শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) এমবিএর শিক্ষার্থী মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ এবং ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী ফারহান ফাইয়াজের মৃত্যু ঘিরে রহস্য সৃষ্টি হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই দুই শিক্ষার্থীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। এ ঘটনায় জামায়াত-শিবির ও বিএনপির নেতাকর্মীরা জড়িত থাকতে পারেন বলে অভিযোগ ওঠায় তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ।
এই দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের কথা বলা হচ্ছে।
এর মধ্যে মুগ্ধের মৃত্যু নিয়ে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাতও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘মীর মুগ্ধ, এই ছেলেটি ছাত্র আন্দোলনে শিবির ও ছাত্রদল ঢুকেছে বলে স্ট্যাটাস দেওয়ার পরদিনই কেন মারা গেল? তাকে কে মেরেছে, কেন মেরেছে? আমরা আন্দাজ করতে পারি। বিচার বিভাগের তদন্তের পর সবই বের হয়ে আসবে।’
এর আগে বিইউপির শিক্ষার্থী মুগ্ধ গত ১৮ জুলাই জামায়াত-শিবির-ছাত্রদলের কার্যক্রম নিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন।
ওই পোস্ট দেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আন্দোলনের মধ্যে চলা গুলিতে তাঁর মৃত্যু হয়। ফেসবুক পোস্টে মুগ্ধ লিখেছিলেন, ‘জামায়াত-শিবির, ছাত্রদলের উদ্দেশে কিছু কথা : ছাত্র আন্দোলনে ঢুকে ছাত্র আন্দোলনটাকে রাজনৈতিক দলের আন্দোলন বানাবেন না। হ্যাডম থাকলে আগেই আসতেন আপনারা। সুযোগ সন্ধানী আচরণ করে এই আন্দোলনের উদ্দেশ্যটা নষ্ট করবেন না, জাত চেনাবেন না।
আপনি যদি ছাত্র হন, তবে ছাত্র হয়েই আসুন। আমাদের আন্দোলনে ছাত্র প্রয়োজন, কোনো উদ্দেশ্য হাসিলকারী নেতা নয়।’
অভিযোগ উঠেছে, শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে প্রবেশ করে নাশকতা চালিয়ে ওই দায়ভার পুলিশের ওপর চাপাতে জামায়াত-শিবির, ছাত্রদলের কর্মীরা নিজেরাই কিছু মেধাবী শিক্ষার্থীকে টার্গেট করে আন্দোলনে নামিয়েছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পোস্ট দেখে টার্গেট করে তাদের ওপর হামলা চালায়। এই দুর্বৃত্তদের টার্গেটে যারা মারা গেছে, কৌশলে তাদের অনেকের মরদেহের ময়নাতদন্ত করতে দেওয়া হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জামায়াত-শিবির, ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা কিছু শিক্ষার্থীকে প্ররোচিত করে আন্দোলনে নামায়। এর মধ্যে শিক্ষার্থী ফারহান ফাইয়াজকে তার গৃহশিক্ষক ‘চা’ খাওয়ার কথা বলে ১৮ জুলাই ডেকে এনে আন্দোলনে নিয়ে যান বলে ফারহানের পরিবার দাবি করেছে। ওই দিনই ফারহান গুলিতে মারা পড়ে। পরে জানা গেছে, ফারহানের গৃহশিক্ষক ছাত্রশিবিরের নেতা।
একই দিন (১৮ জুলাই) রাজধানীর উত্তরা এলাকায় গুলিতে প্রাণ হারানো মুগ্ধের বন্ধু নাইমুর রহমান আশিক ওই দিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘উত্তরায় ছাত্রদের ওপর হামলা হচ্ছে শুনে তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য অন্য বন্ধুদের নিয়ে সেখানে যাই। ওই দিন আমরা আহত অনেককে হাসপাতালে নিয়ে গেছি। সন্ধ্যায় ছাত্রদের মধ্যে পানি ও বিস্কুট বিতরণ করে সড়ক বিভাজনে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। হঠাৎ রাজউক কমার্শিয়ালের সামনে থেকে গুলি আসতে থাকে। তখন সবার সঙ্গে আমরাও দৌড় দিই। তখন দেখি তাঁর (মুগ্ধ) কপালে গুলি লেগে ডান কানের নিচ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
গত বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর দুর্বৃত্তরা পুলিশ ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর পোশাক পরে হামলা চালিয়েছে। পরে এর দায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ওপর চাপানোর চেষ্টা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানায়, শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে প্রবেশ করে দুর্বৃত্তরা যে নাশকতা ও সহিংসতা চালিয়েছে তা এখন দেশের মানুষের কাছে স্পষ্ট। হামলাকারীরা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে সরকারি বহু স্থাপনায়। আর এই সহিংসতা ঠেকাতে পুলিশ সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। দুর্বৃত্তদের হাত থেকে জনগণের জানমাল ও রাষ্ট্রের সম্পদ রক্ষায় কোনোভাবেই পিছু হটেনি পুলিশ। দেশের সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে দুজন পুলিশ সদস্য ও একজন আনসার সদস্য নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১১ শতাধিক পুলিশ সদস্য।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ছদ্মবেশে প্রবেশ করে দুর্বৃত্তরা জনগণের জানমাল এবং রাষ্ট্রের সম্পদ ধ্বংসে যে নাশকতা চালিয়েছে, সেটি ঠেকাতে এবং নিজেদের রক্ষায় পুলিশ গুলি ছোড়ে। সেই গুলিতে বেশ কিছু প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। তবে সব গুলির ঘটনা পুলিশের কি না তা তদন্ত করে বের করা জরুরি। কারণ, নাশকতাকারীরাও পুলিশ ও সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে গুলি করে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে এমনটি করতে পারে।
অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষক ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘কোটা সংস্কারের আন্দোলনটা যৌক্তিক আন্দোলন ছিল। এক পর্যায়ে এই আন্দোলনে ঢুকে একটি শ্রেণি দেশজুড়ে জনগণ ও রাষ্ট্রের জানমালে নাশকতা চালায়। হামলা চালিয়ে কারাগারের কয়েদি ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এসব কোনো শিক্ষার্থীর কাজ নয়। দীর্ঘ সময় পরিকল্পনার পর নাশকতাকারীরা এসব কাজ করেছে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কাছে আগেই এ ধরনের তথ্য থাকার দরকার ছিল। তবে আন্দোলনে যেসব শিক্ষার্থী, পথচারী, বিভিন্ন পেশাজীবী মারা গেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের ময়নাতদন্ত হওয়া উচিত। কারণ, এতে বেরিয়ে আসবে পুলিশের গুলিতে কে, আর নাশকতাকারীদের গুলিতে কে মারা গেছেন।
তিনি আরো বলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উচিত প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে নাশকতায় জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। ছাড় পেয়ে গেলে নাশকতাকারীরা আবারও এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর সম্ভাবনা আছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, অনেকবার বিএনপি-জামায়াত গণতান্ত্রিক সরকারকে অবৈধভাবে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশকে অকার্যকর করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু পুলিশের তৎপরতায় তারা বারবার ব্যর্থ হয়েছে। এ জন্য তারা এবার পুলিশকে টার্গেট করেছে। পুলিশকে দুর্বল করতেই পরিকল্পিতভাবে হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে।
তিনি আরো বলেন, যারা পুলিশকে হত্যা করেছে, সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে, স্বপ্নের মেট্রো রেলসহ সরকারি স্থাপনায় নাশকতা চালিয়েছে, তারা যেখানেই থাকুক না কেন, তাদের ছাড় দেওয়া হবে না।
সূত্র: কালের কণ্ঠ