পদ্মায় স্মরণকালের ভয়াবহ লঞ্চ দুর্ঘটনার দুই বছর পূর্তি আজ। ২০১৪ সালের ৪ আগস্ট আড়াই শতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় পিনাক-৬ নামের লঞ্চটি। ৪৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। সরকারি হিসেবেই নিখোঁজ ৬১ জন। ঘটনার দুই বছর পার হয়ে গেলেও পাওয়া যায়নি ডুবে যাওয়া লঞ্চটির খোঁজ। এছাড়া উদ্ধার লাশের মধ্যে যে ২১ জনকে মাদারীপুরের শিবচরে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয় তাদের ১৮ জনের পরিচয় মেলেনি আজও। কেউ তাদের খোঁজ নিতেও আসেনি। কবরগুলো এখন ঢেকে গেছে লতাপাতায়। এদিকে দুই বছর পরও নিখোঁজদের পরিবারগুলোর দিন কাটছে আপনজন হারানোর নিদারুণ কষ্টে।
লঞ্চ দুর্ঘটনার এক সপ্তাহ পরে অত্যাধুনিক সোনার স্ক্যানার যন্ত্রের সাহায্যে খোঁজ করে ব্যর্থ হওয়ার পর আর কোনও অনুসন্ধান চালায়নি অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। স্থানীয়দের ধারণা, লঞ্চটি পদ্মার স্রোতের তোড়ে অনেক দূরে ভাটিতে চলে গেছে। এক সময় বালুর আস্তরণ পড়ে পদ্মার বুকেই চাপা পড়েছে সেটি। হয়ত নিখোঁজ অনেকের দেহও লঞ্চের সঙ্গে পদ্মার বুকেই সমাহিত হয়েছে।লঞ্চ উদ্ধারের ব্যাপারে সর্বশেষ নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান বলেছিলেন, লঞ্চ উদ্ধার করা বড় কথা ছিল না। বড় কথা ছিল নিহতদের মরদেহ পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়া। লাশ উদ্ধার করা হলেও তা শনাক্ত করা যায়নি। উদ্ধার কাজ করতে অনেক সময় চলে গেছে, তাই উদ্ধার তৎপরতা বাতিল করে দিয়েছি।
তিন বোন স্বর্ণা, হীরা ও লাকীর শেষ সেলফি।
ওই দুর্ঘটনায় বাবার সামনে সন্তান, সন্তানের সামনে বাবা-মা, ভাইয়ের হাত থেকে বোন, বোনের হাত থেকে ভাই, মায়ের বুক থেকে শিশুসন্তান ছুটে গিয়ে মুহূর্তেই তলিয়ে যায় গভীর পদ্মায়। মাদারীপুরের শিবচরে আপন দুই বোন স্বর্ণা ও হীরা এবং তাদের এক খালাতো বোন লাকীর লঞ্চ দুর্ঘটনার আগে ফেসবুকে দেওয়া ছবিটিই এখন শেষ স্মৃতি হয়ে আছে তাদের পরিবারের কাছে। বাবার সামনেই নদীতে ভেসে যায় দুই মেয়ে। হীরার লাশ পাওয়া গেলেও অপর দু'জনের লাশ পাওয়া যায়নি।
নিহত হীরা ও নিখোঁজ স্বর্ণার বাবা শিবচর পৌর এলাকার আব্দুল জলিল মাতুব্বর বলেন, মর্মান্তিক ওই দুর্ঘটনায় দুইবছর হয়ে গেল। কিন্তু এ কষ্ট আজও মেনে নিতে পারছি না। একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে, তবুও কারও টনক নড়ছে না। আর কোন বাবা-মায়ের বুক খালি হোক আমরা তা চাই না।
নিহত স্বর্ণা ও হীরার মায়ের দাবি, উদ্ধারের পর তার মেয়ে হীরা বেঁচে ছিল। যদি মাওয়া ঘাটে প্রাথমিক চিকিৎসা করানোর সুযোগ হতো তাহলে হয়তো সে প্রাণে বেঁচে যেত। মানুষের সেবার জন্য হীরা ডাক্তার হতে চেয়েছিল। আর সেই মেয়েটি চিকিৎসার অভাবে মারা গেল!
২০১৪ সালে ঈদ শেষে ঢাকা ফেরার সময় অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই থাকায় ৪ আগস্ট আড়াই শতাধিক যাত্রী নিয়ে পদ্মায় ডুবে যায় পিনাক-৬ লঞ্চটি। পাশের একাধিক লঞ্চের উৎসুক যাত্রীদের মোবাইল ফোনে তোলা ভিডিওতে সেই দৃশ্যের পুরোটাই ধরা পড়ে। চোখের সামনে ডুবে যায় শত শত মানুষ বোঝাই লঞ্চটি। কিছুক্ষণ চিৎকার-চেচামেচি শোনা যায়, এরপরই নিরব হয়ে যায় উন্মত্ত পদ্মা।
লঞ্চ দুর্ঘটনায় প্রায় অলৌকিকভাবে বেঁচে যান মাদারীপুরের শিবচরের বাখরেরকান্দি গ্রামের নূরুল আমিনের ৮ বছর বয়সী ছেলে সাঈদ ও ১৫ বছর বয়সী মেয়ে সাবিনা।
সাঈদের কথায়- ''লঞ্চ যহন দুলতেছিল তহন আমরা উপরে (ছাদে) উডি। লঞ্চ যহন ডুইব্যা যায় তহন আমরা নদীতে লাফ দেই। হেরপর হাতার (সাঁতার) কাইট্যা কিছু দূর যাওনের পর সিবোটওয়ালা আইয়া আমারে উডাইছে। ঘাটে নিয়া আমারে একটা চিপস খাইতে দিছে। এরপর দেহি আমার বোন ঘাটে। আমি তহন তাগো কইছি ওই যে আমার বোন। এরপর আমারে বাড়িতে নিয়া আইছে।''
পিনাক-৬ লঞ্চ দুর্ঘটনায় মাদারীপুরের কালকিনি ও শিবচর উপজেলার বেশ কয়েকটি পরিবারে ৩ থেকে ৪ জন করে নিখোঁজ রয়েছে। দুই বছর পার হয়ে গেলেও ফিরে আসেনি হারানো স্বজন। তারা জীবিতদের তালিকায়ও নেই, নিহতদের তালিকায়ও নেই। এতদিনে না আসায় তাদের ফেরার সম্ভাবনা একেবারে ক্ষিণ হয়ে গেলেও সেই ক্ষিণ আশায় বুক বেঁধে আছে পরিবারগুলো। হয়ত কোন সিনেমার গল্পের মতো একদিন ফিরে আসবে প্রিয় মানুষটি।
শিবচরের সন্নাসীরচর গ্রামের মৃত আনোয়ার মুন্সীর স্ত্রী সুরাতন নেছা দুর্ঘটনায় হারিয়েছেন তার ছেলে বিল্লাল হোসেন, মেয়ে শিল্পী আক্তার, মেয়ে জামাই ফরহাদ হোসেন ও নাতি ফাহিমকে। তাদের কারও লাশই পাওয়া যায়নি। লাশ না পাওয়ায় এই পরিবার ক্ষতিপূরণও পাননি।
চোখ মুছতে মুছতে সুরাতন নেছা বলেন, ''এই দুঘটনা আমার সব কাইড়া নিছে। পোলা, মাইয়া, জামাই, নাতি সব হারাইছি। অহনো আশায় বুক বাইন্ধ্যা আছি। আমরা গরীব মানুষ। দুর্ঘটনার পর টাকা-পয়সা ধার কইরা নিয়া হ্যাগোরে (হারানো স্বজনদের) খুঁজতে চারিদিকে দৌঁড়াইছি। পাই নাই। লাশও পাই না। কোন সাহায্যও পাই নাই। পোলাডা নাই। রোজগারের মানুষও নাই। অহন খাইয়া- না খাইয়া দিন কাডাই।''
এদিকে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক কামাল উদ্দিন বিশ্বাস জানান, দুর্ঘটনায় নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে এক লাখ পাঁচ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। একটি পরিবার টাকা নিতে রাজি হয়নি। এছাড়া নিখোঁজদের পরিবারের পক্ষ থেকে উপযুক্ত প্রমাণ সাপেক্ষে আবেদন করা হলে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ বা আবেদন করা হবে।
বিডি-প্রতিদিন/এস আহমেদ