মার্চ মাস হচ্ছে অগ্নিঝরা মাস। এ মাসে বাংলাদেশ নতুন ইতিহাস নির্মাণ করে। মার্চ হচ্ছে স্বাধীনতার মাস এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের মাস। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম এবং প্রতিষ্ঠার মাস। এ মাসেই দীর্ঘ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নির্বাচনী সংগ্রামের পরে চূড়ান্ত রূপ নেয় স্বাধীনতার দিকে। আমি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সদস্য ছিলাম এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। আমার পড়াশোনা শেষ হয়ে গিয়েছিল, তবুও ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে আমি তৎকালীন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ তথা স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের সদস্য ছিলাম। সে হিসেবে আমার মূল দায়িত্বটা ছিল 'জয় বাংলা' বাহিনীর জন্য কাজ করা, জয় বাংলা বাহিনীর জন্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ, রসদ সংগ্রহ করা এবং সামরিক প্রশিক্ষণ নেওয়া ও সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা। মার্চ মাসে এসব কাজের বাইরেও আমি মার্চ মাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ আমি একেবারে মঞ্চের কাছ থেকে শুনেছি, দেখেছি এবং সেই জনসভা সফল করার কাজেও নিয়োজিত ছিলাম। আমার গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল জয় বাংলা বাহিনীকে সশস্ত্র করা, সামরিক কায়দায় দক্ষ করে তোলা। আমার তৎকালীন নেতা হিসেবে সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মণি, তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমেদ, মার্শাল মনিরুল ইসলাম এদের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে আমি কাজ করতাম। এ মার্চ মাসেই আমার চোখের সামনে যখন গণপরিষদ বাতিলের ঘটনা ঘটে, ইয়াহিয়া খান যখন গণপরিষদ বাতিলের ঘোষণা দেন, তৎক্ষণাৎ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন চত্বরে যে ছাত্র-যুবক সমাবেশ হয়, সেখানে আ স ম আবদুর রবের পতাকা উত্তোলনের ঘটনা আমি প্রত্যক্ষ করেছি। আমি দেখেছি, প্রয়াত শেখ জাহিদ হোসেন ও আওয়ামী লীগের খিলগাঁওয়ের কর্মী ইদু কীভাবে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে জনসভায় আসেন। সে পতাকা আনুষ্ঠানিক উত্তোলনের মধ্য দিয়ে আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে এটা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকায় রূপান্তরের ঘটনা আমি দেখেছি।
আমি ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের শাজাহান সিরাজ কর্তৃক ইশতেহার পাঠ প্রত্যক্ষ করেছি। বঙ্গবন্ধু কীভাবে পূর্বাণী হোটেল থেকে বেরিয়ে এসে পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে পুরো ইশতেহার পাঠ শোনেন এবং আশীর্বাদ দেন সে ঘটনাও দেখেছি। সুতরাং আমি ৩ মার্চ দেখলাম যে বাংলাদেশের ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে সীমানা নির্ধারণ হয়ে গেল। বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধুর নাম ঘোষণা করা হলো। বাংলাদেশের পতাকা যা ২ তারিখে ওড়ানো হয়েছিল সে পতাকা চূড়ান্ত করা হলো। স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হলো। এর অর্থনীতির ঘোষণা দেওয়া হলো। জাতীয় সংগীতও চূড়ান্ত করা হলো। আমার চোখের সামনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলনের ঘটনা, জাতীয় সংগীত নির্ধারণের ঘটনা, বাংলাদেশের মানচিত্র চূড়ান্ত করার ঘটনা, বঙ্গবন্ধুকে সর্বাধিনায়ক হিসেবে ঘোষণা এবং এ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে আমি দেখলাম, বঙ্গবন্ধু কী অপূর্ব কায়দায় অসহযোগ আন্দোলনের আড়ালে বাংলাদেশকে একটি স্বশাসিত বাংলাদেশে রূপান্তরিত করলেন। ৮ মার্চ থেকে সব কর্তৃত্ব তার হাতে নিয়ে গেলেন এবং প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন। সুতরাং ৮ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করে। আমি ২৩ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ঘটনারও সাক্ষী, যেদিন ছিল পাকিস্তান রিপাবলিক ডে। সেদিন পাকিস্তানে ছুটি থাকত। সেদিন স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ একটা প্রতিরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করে এবং বাংলাদেশের কোথাও পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলনের কর্মসূচি নাকচ করে দেয়। এরই অংশ হিসেবে সারা বাংলাদেশে জয়বাংলা বাহিনী কুচকাওয়াজ প্রদর্শন করে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা উত্তোলনের কাজ হাতে নেয়। ঢাকা শহরের পল্টন ময়দানে সকাল ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে জয়বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজ হয়। আমার যত দূর মনে পড়ে, প্রায় হাজারতিনেক ছেলেমেয়ে জয় বাংলা বাহিনীর সদস্য হিসেবে সামরিক কায়দায় রাইফেল হাতে কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণ করে। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চার নেতা আ স ম আবদুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন অভিবাদন গ্রহণ করেন। মঞ্চে তাদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাবেক রাষ্ট্রদূত কামালউদ্দিন ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মনিরুল হক ওই মঞ্চে ছিলেন। কামরুল আহসান খান খসরু ভাই সামরিক কায়দায় বন্দুক উঠিয়ে সালাম ও অভিবাদন দেন। আর আমি পিস্তল থেকে ফাঁকা গুলি ছুড়ে বাংলাদেশের পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে ২৩ মার্চ পল্টন ময়দানে উত্তোলন করি। বাংলাদেশে ২৩ মার্চ হচ্ছে সেই দিন, যেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা সর্বত্র উত্তোলন করা হয়েছিল এবং সেদিনই পাকিস্তানের শেষ কবরটা রচনা করে দেওয়া হয়েছিল। ২৫ মার্চের আক্রমণের ঘটনা দেখেছি। আমি ইতোমধ্যে আমার সহকর্মী এবং সহযোদ্ধা জাসদের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক শরীফ নূরুল আম্বিয়াকে সঙ্গে করে গোলাবারুদ সংগ্রহের কাজে লিপ্ত ছিলাম। এ মার্চজুড়ে আমরা আমাদের উদ্ভাবিত গ্রেনেডের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতাম। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে গ্রেনেড উৎপাদনের একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছিলাম। আমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করত প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা বিশিষ্ট সাংবাদিক মাসুদ আহমেদ রুমী, বাসদ নেতা মাহবুবুল হকসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা। সবাই আমার সঙ্গে কাজ করেছেন। আমি মনে করি, তারা সবাই যার যার জায়গা থেকে এ বিশাল কর্মযজ্ঞে, মুক্তিযুদ্ধ প্রস্তুতিতে জড়িত ছিল। আমি মনে করি, মার্চে আমরা আসলে সর্বত্র স্বাধীনই হয়ে গিয়েছিলাম। শুধু আনুষ্ঠানিক ঘোষণার বাকি ছিল। সুতরাং ২৫ মার্চে রাতে যখন পাকিস্তানিরা আক্রমণ চালাল, তখন স্বাধীন বাংলাদেশ দখল করল তারা। এ জন্যই আমরা পাকিস্তানিদের দখলদার বাহিনী বলি। এ জন্যই আমাদের বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ। একটা নিরস্ত্র জাতিকে সশস্ত্র করার রাজনৈতিক ঘটনা আমি মার্চ মাসে দেখেছি। নিরস্ত্র জাতিকে সশস্ত্র করার, মানসিকভাবে সশস্ত্র যোদ্ধা হিসেবে গড়ে তোলা, নিরস্ত্র জাতি সশস্ত্র জাতি হিসেবে গড়ে উঠেছে '৭১-এর মার্চ মাসে। বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়কই নন, বাংলাদেশের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, তিনি আমাদের রাষ্ট্র পিতা এবং জাতির পিতা। ২৫ মার্চের রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণ হয়। শরীফ নূরুল আম্বিয়া, জগন্নাথ কলেজের ছাত্রনেতা নজরুল ইসলামসহ আমরা কোনোরকমে বুয়েট থেকে সরে যাই এবং আমাদের গোলাবারুদ সরিয়ে নিই। এভাবেই আমাদের প্রত্যক্ষ স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলো। হাসানুল হক ইনু : জাসদ সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী। অনুলিখন : নিজামুল হক বিপুল