একাত্তরের মার্চের প্রথম দিকে আমি ঢাকায় ছিলাম। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সময় মঞ্চ পাহারায় যে স্বেচ্ছাসেবক দল ছিল, আমি সেই দলেরও একজন ছিলাম। ইকবাল হলের মাঠে সমর প্রস্তুতির অংশ হিসেবে যে সামরিক ট্রেনিংয়ের চেষ্টা চলছিল আমি তাতেও অংশগ্রহণ করি। এ সময়টাতে মার্চের ১০ তারিখের মধ্যেই কোনো এক সময় আমাদের রাজনৈতিক নেতা সিরাজুল আলম খান ডেকে বললেন, তুমি এলাকায় ফিরে যাও, সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ কর। এখানে আলোচনা যাই হোক, এ আলোচনায় কিছুই হবে না। পাকিস্তানিদের সঙ্গে আপসের আর কোনো জায়গা নেই।
আমি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনেক কাগজপত্র, যা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রচারণা চালানো যায় সেরকম কাগজপত্র নিয়ে চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে গেলাম। মার্চের ১০, ১১ কিংবা ১২ তারিখে ঢাকা ছাড়লাম। বোয়ালখালীর বিভিন্ন বাড়ি থেকে আমরা অনেকগুলো সিভিল গান (বন্দুক) সংগ্রহ করলাম। এ সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরিরত একজন ল্যান্সনায়েক বিয়ের জন্য ছুটিতে গ্রামে এসেছিলেন। আমরা তার কাছ থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ নিলাম। যুদ্ধের শুরুতে পাকিস্তানি বাহিনী তাকে হত্যা করে। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল এই ল্যান্সনায়েক আমাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। আমরা যখন ট্রেনিং গ্রহণ শুরু করি, তখন প্রকৃতপক্ষে ঢাকায় সংলাপ চলছিল। আমি তখন আমার দলবল, যুব, ছাত্রকর্মীসহ এলাকায় এ প্রচারণা জোরদার করছি যে, স্বাধীনতার জন্য লড়াই হবে। আমরা জানতে পারলাম, ঢাকা থেকে ওয়াপদার একটি জিপ গাড়ি নিয়ে একজন চালক বোয়ালখালী এসেছেন। আমরা এ জিপটা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বাংলাদেশের পতাকা টানিয়ে সারা বোয়ালখালী ঘুরিয়েছি।
তবে সবচেয়ে বড় যে ঘটনাটি আমার জীবনে ঘটেছে (সেটা আমি পার্লামেন্টেও বলেছি) সেটি হচ্ছে, ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে আমরা সবাই সংঘবদ্ধ এক জায়গায় থাকতাম। সেখানে এসে আমার এক দরিদ্র কৃষক আত্দীয় কাকডাকা ভোরে আমাকে ডেকে বললেন, তিনি জমিতে হালচাষ করতে গিয়ে দেখতে পেয়েছেন সেনাবাহিনী আসছে। আমি দেখতে পেলাম বহু দূরে পিপীলিকার মতো তিন-চারটা সারিতে বহু লোক আসছে। তখন আমার মনে হলো, এরা পাকিস্তানি সৈনিক নয়, তারা বাঙালি। এর মধ্যে দলটি ধীরে ধীরে আমাদের কাছে এসে পৌঁছল। দেখলাম, অনেকগুলো লোক সামরিক পোশাক পরা। কারও কাঁধে একটি, কারও কাঁধে দুটি রাইফেল। তারা সবাই ক্লান্ত। ২৬ মার্চ প্রচণ্ড কুয়াশা ছিল। তারা যখন কাছাকাছি তখন আমরা বন্দুক উঁচিয়ে 'জয় বাংলা' স্লোগান বলে চিৎকার দিতে থাকি। আমরা যখন স্লোগান দিচ্ছিলাম তখন ওই সামরিক পোশাক পরা লোকগুলো মাটিতে শুয়ে পড়ে পজিশন নেয়। তখন আমি আমার সহকর্মীদের রেখে একাই হাঁটতে হাঁটতে ওদের দিকে অগ্রসর হই। তখন তারা দাঁড়িয়েছে। আমার মনে আছে, কাছাকাছি গিয়ে তাদের মধ্যে প্রথম যাকে আমি কাউন্টার করলাম তিনি বয়স্ক সৈনিক। কাপড়ে রক্তের দাগ। তার গোঁপ প্রায় সাদা হয়ে গেছে। ওই বয়স্ক সৈনিকের প্রথম কথা উর্দুতে। ওই সৈনিক আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, 'শের কে বাচ্চা, তুম লোক বি হাতিয়ার লেলিয়া, বাংলা মূলক আজাদ হো গিয়া।'
আমি তাকে বললাম, তোমার অফিসার কোথায়। সে জানাল, অফিসার পেছনে। একটু পরেই সমবয়সী একজন অফিসারের সঙ্গে দেখা হলো। নিজের পরিচয় দিলেন ক্যাপ্টেন হারুন। পরবর্তীতে তিনি মেজর জেনারেল হয়েছিলেন। আমি নিজের পরিচয় দিলাম। বললাম, আমি ছাত্রলীগের একজন নেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। উনি প্রশ্ন করলেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার যোগাযোগ আছে কি না? হ্যাঁ, আছে। তখন বললেন, আপনি বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে দেন অষ্টম বেঙ্গল রিভোল্ট করেছে। মেজর জিয়া, মেজর মীর শওকত আলীসহ আমরা রিভোল্ট করেছি। চট্টগ্রাম, কাপ্তাইসহ তিনটি স্থান থেকে হেঁটে আসা ক্লান্ত এই সৈনিকদের জন্য আমরা গ্রামবাসীর সহযোগিতায় খাবারের ব্যবস্থা করি। গ্রামের প্রতিটি মানুষ নিজেদের সকাল বেলার নাস্তা নিয়ে আসেন এই সৈনিকদের জন্য। তারা যখন সকালের নাস্তা করছে, তখনই আকাশে প্লেন উড়ছিল। মেজর জিয়াসহ অন্যরা বললেন, খোলা জায়গায় আমাদের থাকা নিরাপদ হবে না। আমরা তাদের পাহাড়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করলাম। কানুঙ্গপাড়া কলেজের পেছনে যষ্টুপাড়া পাহাড়ে তারা অবস্থান নিলেন। এর আগে মেজর জিয়া, মেজর মীর শওকত আলী, ক্যাপ্টেন হারুনদের সঙ্গে আমার কথা হলো।
তারা পাহাড়ের দিকে চলে যাওয়ার কিছু পরে আমরা রেডিওতে শুনতে পেলাম চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতা এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা করছেন। এটা ২৬ মার্চ দিনের কথা। আমরা সৈনিকদের পাহাড়ে পাঠিয়ে দিয়ে বিকালের দিকে দেখলাম একটি সবুজ ভঙ্ওয়াগনে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতা চক্ষুবিশেষজ্ঞ ডা. জাফর, আতাউর রহমান কায়সার, হাটহাজারীর এমএনএ ওহাব এলেন। তারা বললেন, আমরা শুনেছি বাঙালি সৈন্যরা এদিকে এসেছেন। আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাই। মেজর জিয়াউর রহমানসহ অন্য যারা আছেন তাদের সঙ্গে ২৬ মার্চ বিকালেই পাহাড়ে নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা হয়। নেতৃবৃন্দ সৈনিকদের খোঁজার কারণ ব্যাখ্যা করে বললেন, আমরা রেডিওতে ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছি। কিন্তু আমরা মনে করি সামরিক বাহিনীর একজন অফিসার যদি রেডিওতে এ ঘোষণাটি দেন তাহলে সামরিক বাহিনীতে প্রতিরোধের প্রশ্নে আরও বেশি শক্ত অবস্থান তৈরি হবে। নেতৃবৃন্দের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে জিয়া বলেছেন, তিনি ঘোষণা দেবেন। এর পরের ঘটনা সবাই জানেন। ২৭ মার্চ সেই কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এ ঘোষণার বিষয়ে একটি কথা বলব, প্রথম ঘোষণা যেটি তিনি নিজে লিখেছেন তাতে তিনি নিজেকে সেনাবাহিনীর প্রধান, আন্দোলনের প্রধান দাবি করে ঘোষণা দেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ তার প্রথম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত বুঝতে পারেন এরকম একটি ঘোষণা সব আন্দোলনকে বিকৃত করে দেবে। আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, কোনো অবস্থাতেই এটা সিচুয়েশন ইন মুভমেন্ট নয়। এটা জনগণের স্বাধিকারের আন্দোলন। তখন হান্নান সাহেবের দেওয়া ঘোষণাটি আবার নতুন করে লিখে মেজর জিয়া আবার ঘোষণা দেন। যেটি এখন আর্কাইভে আছে। স্বাধীনতার ঘোষণাটি হয়েছে ২৬ মার্চ। এ কারণে আমাদের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ। আর জিয়াউর রহমান ২৬ মার্চ সারা দিন চট্টগ্রাম শহরেই পৌঁছেননি। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তিনি যে ঘোষণা দিয়েছেন সেটা ২৭ মার্চ।