১৯৭১-এর ২৩ মার্চ, কুষ্টিয়ায় প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। জেলা আওয়ামী লীগের আয়োজনে শহরের ইসলামিয়া কলেজ মাঠে অনুষ্ঠিত জনসভায় হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে এ পতাকা উত্তোলন করি। মুক্তিযুদ্ধে কুষ্টিয়া জেলার ভূমিকা ছিল অপরিসীম। আমরাই যুদ্ধ শুরুর এক সপ্তাহের মধ্যে কুষ্টিয়াকে হানাদারমুক্ত করেছিলাম। সে সময় কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগ দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। কেন্দ্র অনুমোদিত কমিটির সভাপতি ছিলেন আবদুল জলিল (বর্তমানে আইন পেশায় নিয়োজিত), আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আবদুল হাদী (স্বাধীনতার পর রক্ষীবাহিনীর হাতে নিহত)। সাধারণ ছাত্রদের সমর্থিত জেলা ছাত্রলীগের আরও একটি কমিটি ছিল, যার সভাপতি ছিলেন মনোয়ার হোসেন (পরে সরকারি কলেজের ভিপি), সাধারণ সম্পাদক ছিলেন চিত্রাভিনেতা রাজু আহমেদের ছোট ভাই ওবাইদুল হক সেলিম (মৃত)। আর আমি এ কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলাম। তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আজিজুর রহমান আক্কাস, সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শামসুল আলম দুদু, শ্রম সম্পাদক আনোয়ার আলীসহ (বর্তমানে কুষ্টিয়া পৌরসভার মেয়র) বিভিন্ন থানা ও মহকুমার নেতা সাধারণ ছাত্রদের মনোনীত আমাদের এ কমিটিকে সমর্থন ও সহযোগিতা করতেন। অন্যদিকে কেন্দ্র অনুমোদিত জলিল-হাদী কমিটিকে সমর্থন করতেন তৎকালীন এমপিএ আবদুর রউফ চৌধুরীসহ কিছু নেতা। ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস বর্জন করে বাংলাদেশ দিবস ঘোষণার উদ্দেশ্যে ওই দিন বিকাল ৩টায় জেলা আওয়ামী লীগ ইসলামিয়া কলেজ মাঠে জনসভার আয়োজন করে। জেলা সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট আহসান উল্লাহ এমপিএ-এর সভাপতিত্বে জনসভা শুরু হয়। এর আগে দুপুরে আমাদের কমিটির সাধারণ সম্পাদক ওবাইদুল হক আমাকে ও ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আবু জাফর খানকে (বর্তমানে মৃত) তার কোর্টপাড়ার বাসায় ডেকে পাঠান। তিনি আমাদের জানান, ঢাকা থেকে শহীদ ভাই স্বাধীন বাংলাদেশের একটি পতাকা পাঠিয়েছেন। পতাকাটি বের করে আমাদের দেখান এবং বলেন, এটি আজকের জনসভায় উত্তোলন করতে হবে। তার কাছ থেকে পতাকাটি নিয়ে আমি পকেটের মধ্যে ভরে চলে আসি। এরপর আমরা পতাকাটি উত্তোলনের প্রস্তুতি নিতে থাকি। তবে প্রচণ্ড ভয় কাজ করছিল। ৩টায় জনসভা শুরু হলে তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা, বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি জুলফিকার আলী আরজু ও জাফর খান আমাকে পতাকা বের করার জন্য বার বার তাগাদা দিতে থাকেন। তারা আমাকে বলেন, পতাকা উড়িয়ে দে, যা হয় হবে। পাকিস্তান দিবসকে লাথি মেরে বাংলাদেশ স্বাধীন করার মঞ্চে তখন গরম বক্তব্য চলছিল। আমি আগেই বক্তব্য দিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে এসেছি। কলেজের পুব দিকে একটি ভবনের রিপেয়ারিং কাজ চলছিল। সেখানে পড়ে থাকা একটি লম্বা বাঁশ নিয়ে আনুমানিক ৪টার দিকে মঞ্চের পেছনে গিয়ে তার সঙ্গে পতাকাটি বাঁধলাম। হাফিজ বুক ডিপোর মালিক হাফিজ আবুল কালাম আজাদ তখন একটি মিছিল নিয়ে নিজের বন্দুক দিয়ে ফায়ার করতে করতে সভাস্থলে আসেন। এর পরই আমি পতাকা বাঁধা বাঁশ নিয়ে জয় বাংলা স্লোগান দিতে দিতে মঞ্চের সামনে আসি। তখন উপস্থিত জনতা জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে মুখর করে তোলে জনসভাস্থল। নেতারা সবাই ছুটে এসে পতাকা লাগানো বাঁশে হাত লাগিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। সে সময় বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আলোকচিত্র শিল্পী আবদুল হামিদ রায়হান ভাই ছুটে এসে বলেন, ঠিকমতো ধর আমি ছবি তুলব। রায়হান ভাইয়ের তোলা সে ছবিটি ২৩ মার্চের পতাকা উত্তোলনের সাক্ষী হয়ে আছে। অনুলিখন : জহুরুল ইসলাম, কুষ্টিয়া