১৯৭১ সালে আমি ছিলাম চট্টগ্রাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত তরুণ এক অফিসার। লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুজিবুর রহমান, মেজর জিয়াউর রহমান প্রমুখের সানি্নধ্যে থাকার কারণে তখন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য হয়েও জনগণের পক্ষে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল। স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং সঠিক সময়ে বিদ্রোহ করে অস্ত্রশস্ত্রসহ সদলবলে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা ছিল খুবই রোমহর্ষক। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনীর ক্র্যাকডাউনের খবর আমরা নিজেদের মতো পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেজর জিয়ার নেতৃত্বে আমি সর্বপ্রথম অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করি। সে সময় বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন কর্নেল আবদুর রশিদ জানজুয়া এবং সহ-অধিনায়ক ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। বিদ্রোহের শুরুতেই কর্নেল জানজুয়াসহ মেজর আবদুল হামিদ, ক্যাপ্টেন আহমদ আলী, লেফটেন্যান্ট আজম, বিডিআর অফিসার ক্যাপ্টেন নজর নিহত হন। এ বিদ্রোহ ক্ষণিকের কোনো উত্তেজনা ছিল না, ছিল পরিকল্পিত বিদ্রোহের অংশ এবং এভাবেই আমরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। '৭১-এর ফেব্রুয়ারিতেই শৃঙ্খলাবাহিনীর পক্ষ থেকে আমরা পরিষ্কারভাবে জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমাদের প্রস্তুতির কথা জেনারেল এম এ জি ওসমানীর মাধ্যমে অবহিত করেছিলাম। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। পরে আমরা নিজেরা নিজেদের মতো করে বিদ্রোহের পরিকল্পনা করি। সিদ্ধান্ত নিই, জনগণের ওপর আঘাত এলে আমরা পাল্টা আঘাত করব। এ পরিকল্পনায় শরিক ছিলাম সিলেটের লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুজিবুর রহমান চৌধুরী, মেজর জিয়াউর রহমান ও আমি। অনেক পরে এর সঙ্গে আমিন আহম্মেদ চৌধুরীও যোগ দেন। পরিকল্পনামতো আমরা অপেক্ষায় ছিলাম সঠিক সময়টি বেছে নেওয়ার। বিদ্রোহের পর মেজর জিয়ার নেতৃত্বে আমরা প্রথমেই চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র দখল করি এবং বেতার থেকে মেজর জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং সবাইকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান। ঘোষণাটি ছিল নিম্নরূপ : 'আমি মেজর জিয়া, বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মির প্রাদেশিক কমান্ডার-ইন-চিফ, শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। আমি আরও ঘোষণা করছি যে আমরা শেখ মুজিবুর রহমানের অধীনে একটি সার্বভৌম ও আইনসিদ্ধ সরকার গঠন করেছি যা আইন ও সংবিধান অনুযায়ী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের সরকার জোটনিরপেক্ষ নীতি মেনে চলতে বদ্ধপরিকর। এ রাষ্ট্র সব জাতির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবে এবং বিশ্বশান্তির জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। আমি সব দেশের সরকারকে তাদের নিজ নিজ দেশে বাংলাদেশের নৃশংস গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি। শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার একটি সার্বভৌম ও আইনসম্মত সরকার এবং বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পাওয়ার দাবিদার।' এ ঘোষণা দেশে-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংগঠিত সব পক্ষকে বহুমাত্রিক প্রেরণা জোগায় এবং জনগণকে রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়তে ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করে। '৭১ সালে দেশের আপামর জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সেখানে কোনো রাজনৈতিক বিবেচনা ছিল না। বিবেচনায় ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য '৭১-এর সেপ্টেম্বরে আমাকে বীরবিক্রম খেতাব প্রদান করা হয়।