দেশের উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলার বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা অপরিবর্তিত থাকলেও অনেক জায়গা আবার নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে গাইবান্ধা, জামালপুর, কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইলের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। এতে করে এ সব অঞ্চলে লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। বন্যার কবলে পড়ে রবিবারই তিন জেলায় নারী-শিশুসহ মারা গেছে ছয় জন।
এদিকে, উত্তররাঞ্চলের পানি নামতে শুরু করায় ঢাকা বিভাগের কয়েকটি জেলায়ও ছড়িয়ে পড়েছে বন্যা। এর মধ্যে মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলার অনেক জায়গায় বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। একই সঙ্গে দেখা দিয়েছে ভাঙন। রবিবারই পদ্মার ভাঙনের এ সব অঞ্চলের কয়েক হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে।
মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের ভাগ্যকুল ও লৌহজংয়ের মাওয়া পয়েন্টে পদ্মার পানি বিপদসীমার ৫৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার শ্রীনগর, লৌহজং, টঙ্গিবাড়ী ও সদর উপজেলার পদ্মা তীরবর্তী গ্রামসহ নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এতে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সদর উপজেলার বাদিয়াখালি ইউনিয়নের তালুক বুড়াইল (চুনিয়াকান্দি) এলাকায় রবিবার দুপুরে আলাই নদীর সোনাইল বাঁধ ধসে বোয়ালি, বাদিয়াখালি, সাঘাটার পদুমশহর, ফুলছড়ির কঞ্চিপাড়া এবং উদাখালীর বিস্তীর্ণ এলাকা নতুন করে তলিয়ে গেছে। ফুলছড়ি উপজেলার সব সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সদরের সঙ্গে জেলা শহরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে যমুনার পানি বিপদসীমার ১০১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। রবিবার সকালে মাদারগঞ্জ উপজেলার দাঁতভাঙ্গা সেতুন অ্যাপ্রোচ সড়ক ভেঙে উপজেলার সঙ্গে জেলা শহরের যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ইসলামপুর উপজেলার চরপুঁটিমারী গ্রামে বন্যার পানিতে ডুবে দুপুরে মনোয়ারা বেগম (৫৫) ও একই ইউনিয়নের বেনুয়ার চর নয়াপাড়া গ্রামের মরিয়ম বেগম (৫৩) নামের দুই নারীর মৃত্যু হয়েছে। কুড়িগ্রামে পানি কমতে শুরু করলেও নদীভাঙন তীব্র রূপ নিয়েছে। উপজেলার অনন্তপুর গ্রামে গত শনিবার নদীভাঙনে মারু চন্দ্র দাস নামের এক ব্যক্তি পানিতে ডুবে মারা গেছেন। ভেসে গেছে এই এলাকার অন্তত ২০টি ঘরবাড়ি ও ৫২টি গবাদিপশু। বিলীন হয়ে গেছে পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। নাগরাকুড়া গ্রামে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একশ' মিটার বাঁধ ভেঙে গুনাইগাছ ও বজরা ইউনিয়নের ১০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। চিলমারী উপজেলার সরকার পাড়া গ্রামে রবিবার কারেন্ট জাল তুলতে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা যান ওসমান হোসেন (৫৫) নামের এক ব্যক্তি। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে চিলমারী ডিগ্রি কলেজ মাঠসংলগ্ন পুকুর থেকে ফুটবল আনতে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা যায় নবম শ্রেণির ছাত্র নাজিম মিঞা (১৪)। সিরাজগঞ্জের কাজিপুর, শাহজাদপুর, চৌহালী ও বেলকুচি উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। যমুনা, করতোয়া, বড়াল, হুড়াসাগর এবং গোহালা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় শাহজাদপুরে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। উল্লাপাড়া উপজেলার মৈত্রবড়হর গ্রামের হুমায়ুন ইসলামের মেয়ে হাফজা (৩) ও কালিপুর গ্রামের সেলিম হোসেনের মেয়ে তৃষা (২) বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছে। এছাড়া গত শনিবার পাট জাগ দেওয়ার সময় সাপের ছোবলে মারা গেছেন মাটিকোড়া গ্রামের কৃষক শহিদুল ইসলাম (৪০)। আর ধনবাড়ীতে ঝিনাই ও বৈরান নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় মুশুদ্দি ইউনিয়নের কসাইবাড়ী বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে মুশুদ্দি, পাইস্তা, বলিভদ্র, ধোপাখালি ও হাদিরা ইউনিয়নের প্রায় অর্ধশত গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। কসাইবাড়ী বাঁধের প্রায় ১২শ' মিটার তলিয়ে গিয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে শতাধিক পরিবার।
এছাড়া, শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের ১৮টি গ্রামে পদ্মা নদীতে ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। দুইদিনের ভাঙনে গ্রামগুলোর ৪ শতাধিক পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। প্রায় পাঁচ‘শ একর ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে একটি বাজারের ৮০টি দোকান। বিদ্যালয়ের ভবন নদীতে বিলীন হওয়ায় পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
শরীয়তপুর পানিউন্নয় বোর্ড ও স্থানীয় সূত্র জানায়, গত সাত দিন ধরে পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধির কারণে নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলোতে ভাঙন শুরু হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার ও শনিবার পদ্মা নদীর ভাঙনে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার বিলাশপুর ইউনিয়নের সাতটি গ্রামের দুই‘শ পরিবার, বড়কান্দি ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রামের ৭৫টি পরিবার ও কুন্ডেরচর ইউনিয়নের ছয়টি গ্রামের ১৫০টি পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। গ্রামগুলোর প্রায় পাঁচ‘শ একর ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলো আশ্রয়ের জায়গা না পেয়ে খোলা আকাশের নীচে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
বিডি-প্রতিদিন/০১ আগস্ট, ২০১৬/মাহবুব