বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক এ.কিউ.এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী নিউইয়র্ক হতে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক ঠিকানাকে দেওয়া সাক্ষাতকারে বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের সময় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে অগ্রগতি হয়নি একথা বললে ভুল বলা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সত্যিকারের গণতন্ত্রে ফিরলে তা হবে তার জন্য মঙ্গলজনক।’ একইসঙ্গে বাংলাদেশে প্রতিবাদী পদত্যাগের রীতি খুব একটা নেই বলেও মন্তব্য করেন সাবেক এই রাষ্ট্রপতি।
ইংরেজী নতুন বছরের প্রথম দিন সাক্ষাতকারসহ পত্রিকাটি বাজারে এসেছে। সাক্ষাতকারে তিনি বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতির আলোকপাত করেছেন। উল্লেখ্য, ১ জানুয়ারিতে বি. চৌধুরীর বয়স হয় ৮৫ বছর ৮০ দিন। সে আলোকে বর্তমানে তিনিই হচ্ছেন সবচেয়ে বয়ষ্ক সক্রিয় রাজনীতিবিদ।
নতুন বছরের কাছে আপনার প্রত্যাশা কি?
স্বাধীনতার সঙ্গে যখন গণতন্ত্র প্রযুক্ত হবে, তখনই বুঝবো সত্যিকারের স্বাধীনতা এসেছে। আশা করি নতুন বছরে সেই সাফল্য দেখবো।
নতুন বছরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সুবাতাস বইবে বলে মনে করেন কি?
বিশ্বাস করা সহজ নয়, তবুও আশা করতে দোষ কী?
নতুন বছরে বিশ্ব রাজনীতিতে বড় ধরণের কোনো পরিবর্তন আসবে কি?
খারাপের দিকে যেতে পারে বিশ্ব রাজনীতি।
বিএনপি কর্তৃক ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত কি সঠিক ছিল?
মোটেও ছিল না। বিএনপি মস্তবড় সুযোগ হারিয়েছে। সে জন্য জনগণ সাধারণভাবে হতাশ হয়েছে।
একাত্তরের ঘাতকদের বিচার নিয়ে বিএনপির অস্পষ্টতাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
অন্যদের কথা জানি না। অন্তত নিজের দলের যে দুইজন নেতার বিচার হলো, এ ব্যাপারে তাদের স্পষ্ট বক্তব্য আসা উচিত ছিল। তা হলে জনসমর্থন তো কমতো না।
বিএনপি আপনাকে অসম্মানজনক পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল। এরপরও আপনি বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে কাজ করছেন। ঐসব বাজে আচরণের কথা মনে হলে কীভাবে আপনি তা কন্ট্রোল করেন?
আপনার এই ধারণাটি সঠিক নয়। আমার দল কখনও বিএনপি জোটে যায় নাই। সুতরাং আপনার প্রশ্নের সাথে একমত পোষণ করি না। রাজনীতিতে সরকার বা দল থেকে পদত্যাগ করা, এটাকে দল বা যারা নেতৃত্বে আছেন, তাদের প্রতিবাদী বক্তব্য হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। আমাদের দেশে প্রতিবাদী পদত্যাগের রীতি খুব একটা নেই। ফলে গণতান্ত্রিক রাজনীতি এগুতে পারে না। আমি মনে করি রাজনীতিতে যারা বাজে আচরণ করে, যারা অগণতান্ত্রিক আচরণ করে, ভুল পথে এগোয়, তারাই আসলে ভুল করেন। একটি ভ্রান্তি হলেও রাজনীতিতে তার মাশুল নেতা এবং দলকেই দিতে হয়।
শেখ হাসিনা এবং বর্তমান সরকার সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী।
শেখ হাসিনার সরকারের সময় অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে অগ্রগতি হয়নি এ কথা বললে ভুল বলা হবে। সামাজিক, অর্থনৈতিক ইনডেক্স-এর মাপকাঠিতে বেশ কিছু অগ্রগতি হয়েছে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক ইনডেক্স-এ তাদের চরম ব্যর্থতা সারা পৃথিবী লক্ষ্য করেছে। হত্যা, গুম এগুলো কখনও সঠিক রাজনীতি হতে পারে না। গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে শতকরা ৫২ ভাগ প্রার্থীকে জবরদস্তি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত বলে ঘোষণা করা হলেও শতকরা ৫ ভাগের বেশিই ভোট দিতে যায়নি। এগুলোকে গণতন্ত্র বলে চালিয়ে নেওয়ার প্রয়াস একদিকে যেমন হাস্যকর, অন্যদিকে তেমনি রাজনীতির ইতিহাসে কলঙ্কজনক বলে চিহ্নিত হবে। বর্তমান সরকারের বহু মন্ত্রীই আসলে অনির্বাচিত। সুতরাং একটি অনির্বাচিত সরকার যা করছে তা বিধি সম্মত কিনা এটা ভবিষ্যতে চ্যালেঞ্জ হতে পারে। যারা সরকার বিরোধী তাদের মাঠে দাঁড়াতে দিবেন না, সরকারের পেটোয়া বাহিনী পুলিশ, র্যাব ব্যবহার করে তাদের কণ্ঠ চেপে ধরার চেষ্টা করবেন, এগুলো সঠিক রাজনীতি হতে পারে না। এ ধরণের রাজনীতির মাধ্যমে অর্জিত উন্নয়নের ফলাফল শেষ পর্যন্ত নেতিবাচক ফলাফল বয়ে আনে। শেখ হাসিনা রাজনৈতিকভাবে আবার যদি সত্যিকার গণতন্ত্রে ফিরে আসেন, তা হলে তার জন্য তা মঙ্গলজনক হবে। বহুল আলোচিত দুর্নীতি এবং সন্ত্রাসের পরও যেটুকু সাফল্য অর্জিত হয়েছে তা সম্মানজনকভাবে তুলে ধরতে পারবেন।
জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। আপনার ধারণা কি?
আমার ধারণা হচ্ছে, এটি একটি রাজনৈতিক খেলা। সরকারের যদি ইচ্ছা থাকতো তা হলে অনেক আগেই তাদের রাজনীতি বন্ধ করতে পারতো। আমার মনে হয়, তাদের মনে দুটি ভয়, প্রথমত জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ হলে এবং আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতি করলে এটা দমন করার শক্তি সম্পর্কে তারা নিজেরাই সন্দিহান। দ্বিতীয়ত অন্যদিকে জামায়াত- শিবিরের নেতা-কর্মীরা বিরোধী দলে প্রত্যক্ষভাবে যোগ দিলে (অন্য কোনো নামে অথবা নতুন দল করে) বিরোধী দলের রাজনৈতিক শক্তি বাড়াতে পারে। এই জন্যই সরকার দ্বিধাগ্রস্ত।
আপনি কী জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মীয় সকল সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে?
কোনো উগ্র বা ধ্বংসাত্মক রাজনীতিতে বিশ্বাসী দলসমূহ সম্পর্কে আমার খুব ভাল ধারণা নেই। কিন্তু এ ধরণের সংগঠন থাকলে সরকারের রাজনীতির নিরিখে জনগণের কাছে তাদের জনপ্রিয়তা হ্রাস করতে পারলে করুক। যদি এইসব দলকে জনগণ সমর্থন দেয় তা হলে তাদের নিষিদ্ধ করার আমি কে অথবা সরকারই বা কে? জনগণের সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে এত কথা বলেন, তারপরও..............।
নোবেল বিজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূসের সাথে পাশ্চাত্যের একটি সম্পর্ক রয়েছে। সেটিকে কাজে লাগাতে চায় বিএনপি। আপনি কী মনে করেন?
আমি মনে করি ড. ইউনুস নোবেল বিজয়ী একজন ভাল মানুষ। কিন্তু তিনি রাজনীতিতে এখনও সাফল্য প্রমাণ করতে পারেন নাই। দেশের মঙ্গলের জন্য যে কোনো দল তাকে ব্যবহার করলে ক্ষতি কি? অবশ্যই সেটা দেশের মঙ্গলের জন্য হতে হবে।
প্রধান বিরোধী জোট হিসেবে আপনারা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিতে কী সঠিক ভূমিকায় রয়েছেন?
আমরা বিরোধীদলের জোটে ছিলাম না এবং নাই। আমি তাদের কথা বলতে পারবো না। আমাদের দলের কথা বলতে হলে আমি বলবো, আমরা বর্তমান শ্রীলংকা সরকারের ভূমিকাকে (জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠায়) প্রশংসা করি এবং আমাদের দেশেও এ ধরণের ভূমিকা নেওয়া উচিত। বিকল্পধারা মনে করে ঘৃণা করে কেউ বড় হয় না এবং শ্রদ্ধা করে কেউ ছোট হয় না।
ভারতের সাথে বিএনপি জোটের বর্তমানের সম্পর্ক কী সুখকর?
তাদের জিজ্ঞাসা করুন। আমি তাদের প্রতিনিধি নই।
আপনি কী মনে করেন যে, বিএনপি জোট ক্ষমতায় এলে একাত্তরের ঘাতকদের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ হবে? অনেকে মনে করছেন যে, এখন যারা বিচার করছেন উল্টো তাদেরকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হতে পারে?
বর্তমান সরকারি দলের কেউ কেউ ৭১-এর ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকলে এবং তাদের বিচার শুরু হলে আমি অবাক হব না।
বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম বিশেষ করে মেধাবীরা রাজনীতি-বিমুখ হচ্ছে। এর কারণ কি?
যাদের মেধা আছে তারা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অন্যান্য কারণ খুঁজছে এবং অনেকেই স্বার্থক হয়েছে। অন্যদিকে রাজনীতির ধারা এবং প্রক্রিয়া সুখকর নয়। জেল-জুলুম, হুলিয়া লেগেই থাকে, গুম, হত্যা কম-বেশি চলছে। সবচেয়ে বড় কথা মেধার মূল্যায়ণ খুব কমই হচ্ছে। মেধাহীন নেতৃত্ব প্রায়ই উপরে উঠে আসে। অন্যদিকে মেধাবীরা পিছিয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের সিংহভাগ রাজনীতিকের সন্তানেরা বিদেশে লেখাপড়া করছে। অনেকের সন্তান দেশে না ফিরে বিদেশেই স্থায়ী বসতি গড়ছেন। এ ধরনের প্রবণতা সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?
ভাল লেখাপড়া, জ্ঞান অর্জন এবং জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টায় বিদেশে লেখা-পড়াকে আমি মোটেই নিন্দা করি না। অনেকের সন্তান দেশে না ফিরে বিদেশে স্থায়ী বসতি গড়ছেন- সাধারণভাবে এই প্রবণতা নিন্দার্হ। কিন্তু যাদের পরিবারের দেশে জীবনের নিশ্চয়তা কম এবং বিদেশে সুযোগ-সুবিধা বেশি তাদের অন্য ধরণের যুক্তি আছে।
রাষ্ট্রপতি থাকাকালে অত্যন্ত সুখকর স্মৃতি এবং খুবই বাজে স্মৃতি থাকলে তা পাঠকদের জানাবেন কী?
অন্যসময় জানাব।
প্রেসিডেন্ট জিয়া এবং বেগম খালেদা জিয়া সম্পর্কে আপনার সামগ্রিক মূল্যায়ন কী?
প্রেসিডেন্ট জিয়া মুক্তিযুদ্ধের অগ্রদূত। অত্যন্ত সৎ মানুষ এবং অসাধারণ দেশপ্রেমিক। তাঁর সঙ্গে কাজ করে আমার জীবনের একটা স্বর্ণময় অভিজ্ঞতা হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়াকে আমিসহ আরও কয়েকজন দেশের ক্রান্তিলগ্নে রাজনীতিতে নিয়ে আসি। এটা প্রয়োজন ছিল। যেহেতু বঙ্গবন্ধু কন্যা তার আগেই রাজনীতিতে নেমে গেছেন। তাদের সামগ্রিক সাফল্য জনগণ জানে।
তারেক রহমান সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন জানতে চায় পাঠকরা।
তিনি আমার চেয়ে অনেক জুনিয়র। তাঁর সম্পর্কে আমার কোনো বক্তব্য সাজে না।
বিডি-প্রতিদিন/০৩ জানুয়ারি, ২০১৫/মাহবুব