শনিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

আত্মহত্যায় হত্যার রহস্য

থানার দুর্বল তদন্ত রিপোর্ট বদলে যায় পিবিআইতে

মাহবুব মমতাজী

আত্মহত্যায় হত্যার রহস্য

লাশ উদ্ধারের পর থানা পুলিশের তদন্ত রিপোর্টে লেখা হয় আত্মহত্যায় মৃত্যু। কিন্তু পুলিশেরই আরেকটি সংস্থার অধিকতর তদন্তে মৃত্যুরহস্য মোড় নেয়; বেরিয়ে আসে সেটি ছিল হত্যা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সঠিক ময়নাতদন্তের রিপোর্ট বিশ্লেষণেই মূলত বেরিয়ে আসে মৃত্যুর সঠিক কারণ।

২০২০ সালের ২৮ জুন ওয়ারীর গোয়ালঘাট লেনের ৫৮ নম্বর বাড়ির ষষ্ঠ তলায় রেশমা নামে এক নারীর ঝুলন্ত লাশ পাওয়া যায়। ২০১৬ সালের ২৩ এপ্রিল রাজশাহীর বোয়ালিয়া মডেল থানায় আরেক নারীর ঝুলন্ত লাশ পাওয়া যায়। অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় ২০১৭ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানায় একটি মামলা হয়। এমন ১২টি ঘটনায় আত্মহত্যার রহস্য খুঁজতে গিয়ে হত্যার তথ্য বেরিয়ে আসে। এসব ঘটনার সঠিক তথ্য বেরিয়ে এসেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তথ্যে।

পিবিআই বলছে, অধিকতর তথ্য-বিশ্লেষণে হত্যার রহস্য মিলেছে। সঠিক ময়নাতদন্ত নিশ্চিত করতে সংস্থাটি চলতি বছরের জুনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ১৪টি সুপারিশ পাঠিয়েছে।

পিবিআই-প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘হত্যার ঘটনায় ময়নাতদন্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ক্ষেত্রে মর্গে অবকাঠামো, আধুনিক যন্ত্রপাতি, অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতা না থাকায় ময়নাতদন্তে ভুল হওয়ার ঘটনা ঘটে। আমরা কিছু সুপারিশ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। সে বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।’

আত্মহত্যায় হত্যার রহস্য পাওয়া কয়েকটি ঘটনার মধ্যে পুরান ঢাকার ওয়ারী থেকে ২০ বছর বয়সী রেশমা নামে এক গৃহবধূর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধারের ঘটনাটি অন্যতম। ওয়ারী থানার তদন্তের প্রায় ছয় মাস পর আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা। সেখানে বলা হয়েছিল, ওই গৃহবধূ দাম্পত্য কলহের জেরে আত্মহত্যা করেছেন। আর আত্মহত্যার প্ররোচনায় তার স্বামীকে অভিযুক্ত করা হয়। পরে আদালত এর অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআইতে পাঠায়। এখানেও ছয় মাস পর সংস্থাটির তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে একটি সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করেন। কিন্তু এ তদন্তে বেরিয়ে আসে রেশমা আত্মহত্যা করেননি। তাকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এ হত্যায় তার স্বামী রবিনকে অভিযুক্ত করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রথমে মামলাটি তদন্ত করেন ওয়ারী থানার এসআই রঞ্জিত সরকার। পরে এর তদন্তভার দেওয়া হয় একই থানার এসআই আবদুল খালেক মিয়াকে। ২০২০ সালের ২৪ ডিসেম্বর তিনি ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পান। এরপর গত বছর ২৭ জানুয়ারি আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। পরে মামলার বাদী মনু হাওলাদার আদালতে নারাজি দিলে তা অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআইতে পাঠানোর আদেশ দেন বিচারক। পিবিআইর অর্গানাইজড ক্রাইম দক্ষিণের পরিদর্শক রওশন আলী গত বছর ২ ডিসেম্বর আদালতে সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করেন। ২৬ ডিসেম্বর আদালত তা গ্রহণ করেন। দুই তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। এসআই আবদুল খালেক মিয়া বলেন, ‘ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন অনুযায়ী আমি আত্মহত্যার কথা উল্লেখ করেছি।’ পিবিআইর তদন্ত কর্মকর্তা রওশন আলী বলেন, ‘আমরা সব দিক বিশ্লেষণ করে তদন্ত করেছি এবং সবকিছুর যুক্তি তুলে ধরেছি। এতে হত্যার প্রমাণ পাওয়া যায়।’ পিবিআই-সূত্র বলছেন, সুমাইয়া নাসরীন (২১) নামে এক নারীর লাশ উদ্ধারের ঘটনায় রাজশাহীর বোয়ালিয়া মডেল থানায় ২০১৬ সালের ২৩ এপ্রিল একটি মামলা হয়। পরে মামলাটি তদন্ত করে পিবিআই রাজশাহী জেলা। তদন্তের পর সংস্থাটি আহসান হাবীব (২০), রাহাত মাহমুদ (২১), আল আমিন (২২), বোরহানুল কবির উৎস (২২)- এ চারজনকে গ্রেফতার করে। তার মধ্যে দুজন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। প্রথমে থানা পুলিশ তদন্তে মৃত্যুর কারণ হিসেবে আত্মহত্যা উল্লেখ করে। কিন্তু আসামিদের দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও সাক্ষ্য-প্রমাণে পিবিআইর তদন্তে হত্যার প্রমাণ পাওয়া যায়। মামলাটি বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন। মোনায়েম খান ওরফে মোনায়েম মেম্বার নামে এক ব্যক্তির ঝুলন্ত লাশ উদ্ধারের ঘটনায় ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানায় ২০১৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি একটি মামলা হয়। প্রথমে থানা পুলিশ তদন্ত করে আত্মহত্যা বলে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে। পিবিআইর তদন্তে বেরিয়ে আসে, ইউপি নির্বাচনে পরাজিত মেম্বার পদপ্রার্থী কাইয়ুম, চিরাতল বিল পানি ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বী আকরামসহ ১১ জন একটি বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে ডেকে নেন মোনায়েমকে। সেখানে খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে গলা টিপে তাকে হত্যা করা হয়। পরে লাশ একটি গাছের ডালের সঙ্গে রশিতে ঝুলিয়ে রেখে আত্মহত্যা বলে প্রচার করা হয়।

পিবিআইর সুপারিশে যা বলা হয়েছে : ১. ফরেনসিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া ২. ফরেনসিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পদায়ন ৩. মর্গে পর্যাপ্ত মর্গ অ্যাসিস্ট্যান্ট (নারীসহ) এবং পরিচ্ছন্নতা কর্মীর পদ সৃষ্টি ও পদায়ন ৪. অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও ময়নাতদন্তের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ ৫. মৃত্যুর সম্ভাব্য সময় নির্ধারণের জন্য আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর যন্ত্রপাতির সুবিধাদি নিশ্চিতকরণ ৬. বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে বোর্ড গঠন করে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা ৭. মতামতের ভিন্নতা নিরসনে বিশেষ বোর্ড গঠন ৮. ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ দিয়ে পুলিশ সদস্যদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান ৯. পূর্ণাঙ্গ ফরেনসিক ল্যাব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া ১০. ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের সাক্ষ্য প্রদান সংক্রান্তে আইন মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর উইংয়ের পরামর্শ নেওয়া ১১. ময়নাতদন্ত বা ভিসেরা রিপোর্টে সহজবোধ্য শব্দচয়নে অভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন ১২. ময়নাতদন্তের জন্য কবর থেকে লাশ উত্তোলনের ক্ষেত্রে নীতিমালা প্রণয়ন ১৩. আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে বিশেষজ্ঞ ফরেনসিক ডাক্তার নিয়োগ এবং ১৪. মর্গ ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর