সরকারি গুদাম থেকে খাদ্যপণ্য চলে যাচ্ছে কালোবাজারে। সরকারি সিল সংবলিত মোড়ক পাল্টে খাদ্যপণ্য প্যাকেটজাত হচ্ছে অন্য কোম্পানির নামে। এসব পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করে অন্তত ২০টি চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। চক্রগুলো ঢাকার কেরানীগঞ্জ, রাজধানীর নন্দীপাড়া, পোস্তগোলা, কামরাঙ্গীরচর, শ্যামপুর এলাকায় বিভিন্ন সাইনবোর্ডের আড়ালে এরই মধ্যে অন্তত ১০টির অধিক গোডাউনও বানিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গুদামে দায়িত্বরত অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ম্যানেজ করে চক্রের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরেই গরিবের হক নিয়ে প্রতারণা করে আসছে। মজুদ করছে সাধারণ মানুষের জন্য বরাদ্দকৃত খাবার। এদিকে মেরাদিয়া এলাকার একটি বাসার নিচতলায় সরকারি খাদ্যপণ্যের গোডাউনের সন্ধান পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) মতিঝিল বিভাগের একটি দল। সেখান থেকে সরকারি মোড়ক পাল্টে খাদ্যপণ্য অন্যত্র সরবরাহ করার সত্যতা পেয়ে সেখানে অভিযানেরও প্রস্তুতি নিয়েছে তারা।
জানা গেছে, সারা দেশে টিসিবির (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) পণ্য বিক্রির জন্য ৭ হাজারের বেশি ডিলার রয়েছেন। আবার খাদ্য অধিদফতরের ওএমএসের পণ্য বিক্রি করছেন আড়াই হাজারের বেশি ডিলার। খাদ্যবান্ধব প্রোগ্রামের ডিলার রয়েছেন ১০ হাজার ১১০ জন। এরা বছরের চার মাসে ১০ লাখ পরিবারকে ১৫ টাকা কেজি দরে ৩০ কেজি চাল সরবরাহ করছেন। তবে কিছু অসাধু ডিলার এবং দুর্বৃত্ত সরকারি গুদাম-সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তির সহায়তায় দীর্ঘদিন ধরে তাদের অপকর্ম চালিয়ে আসছেন। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তেজগাঁও কেন্দ্রীয় গুদাম থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় খাদ্যপণ্য কালোবাজারে বিক্রির বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় হয়। র্যাব সে সময় একাধিক অভিযান পরিচালনা করে। পরবর্তীতে ২০১৯ সালের ২১ ডিসেম্বর র্যাব অভিযান চালিয়ে শ্যামপুরের দুই ডিলারের গুদাম থেকে সরকারি ৪৮ টন আটা ও ৪ টন চাল জব্দ করে। ওই ঘটনায়ও মামলা হয়।
সূত্র বলছে, মেরাদিয়ার এলাকায় আসাদুর রহমান নামের এক অসাধু ডিলার সরকারি চাল, আটা, ডাল মজুদ করছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। তবে সেই গোডাউনেই তিনি খাদ্য অধিদফতরের আটার বস্তা পাল্টে মেসার্স লক্ষ্যা ফ্লাওয়ার ইন্ডাস্ট্রিজের নামে ড্যানিশ মার্কা আটা এবং ময়দা, ডাল প্যাকেটজাত করছিলেন। সেখান থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পণ্য সরবরাহ করতেন তিনি। মেরাদিয়া এবং নন্দীপাড়া এলাকায় তার দুটি গোডাউন রয়েছে। তিনি তেজগাঁও কেন্দ্রীয় গুদাম থেকে চাল এবং আটা বের করে নিজের গোডাউনে মজুদ করতেন। আবার টিসিবির পণ্যগুলোও তিনি নানাভাবে সংগ্রহ করতেন। মেরাদিয়ার সেই গুদামে কোটি টাকার খাদ্যপণ্যের মজুদ পেয়েছে ডিবির টিম। গত রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ডিবি মতিঝিলের সেই টিম অভিযান চালাচ্ছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিবির এক কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, চক্রটি দীর্ঘদিন ধরেই ভয়ংকর এই অপকর্ম চালিয়ে আসছিল। এদের মতো অন্তত আরও ২০টি চক্র এ ধরনের কাজ করছে। গুদামের লোকজনকে ম্যানেজ না করে এ কাজ কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এরা গরিবের হক মেরে হাতিয়ে নিচ্ছিল কোটি কোটি টাকা।
অভিযানের বিষয়টি নিয়ে জানতে চাওয়া হয় খাদ্য অধিদফতরের সরবরাহ, বণ্টন ও বিপণন বিভাগের পরিচালক তপন কুমার দাসের কাছে। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত নই। কেন্দ্রীয় গুদামসহ সব গুদাম খাদ্য অধিদফতরের মাধ্যমে কঠোরভাবে মনিটরিং করা হয়। গাফিলতির কোনো সুযোগ নেই বলে মন্তব্য তার। সূত্র আরও বলছে, চক্রগুলোর সদস্যরা লাইসেন্সধারী। তারা বৈধভাবেই খাদ্যপণ্য নিজেরা গুদাম থেকে সংগ্রহ করেন। পরবর্তীতে কার্ডধারীদের পণ্য না দিয়ে নিজেরা গায়েব করে দেন। স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে কম মূল্যে খোলাবাজারে (ওএমএস) বিক্রির জন্য সরকারি আটা ও চাল নিয়ে যাওয়ার পর তা সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করা হয় না। আবার কেউ কেউ বাজারমূল্যের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম দামে তেল, চিনি, পিঁয়াজ ও মসুরের ডাল কেনার জন্য বিভিন্ন স্পটে স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের ঘনিষ্ঠ পরিচয়ে প্রতিদিন পণ্য কিনতে লাইনে ভাড়াটে লোক দাঁড় করিয়ে পণ্য সংগ্রহ করে নিচ্ছে। পরবর্তীতে এসব পণ্য বেশি দামে (বাজারমূল্যের চেয়ে কিছুটা কম দামে) পাড়া-মহল্লার মুদি দোকানে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে।
টিসিবির মুখপাত্র যুগ্ম পরিচালক মো. হুমায়ুন কবির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ ধরনের তথ্য আমার জানা নেই। চলতি মাসের ১৪ তারিখ থেকে কেবল তেল ও মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে। গত মাসের পণ্য এ মাসের ৪ তারিখ পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। ১ কোটির মতো কার্ডধারীকে পণ্য দিচ্ছে টিসিবি। দুই-তিন মাসের মধ্যে অ্যাপসের মাধ্যমে ডিলারদের মনিটরিংয়ের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
ওএমএসের পণ্য কালোবাজারি, গ্রেফতার : রাজধানীর ডেমরায় ওএমএস (ওপেন মার্কেট সেল) কর্মসূচির চাল ও আটা কালোবাজারির মাধ্যমে মজুদ ও বিক্রি করার অভিযোগে একজনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তার নাম মো. আসাদুজ্জামান। বুধবার আমুলিয়া মডেল টাউনের চেয়ারম্যানবাড়ি এলাকার একটি গোডাউন থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় গোডাউনের ভিতর থেকে ৭০০ বস্তা আটা, ৩০৭ বস্তা চাল ও ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। গতকাল এসব তথ্য জানান ডিবির মতিঝিল বিভাগের এডিসি আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, আসাদুজ্জামান তার সহযোগীদের নিয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে কালোবাজারির মাধ্যমে ওএমএসের চাল ও আটা সংগ্রহ করতেন। পরে সেগুলো প্যাকেট পরিবর্তন করে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নামে বস্তায় প্যাকেজিং করে বিক্রি করতেন। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে ডেমরা থানায় মামলা হয়েছে।