রবিবার, ২২ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

হত্যার পাঁচ বছর পর উদ্ধার হাড়গোড় পরিচয় বেরিয়ে এলো যেভাবে

খুন হয় যুবলীগ নেতার নির্দেশে

নিজস্ব প্রতিবেদক

হত্যার পাঁচ বছর পর উদ্ধার হাড়গোড় পরিচয় বেরিয়ে এলো যেভাবে

হত্যার শিকার রাজীব

যশোরের পুরনো কসবা এলাকায় ঘটা একটি হত্যার ঘটনা।  ২০২১ সালের ৩০ মে। ওই এলাকার বাসিন্দা বজলুর রহমানের জমিতে ভবন নির্মাণের কাজ চলছিল। মাটি খুঁড়তে গিয়ে পুরনো এক শৌচাগারের পাটাতনের নিচে পাওয়া যায় ড্রাম। এর ভেতরে ছিল মানুষের হাড়গোড়। খবর জানার পর পুলিশ এ নিয়ে তদন্ত শুরু করে।

এ ঘটনার ছায়াতদন্ত করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) জানতে পারে, হাড়গোড় উদ্ধারের আট মাস আগে সেখানে একটি ক্লাব তৈরি করেন স্থানীয় যুবলীগ নেতা শেখ সজীবুর রহমান (৩৫)। তার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত রিকশাচালক আবদুস সালাম (৫৫) নিরিবিলিপাড়ায় থাকতেন।

হাড়গোড় উদ্ধারের পর তিনি পাড়ার বাসা ছেড়ে চলে গেলে তাকে ও সজীবুরকে ঘিরে সন্দেহ তৈরি হয়। সন্দেহভাজন হিসেবে পুলিশ তাদের ওপর নজরদারি শুরু করে। 

পিবিআই জানতে পারে, এলাকায় চায়ের দোকান করেন হাসমত নামে এক ব্যক্তি। রাজীব হোসেন (৩২) নামে তার     এক ভাতিজা সাত বছর ধরে নিখোঁজ। উদ্ধার হাড়গোড়ের ডিএনএ পরীক্ষা করে পিবিআই রাজীবের পরিচয় নিশ্চিত হয়। পরে পিবিআই সন্দেহভাজন আবদুস সালামকে গ্রেফতার করলে তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। রাজীব হোসেনের হাড়গোড় উদ্ধারের ঘটনায় দায়ের হওয়া হত্যা মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তার দায়িত্ব পেয়েছেন পিবিআইর যশোর জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) রেশমা সুলতানা। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, হাড়গোড় উদ্ধারের ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে আবদুস সালামকে গ্রেফতার করার খবর জানাজানি হওয়ার পর আরেকটি হত্যা মামলার আসামি হিসেবে সজীবুর রহমান যশোরের আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। তিনি এখন কারাগারে। পুলিশের ভাষ্য, তাদের জিজ্ঞাসাবাদে ও আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে আবদুস সালাম বলেন, সজীবুরের নির্দেশ ও পরিকল্পনায় ছয়-সাতজন মিলে রাজীবকে শ্বাস রোধ করেন। এরপর রাজীবের লাশ একটি ড্রামে ঢোকানো হয়। ড্রামটি নিজের রিকশায় করে নিয়ে তিনি নিরিবিলিপাড়ার একটি শৌচাগারের পাটাতনের নিচে ফেলে দেন। পিবিআই সূত্র জানায়, রাজীবের বাড়ি খুলনার দীঘলিয়ার চন্দনীমহলে। যশোরের কোতোয়ালি থানাধীন নিরিবিলিপাড়ায় রাজীবের চাচা হাসমত আলীর চায়ের দোকান। দোকানের কাছেই সজীবুরের ক্লাব। রাজীব ওই ক্লাবের কর্মচারী ছিলেন।  ২০১৬ সালের ২৯ মার্চ রাতে রাজীব তার বাবা ফারুক হোসেনকে মুঠোফোনে বলেন, তিনি খুলনায় তাদের বাড়ি যাচ্ছেন। কিন্তু খুলনার বাড়িতে না গেলে রাজীবের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার মুঠোফোন বন্ধ পান তিনি। এরপর ফারুক হোসেন তার ভাই হাসমতের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারেন, তিনিও রাজীবকে খুঁজে পাচ্ছেন না। এর কয়েক দিন পর পরিবারের সদস্যরা রাজীবের সন্ধানে যশোরে সজীবুরের বাসায় যান। তার কাছে রাজীবের সন্ধান চাইলে তিনি কিছু জানেন না বলে জানান। রাজীবের খোঁজ পেতে তার পরিবারের সদস্যদের মামলাও করতে বলেন সজীবুর। ছেলের খোঁজ না পেয়ে বাড়ি ফিরে যান রাজীবের মা মাবিয়া বেগম। এর পর থেকে রাজীবের ফেরার অপেক্ষায় ছিল তার পরিবার। রাজীবের বাবা ভ্যানচালক ফারুক হোসেন বলেন, ‘এত দিন অপেক্ষায় ছিলাম ছেলে ফিরে আসবে। কিন্তু একমাত্র ছেলের হত্যার খবর জানার পর থেকে তার মা কাঁদতে কাঁদতে শয্যাশায়ী। ওর ছোট বোন জ্ঞান হারাচ্ছে।’ পিবিআই কর্মকর্তারা বলেন, গত বছর ৩০ মে হাসমত আলী মুঠোফোনে ভাই ফারুককে নিরিবিলিপাড়ায় একটি বাড়ির শৌচাগারের পাটাতনের নিচে একটি প্লাস্টিকের ড্রামে মানুষের হাড়গোড় ও খুলি পাওয়ার কথা জানান। এ ঘটনায় ওই বছরের ১২ সেপ্টেম্বর ফারুক যশোরের পিবিআই জেলা কার্যালয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে উদ্ধার হওয়া হাড়গোড় কার তা শনাক্তের জন্য অনুরোধ করেন। এরপর ঘটনাটি নিয়ে তদন্ত শুরু করে পিবিআই। জিডির সূত্র ধরে পিবিআই আদালতের অনুমতি নিয়ে ফারুক ও তার স্ত্রী মাবিয়া বেগমের ডিএনএর নমুনা সংগ্রহ করে। এরপর নমুনা ও উদ্ধার হওয়া হাড়গোড় পরীক্ষার জন্য রাজধানীর মালিবাগে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়। পরীক্ষায় উদ্ধার করা হাড়গোড়ের সঙ্গে ফারুক হোসেন ও তার স্ত্রীর ডিএনএর মিল পাওয়া যায়। এতে করে উদ্ধার হাড়গোড় রাজীবের ও ঘটনাটি হত্যাকান্ড বলে নিশ্চিত হয় পিবিআই।

রাজীব হত্যায় জড়িত সন্দেহে ১৬ জানুয়ারি রিকশাচালক সালামকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠানো হয়। তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, রাজীব হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী সজীবুর। হত্যায় সহযোগী হিসেবে ইব্রাহিম ও জয়নাল আবেদিন ছাড়াও আরও দুই তিনজনের নামও উল্লেখ করেন তিনি। পরদিন ১৭ জানুয়ারি রাজীবের বাবা ফারুক হোসেন বাদী হয়ে যুবলীগ নেতা সজীবুর ও আরও ছয়-সাতজনের নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা করেন। এর পরদিন পিবিআই হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি ইব্রাহিম ও জয়নালকে গ্রেফতার করে। তাদের যশোর আদালতে তুলে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করে পিবিআই। আদালত শুনানির দিন ধার্য রেখে তাদের কারাগারে পাঠিয়েছেন। এদিকে কারাগারে থাকা সজীবুর রহমানকে ১০ দিনের রিমান্ডে নিতে আদালতে আবেদন করা হয়েছে। আদালত ২৩ জানুয়ারি তার রিমান্ডের আবেদন নিয়ে শুনানির দিন ধার্য রেখেছেন। মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা রেশমা সুলতানা বলেন, ‘হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী সজীবুরকে রিমান্ডে পাওয়া গেলে হত্যাকান্ডের প্রকৃত কারণ বেরিয়ে আসবে।’ নিহত রাজীবুরের বাবা ফারুক হোসেন বলেন, ‘আমি বৃদ্ধ মানুষ। এ বয়সে ভ্যান চালিয়ে অনেক কষ্টে চার সদস্যের পরিবার চালাচ্ছি। স্বপ্ন ছিল, ছেলে অভাব-অনটনের সংসারে আমাকে সহযোগিতা করবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল।’ ছেলে হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করেন তিনি ।

সর্বশেষ খবর