ভালো বেতন ও উন্নত জীবনের প্রলোভনের পাশাপাশি ৩ ঘণ্টায় পানিপথে পৌঁছানো হবে ইতালি। এমন আশ্বাস দেন মাদারীপুর সদর উপজেলার শিরখাড়া গ্রামের আলাই কারিকরের ছেলে জামাল কারিকর। এরপর লিবিয়া নিয়ে যুবকদের হাত-পা বেঁধে চালান নির্যাতন। মুক্তিপণের টাকা না পাওয়া পর্যন্ত সিনেমা স্টাইলে চলে মারধর। আর সেই ভিডিও দেখানো হয় পরিবারকে। শারীরিক নির্যাতনের দৃশ্য দেখে ভেঙে পড়ছে পরিবারগুলো। নির্যাতনে অনেকে প্রাণ হারান আবার কারও কারও ক্ষতের সৃষ্টি হয়ে ধরে পোকায়। এরপর দালালের মুক্তিপণের টাকা দিতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে ভিকটিমের পরিবারগুলো। প্রতিকার চেয়ে মামলা করলে শিকার হচ্ছে হয়রানির। উল্টো মিথ্যা মামলা দেওয়া হয় ভুক্তভোগীদের নামে।
এদিকে জামাল কারিকর এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, আমার নামে মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছে। আমার ছেলেকেই আমি অনেক টাকা খরচ করে ইতালি পাঠিয়েছি। আমি কাউকে হুমকি-ধমকি দেইনি। আমি একজন ব্যবসায়ী মানুষ।’
সরেজমিন জানা গেছে, শিরখাড়া ইউনিয়নের ঘুনসি গ্রামের হাসান হাওলাদার মাদারীপুর সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। ২০২২ সালে ভাগ্য বদলের আশায় ১৩ লাখ টাকায় স্পন্সর ভিসায় তার ইতালি যাওয়ার চুক্তি হয় একই এলাকার দালাল জামাল কারিকরের সঙ্গে। প্রথমে দুবাই, পরে লিবিয়ায় নিয়ে জামাল কারিকর বিক্রি করে দেন মাফিয়ার কাছে। সেখানে ৫ লাখ টাকার জন্য চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন। বর্তমানে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। একই গ্রামের রুহুল শেখ মারা গেছেন দালাল চক্রের নির্যাতনে। এ গ্রামের মিন্টু হাওলাদার প্রায় ১৮ মাস আগে ইতালি যাওয়ার জন্য বাড়ি ছাড়েন। টাকার জন্য তাঁকেও করা হয়েছে অমানবিক নির্যাতন। মিন্টু হাওলাদারকে জীবিত উদ্ধারের জন্য দালাল চক্রকে দেওয়া হয়েছে ২০ লাখ টাকা। এদিকে মিঠু দাসকেও একই দালালের কাছে জিম্মিদশায় গুনতে হয়েছে মোটা অঙ্কের টাকা। এমনকি এই দালাল ছাড়েননি বৃদ্ধ শাহ আলমকেও। শুধু হাসান হাওলাদার, মিন্টু হাওলাদার, মিঠু দাস, শাহ আলম নন; এভাবে অবৈধ পথে ইতালি যাওয়ার সময় লিবিয়ার মাফিয়াদের হাতে জিম্মি মাদারীপুরের শিরখাড়া এলাকার অর্ধশত যুবক। দালাল জামাল কারিকর আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় কেউ কিছু বলার সাহস পেত না। মামলা করে অনেক ভুক্তভোগী উল্টো জেল খেটেছেন। এ দালালের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন স্বজন ও এলাকাবাসী।
স্থানীয়দের দাবি, শিরখাড়া গ্রামের আলাই কারিকরের ছেলে জামাল কারিকর দীর্ঘদিন ধরে মানব পাচারের ভয়ংকর সিন্ডিকেট পরিচালনা করে আসছেন। ইউরোপে পাঠানোর লোভ দেখিয়ে অর্ধশতাধিক যুবককে লিবিয়ায় পাঠিয়ে সেখানে অমানবিক নির্যাতনের মাধ্যমে তাদের পরিবারের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা মুক্তিপণ আদায় করছে এ চক্র।
ভুক্তভোগী শাহ আলম মাতুব্বর বলেন, ‘জামাল ইতালি পাঠানোর কথা বলে ১২ লাখ টাকা নেয়। পরে লিবিয়ার মরুভূমিতে আটকে রেখে তার লোকজন আমাকে চাবুক দিয়ে পেটায়। আমি এর কঠোর বিচার চাই।’
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, জামাল কারিকরের বিরুদ্ধে মাদারীপুর সদরসহ বিভিন্ন থানায় ১০টির বেশি মামলা রয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই তিনি জামিনে বেরিয়ে এসে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। ভুক্তভোগী ও সাক্ষীদের ভয় দেখিয়ে উল্টো মামলা দিয়ে হয়রানি করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
ভুক্তভোগী হাসান হাওলাদারের মা রিনা বেগম বলেন, ‘ভিটামাটি বিক্রি করে টাকা দিয়েও মিলছে না মুক্তি। আমরা দালাল জামালের বিচার চাই।’
আরেক ভুক্তভোগী মিন্টু হাওলাদারের মা সাবিনা বেগম বলেন, ‘দালাল জামাল কারিকর আমার ছেলেকে লিবিয়ায় মাফিয়ার কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। শুধু আমার ছেলেকে নয়, এমন শতে শতে ছেলের জীবন ধ্বংস করেছে। জিম্মি করে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা।’
মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াদিয়া শাবাব বলেন, ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দালালের তালিকা করা হয়েছে। এ তালিকা জেলার বিভিন্ন হাটবাজারে টানিয়ে দেওয়া হবে।’