ৮০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। এর মধ্যে উত্তোলনযোগ্য ২৮ দশমিক ৪৭ টিসিএফ। ১৫ টিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। বাকি গ্যাস কয়েক বছরের মধ্যেই ফুরিয়ে যাবে বলে ধারণা জ্বালানি বিভাগের। ২০১৭ সালের গ্যাস খাতের মহাপরিকল্পনা অনুসারে ২০২৫ সালে দেশে গ্যাসের চাহিদা দাঁড়াবে ৪৪০ কোটি ঘনফুট। এ সময়ে চাহিদা যেমন বাড়বে, দেশীয় উৎপাদনও কমবে। এ অবস্থায় দেশীয় জোগান না বাড়ালে আগামীতে আমদানি করা এলএনজির ওপর নির্ভরশীলতা আরও বাড়বে। জ্বালানি-বিদ্যুৎ খাতে এলএনজির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। এই এলএনজির পুরোটাই আমদানি করতে হয়। এ জন্য টার্মিনাল নির্মাণ ও পাইপলাইন তৈরিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ মূলত কাতার ও ওমান থেকেই এলএনজি কিনে থাকে। এক বছর আগেও খোলাবাজারে (স্পট মার্কেট) প্রতি মেট্রিক মিলিয়ন ব্রিটিশ থারমাল ইউনিট এলএনজির মূল্য ছিল ৩ থেকে ৪ ডলার। তা এখন ৪০ ডলারের মতো। প্রাকৃতিক গ্যাসের বিকল্প হিসেবে এবং সংকট সামলাতে প্রতিদিন জাতীয় গ্রিডে আমদানি করা ৭৪৬ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি গ্যাস সরবরাহ করা হতো। কিন্তু দাম বাড়ায় সরকার এখন স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ রেখেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত এলএনজি আমদানিতে ভর্তুকি বাবাদ ৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়া হয়েছে। ১৩ জানুয়ারি ভর্তুকি বাবদ ৩২ হাজার ২১৯ কোটি টাকার চাহিদা পাঠিয়েছে পেট্রোবাংলা। এর মধ্যে এলএনজিতে ভর্তুকি চাওয়া হয়েছে ২৫ হাজার ২১৯ কোটি টাকা। বাকি ৭ হাজার কোটি টাকা চাওয়া হয় এনবিআরের পাওনা পরিশোধের জন্য। মার্চে জরুরি ভিত্তিতে ১ হাজার ১৯০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে পাঠায় পেট্রোবাংলা। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৩  মার্চ পেট্রোবাংলার অনুকূলে ১ হাজার কোটি টাকা ছাড় করা হয়।

বাড়বে কয়লা আমদানি : দেশে পর্যাপ্ত কয়লার মজুদ থাকলেও পরিবেশ ইস্যু, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতা ও ভূতাত্ত্বিক গঠনের কারণে কয়লা উৎপাদন কার্যক্রমও ঝুলে আছে। এ জন্য কয়লার ক্ষেত্রেও আমদানি-নির্ভর হতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে দেশে একাধিক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে এবং বেশ কিছু আগামীতে উৎপাদনে আসছে। পেট্রোবাংলার তথ্যে, দেশের পাঁচটি খনিতে ৭৯৬ কোটি টন কয়লার মজুদ থাকলেও শুধু বড়পুকুরিয়া খনি থেকে কয়লা তোলা হচ্ছে, যা দিয়ে বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চলছে। এ ছাড়া পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র চলছে ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা কয়লায়। উৎপাদনে আসার অপেক্ষায় আছে রামপাল ও মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এর বাইরে আরও কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ চলমান, যা আমদানি করা কয়লায় পরিচালিত হওয়ার কথা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্ববাজারে কয়লার দামও বৃদ্ধি পেয়েছে।

জ্বালানি তেলেও আমদানি-নির্ভরতা : প্রতি বছর দেশে ১০ থেকে ১২ শতাংশ হারে জ্বালানি তেলের চাহিদা বাড়ছে। বিশ্ববাজারে মূল্য বৃদ্ধির কারণে দেশে ৯ মাসে দুই দফা জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। দেশে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে ১০টি। এর বাইরে ৬৪টি কেন্দ্রে ব্যবহার করা হয় ফার্নেস অয়েল। এসব জ্বালানির পুরোটাই আমদানি-নির্ভর। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সূত্রে জানা গেছে, দেশের একমাত্র তেল পরিশোধন কারখানা ইস্টার্ন রিফাইনারির তেল পরিশোধন করার সক্ষমতা বছরে মাত্র ১৫ লাখ টন। কিন্তু দেশে তেলের চাহিদা ৬০ লাখ টন। ডিজেল, অকটেন, পেট্রোলসহ বাকি ৪৫ লাখ টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়। কুয়েত, মালয়েশিয়া, চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিশ্বের আটটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বিপিসিকে তেল সরবরাহ করে। চাহিদার পুরো ডিজেল যদি দেশে পরিশোধন করা যেত তাহলে বছরে ১০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হতো বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। কিন্তু তেল পরিশোধনের চেয়ে আমদানিতেই ঝোঁক বেশি বিপিসির। সংস্থাটির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বর্তমানে দেশের চারটি প্রতিষ্ঠান জ্বালানি তেল রিফাইনারির কাজ করছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আমরা মূলত পাই অকটেন, পেট্রোল ও সামান্য কিছু ডিজেল। জ্বালানি তেলের চাহিদার ৮-১০ শতাংশ এই দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পূরণ করছে। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী বিপিসি এ প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে তেল কিনতে চুক্তিবদ্ধ। দেশীয় কোম্পানিগুলোকে দেশের চাহিদা অনুযায়ী যদি জ্বালানি তেল উৎপাদনের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়, তাহলে আমদানি-নির্ভরতা কমে আসবে কি না- এ প্রশ্নে বিপিসির চেয়ারম্যান একমত পোষণ করে বলেন, ‘দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো জ্বালানি তেল উৎপাদন বাড়ালে অবশ্যই আমদানি-নির্ভরতা কমে আসবে। তবে উৎস না থাকায় বিপিসিকে ক্রুড অয়েল আমদানি করতেই হবে। সে ক্ষেত্রে আমদানির ধরনটি পাল্টাবে। এতে বিপিসি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে হলে সরকারকে গ্যাসক্ষেত্র থেকে কনডেনসেট পাওয়ার জন্য উদ্যোগ বাড়াতে হবে। এর জন্য বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন।’ আমাদের এখানে যথেষ্ট কনডেনসেট প্লান্ট রয়েছে। কিন্তু জ্বালানি তেল উৎপাদনকারীরা চাহিদা অনুযায়ী তা পাচ্ছেন না।’

দেশীয় সংকট সামলাতে সরকার বিদ্যুৎ আমদানিতেও জোর দিয়েছে। জ্বালানি নীতিতে দেশের মোট ব্যবহৃত বিদ্যুতের ১৫ শতাংশ আমদানির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যে, বর্তমানে ভারত থেকে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে নেপাল থেকেও জলবিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা আছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর