চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাফিক আহমেদ (রুপক) প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়ার পরপরই ছাত্রলীগের এক বহিষ্কৃত শিক্ষার্থীর দ্বারা বুলিং ও র্যাগিংয়ের শিকার হন। রুপককে গেস্টরুমে নিয়ে শুধু সালাম না দেওয়া এবং সিনিয়রকে খেয়াল না করার অজুহাতে তার জেলা নিয়ে অপমানজনক কথা শোনানো হয়। অশ্রাব্য গালিগালাজও করা হয়। এতে রুপক কান্নায় ভেঙে পড়েন। পরে একই শিক্ষার্থীকে গেস্টরুমে বসিয়ে ওই ছাত্রলীগ নেতা থাপ্পড় মারেন। পরের দিন তার জুনিয়রদের দিয়ে রুপককে মেয়েদের পোশাক পরিয়ে নাচ করানো এবং এর ভিডিও ধারণ করা হয়। এরপর সেই ভিডিও দেখিয়ে এখনো অন্য শিক্ষার্থীরা রুপককে ব্ল্যাকমেল করে আসছে। ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি। যখনই তারা এ শিক্ষার্থীকে দেখত, তখনই বিভিন্নভাবে বুলিং করার চেষ্টা করত। খেলার মাঠে নাম বিকৃত করে ডাকত, শারীরিকভাবে স্পর্শ করে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করত। শুধু সিগারেট কিনে না দেওয়ার কারণে তারা সবাই মিলে রুপককে মারধরও করেছিল। বাংলাদেশ প্রতিদিন-কে এই ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী বলেন, ‘এ ঘটনার পর আমি আর প্রতিকারের কোনো চেষ্টা করিনি, কারণ প্রতিবারই তাদের হুমকি ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে।’ জানা গেছে, রাজশাহী বিদ্যালয়ে গত ২ সেপ্টেম্বর জুলাই-৩৬ হলের ৯১ জন ছাত্রীকে রাতে দেরি করে ফেরার জন্য কারণ দর্শানোর নোটিস দেয় হল কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ওই ছাত্রীদের ‘বিনা পারিশ্রমিক যৌনকর্মী’ উল্লেখ করে ছাত্রদল নেতা আনিসুর রহমান মিলন কমেন্ট করেন। এ ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে ৩ সেপ্টেম্বর রাতে ওই হলের ছাত্রীরা বিক্ষোভ করেন এবং তার শাস্তি দাবি জানান। পরদিন দল থেকে আজীবন বহিষ্কৃত হন ওই নেতা। একই অপরাধে তার বিরুদ্ধে থানায় মামলার আবেদনও করে ছাত্রদল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশেষ গত ২২ সেপ্টেম্বর প্রথম বর্ষের (৫৪ ব্যাচ) নবীনবরণের দিনেই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ক্লাসরুমে পরিচিত হওয়ার নামে নবীন শিক্ষার্থীদের র্যাগিং দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সে সময় ভুক্তভোগী ৫৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা জানান, ৫৩তম ব্যাচের প্রায় ১৮-২০ জন এবং ৫২তম ব্যাচের কয়েকজন শিক্ষার্থী এ ঘটনায় জড়িত ছিলেন। তারা টানা আড়াই ঘণ্টা ধরে একটি কক্ষে আটকে রেখে ভুক্তভোগীদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন।
দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গত বছরের ৫ আগস্টের পর র্যাগিং ও বুলিং বন্ধ হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন এমন দাবি করে এলেও, প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে এখনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে র্যাগিং ও বুলিং সমানতালে চলছে। বাংলাদেশ প্রতিদিন দেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয়- ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে অনুসন্ধান করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় চারটির প্রতিনিধিদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে র্যাগিং বন্ধ হয়নি। শিক্ষার্থীরা এখন বেশি বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে নারী শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন। সাধারণ নারী শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, স্টাফ, ভবঘুরে দ্বারা নানারকম নিপীড়ন ও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল থাকলেও তা অনেকাংশেই অকার্যকর।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অনলাইন প্লাটফর্মগুলোতে প্রায়ই নারী শিক্ষার্থীরা কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের শিকার হওয়ার অভিযোগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন (ডাকসু) চলাকালে এ ধরনের ঘটনার পরিমাণ বেড়ে যায়। একইভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনের আগে সেখানকার নারী শিক্ষার্থীরাও সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং বিরোধী সেল গঠন করার পরও র্যাগিং বন্ধ হয়নি। আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গত তিন মাসে সাইবার বুলিং, হয়রানি ও নবীন শিক্ষার্থীদের র্যাগিংয়ের মোট ১১টি ঘটনা ঘটেছে বলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানিয়েছে।
সরকারি এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অফিশিয়াল গ্রুপ না থাকায় শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত অনিয়ন্ত্রিত একাধিক গ্রুপ তৈরি হয়েছে। সারা বছর গ্রুপগুলোকে কেন্দ্র করে সাইবার বুলিং, সাম্প্রদায়িক উসকানি ও গুজব ছড়ানো হলেও প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নেয় না। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল ও সাইবার সিকিউরিটি সেল কার্যকর করার জোর দাবি জানান। আঁচল ফাউন্ডেশনের চলতি বছর প্রকাশিত ‘বৈষম্যের শিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য’ শীর্ষক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ধর্মীয় কারণে, শারীরিক অক্ষমতার কারণে, জাতিগত পার্থক্যের কারণে এবং শারীরিক অবয়বের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষর্থীরা নেতিবাচক আচরণের শিকার হন। এর ফলে ভুক্তভোগীরা বিষণ্নতা, উদ্বিগ্নতা, ঘুমের সমস্যা, প্যানিক অ্যাটাক, একাকিত্ব অনুভব এবং হীনম্মন্যতায় ভোগেন। মানসিক সমস্যা তৈরির কারণে তাদের ক্লাস করা ও পড়ালেখায় মনোযোগ কমে যায়।
আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা তানসেন রোজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, র্যাগিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে একেবারে নেই তা বলা যাবে না। এখন র্যাগিংয়ের ব্যাপারে শিক্ষার্থীরা সচেতন হচ্ছেন। র্যাগিং-বুলিংয়ের পর শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিং সেবা দেওয়ার হারও খুব অপ্রতুল। গত বছর সাইবার বুলিংয়ের শিকার তিনজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যাও করেন।