রবিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা
সরগরম সিটি নির্বাচনের মাঠ

জাহাঙ্গীরের চেয়ে তিন গুণ আয় বেশি আজমতের

নিজস্ব প্রতিবেদক ও গাজীপুর প্রতিনিধি

জাহাঙ্গীরের চেয়ে তিন গুণ আয় বেশি আজমতের

গাজীপুরে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খান (বাঁয়ে) স্বত্বন্ত্র মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র যাচাই বাছাই হবে রবিবার। এ নির্বাচনে মেয়র পদে অংশ নিতে ১২ জন প্রার্থী তাদের মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এদের মধ্যে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানের বার্ষিক আয় স্বতন্ত্র প্রার্থী সাময়িক বরখাস্ত মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি। দাখিল করা নির্বাচনী হলফনামায় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খান তাঁর বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন ৩১ লাখ ৬৫ হাজার ৫০৫ টাকা। অপর দিকে একই পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম তাঁর বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন সাড়ে ৯ লাখ টাকা।

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল বৃহস্পতিবার। শহরের বঙ্গতাজ অডিটোরিয়ামে স্থাপিত রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে মেয়র পদে প্রার্থিতার জন্য ১২ জন প্রার্থী তাঁদের মনোনয়নপত্র জমা দেন। নির্বাচনী আইন অনুযায়ী মনোনয়নপত্রের সঙ্গে আট ধরনের তথ্যসংবলিত হলফনামা জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে। হলফনামায় ভুল ও অসম্পূর্ণ তথ্য দিলে প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের রয়েছে বলে জানিয়েছেন গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ফরিদুল ইসলাম। হলফনামা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী অ্যাডভোকেট মো. আজমত উল্লা খান পেশায় আইনজীবী। তাঁর বার্ষিক আয় ৩১ লাখ ৬৫ হাজার ৫০৫ টাকা। এর মধ্যে তাঁর আইনজীবী পেশা থেকে বার্ষিক আয় ৬ লাখ টাকা। এর বাইরে শেয়ার সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক সুদ থেকে বার্ষিক আয় ৬২ হাজার ৫০৫ টাকা। কৃষি ও তৈরি পোশাকের তিনটি প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি বার্ষিক ২৪ লাখ ৩ হাজার টাকা সম্মানী ভাতা পান। এ ছাড়া লেখক হিসেবে দুটি বই বিক্রি করে ১ লাখ টাকা আয় দেখিয়েছেন হলফনামায়। অস্থাবর সম্পদের মধ্যে আজমত উল্লার হাতে নগদ রয়েছে ৪ লাখ ৩১ হাজার ৭৩৬ টাকা। স্ত্রীর কাছে রয়েছে ২ লাখ ৩৪ হাজার ৫০৬ টাকা। তাঁর নিজের কোনো গাড়ি না থাকলেও স্ত্রীর নামে একটি প্রাডো গাড়ি রয়েছে। আজমত উল্লা স্থাবর সম্পদের ক্ষেত্রে জানিয়েছেন, তাঁর কৃষি জমি নেই। অকৃষি জমি নিজের রয়েছে ১৪০ দশমিক ৬৩৭৯ শতাংশ এবং স্ত্রীর নামে রয়েছে ২৩৭ দশমিক ৮ শতাংশ। তাঁর ৭ শতাংশ জমির ওপর নির্মাণাধীন বাড়ি রয়েছে। অস্থাবর সম্পদের মধ্যে তাঁর নিজের ২০ তোলা ও স্ত্রীর ৩০ তোলা সোনা রয়েছে। এ ছাড়া আগে আজমত উল্লার নামে একটি হত্যা মামলাসহ তিনটি মামলা থাকলেও টঙ্গী থানার হত্যা মামলার চার্জশিট থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, অন্য দুটি মামলা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। অপরদিকে ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম মেয়র নির্বাচিত হন। এর তিন বছর পর ২০২১ সালের ১৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার হন তিনি। এরপর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাঁকে মেয়র পদ থেকেও সাময়িক বরখাস্ত করে। পরবর্তীতে তিনি আওয়ামী লীগে ফিরতে পারলেও তাঁর মেয়র পদের বহিষ্কারাদেশ আর প্রত্যাহার হয়নি। মেয়র পদে তিনি তিন বছর দায়িত্ব পালন করলেও বর্তমানে জাহাঙ্গীর আলমের আয় ও সম্পদ দুটিই কমেছে। জাহাঙ্গীর আলমের হলফনামা থেকে জানা গেছে, ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় দাখিল করা হলফনামায় জাহাঙ্গীর আলমের বার্ষিক আয় ছিল ২ কোটি ১৬ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। এ বছরের নির্বাচনে দাখিল করা হলফনামায় মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম তাঁর বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন সাড়ে ৯ লাখ টাকা। পাঁচ বছর আগে জাহাঙ্গীর আলমের কৃষি খাত থেকে আয় ছিল দেড় লাখ টাকা। এবার কৃষি খাত থেকে আয় দেখিয়েছেন ২ লাখ ২০ হাজার টাকা। বাড়ি ও দোকান ভাড়া বাবদ আয় ছিল ৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা, এবারও একই অঙ্ক দেখিয়েছেন। গতবার ব্যবসা থেকে আয় দেখিয়েছিলেন ৯৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। এবার সে আয় কমে ৩ লাখ টাকা হয়েছে। পাঁচ বছর আগে তাঁর স্থাবর সম্পদের মধ্যে কৃষিজমি ছিল ১৪.১৫ একর। এবার তাঁর কোনো কৃষি জমি নেই। আগে অকৃষি জমি ছিল ৩৩.৭১ শতাংশ। এবার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮১৫.২১ শতাংশ। আবাসিক সম্পদ ছিল ৭.৪৩ শতাংশ, এবার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪১.১৫ শতাংশ। জাহাঙ্গীর আলমের অস্থাবর সম্পদের মধ্যে তাঁর হাতে রয়েছে নগদ ৪০ লাখ টাকা। অথচ পাঁচ বছর আগে ছিল ৭ কোটি ৪৮ হাজার ৯৬ হাজার টাকা। আগে ব্যাংকে ছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার ৯৭১ টাকা। বর্তমানে তাঁর জমা আছে ৫০ হাজার টাকা। এবার তিনি তালিকাভুক্ত ও নন তালিকাভুক্ত শেয়ারের মূল্য দেখিয়েছেন অনারেবল টেক্সটাইলে ৪৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং জেড আলম এপারেলসে ২০ লাখ টাকা। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ দেখিয়েছেন ১০ লাখ টাকা। গত নির্বাচনে তিনি ব্যবসায় বিনিয়োগ দেখিয়েছিলেন ৭৫ লাখ ২৩ হাজার ৭৮৭ টাকা, সঞ্চয়পত্রে ১০ লাখ টাকা। এ ছাড়া জাহাঙ্গীরের দুটি গাড়ি, ৩৫ ভরি সোনা, একটি বন্দুক, একটি পিস্তল, ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী এবং আসবাবপত্র আগের মতোই রয়েছে। পাঁচ বছর আগে তার বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা না থাকলেও এবার তাঁর বিরুদ্ধে আটটি ফৌজদারি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা রয়েছে। জাতীয় পার্টি মনোনীত প্রার্থী গাজীপুর মহানগর কমিটির সভাপতি ও সাবেক সচিব এম এম নিয়াজ উদ্দিনের বার্ষিক আয় ৪ লাখ টাকা। জমি ও ব্যক্তিগত পরামর্শক হিসেবে এ আয় দেখিয়েছেন তিনি। তাঁর হাতে নগদ ১২ লাখ ১৯ হাজার ৯৩৪ টাকা এবং স্ত্রীর কাছে ৭৫ লাখ টাকা রয়েছে। তাঁর স্ত্রীর নামে পোস্টাল, সেভিংস সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্রে বা স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগ রয়েছে ৫৫ লাখ টাকা। স্থাবর সম্পদের মধ্যে তাঁর রয়েছে ৩.৬৬ একর কৃষি জমি ও ৭ বিঘা অকৃষি জমি। তাঁর অস্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে নগদ ১২ লাখ ১৯ হাজার ৯৩৪ টাকা। ব্যাংকে রয়েছে ২ লাখ টাকা এবং ৫০ ভরি সোনা। এ ছাড়া তাঁর স্ত্রীর রয়েছে ৯.৬ একর কৃষি জমি, ১০০ তোলা সোনা ও মোটর গাড়ি। তবে তাঁর ঋণ রয়েছে পৌনে ৩ কোটি টাকা। বিএনপি মনোনীত প্রার্থী এই নির্বাচনে না থাকলেও মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হাসান উদ্দিন সরকারের ভাতিজা সরকার শাহ্?নূর ইসলাম রনি। বছরে তিনি আয় করেন ৫ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। তাঁর হাতে নগদ টাকা রয়েছে ২৫ লাখ টাকা এবং স্ত্রীর কাছে রয়েছে ৬ লাখ টাকা। ব্যাংকে তাঁর জমা রয়েছে ১০ লাখ ৫৫ হাজার ৩০৮ টাকা। তাঁর ৫৩ ভরি সোনা রয়েছে। এ ছাড়া স্থাবর সম্পদের ঘরে তিনি কিছু উল্লেখ না করলেও ৬ শতাংশ জমি বন্ধক রেখে পূবালী ব্যাংক থেকে তিনি ঋণ নিয়েছেন ৪৭ লাখ ৪৯ হাজার ৪২৮ টাকা। এম বি এ সনদধারী এই প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে একটি ফৌজদারি মামলা বিচার পর্যায়ে রয়েছে। জেলা নির্বাচন অফিসার ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সহকারী রিটার্নিং অফিসার এ এইচ এম কামরুল হাসান জানান, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র যাচাই বাছাই হবে ৩০ এপ্রিল এবং প্রার্থিতা (মনোনয়নপত্র) প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ৮ মে। প্রার্থীদের প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হবে ৯ মে। ২৫ মে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। তিনি আরও জানান, এবারের নির্বাচনে মেয়র পদে ১২ জন প্রার্থী, সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে ২৯০ জন ও সংরক্ষিত ওয়ার্ড সদস্য পদে ৮২ জন তাদের মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন।

গাজীপুরে দায়িত্বে আওয়ামী লীগের ২৮ কেন্দ্রীয় নেতা : গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে বিজয়ী করতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে টিম গঠন করা হয়েছে। ২৮ সদস্যবিশিষ্ট এ টিমের প্রধান দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য, সাবেক মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম। সমন্বয়ক করা হয়েছে ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজমকে। প্রধান উপদেষ্টা করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ও গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম মোজাম্মেল হককে। সমন্বয়ক মির্জা আজম স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

২৮ সদস্যের দলে সদস্য হিসেবে আছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, সিমিন হোসেন রিমি; সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন, আইনবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট নজিবুল্লাহ হিরু, দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, মহিলাবিষয়ক সম্পাদক জাহানারা বেগম, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণালকান্তি দাস, বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক বেগম শামসুন নাহার, শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক মো. সিদ্দিকুর রহমান, সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সৈয়দ আবদুল আউয়াল শামীম, উপ-দফতর সম্পাদক সায়েম খান, কার্যনির্বাহী সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী আরাফাত, তারানা হালিম, সানজিদা খানম, আনোয়ার হোসেন, সাহাবুদ্দিন ফরাজী, ইকবাল হোসেন অপু, মোহাম্মদ সাঈদ খোকন, রেমন্ড আরেং ও নির্মল কুমার চ্যাটার্জি। গত ১৫ এপ্রিল স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের সভায় গাজীপুর সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে আজমত উল্লা খানের নাম চূড়ান্ত করা হয়। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৫৭টি ওয়ার্ডে মোট ভোটার ১১ লাখ ৮৪ হাজার ৩৬৩ জন। মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় ছিল ২৭ এপ্রিল। মনোনয়নপত্র বাছাই হবে আজ। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ৮ মে। ২৫ মে ভোট।

সর্বশেষ খবর