এ যাত্রায় আক্রমণটা শুরু করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই। দলের নেতাদের তিনি খুব একটা বিশ্বাস করেন না। বিশেষ করে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টে তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর দল, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কার্যত কোনো প্রতিরোধ বা প্রতিবাদও হয়নি, সে জন্য দলের প্রতি তৎকালীন দলের নেতাদের প্রতি প্রচণ্ড ক্ষোভ ছিল তার। '৮১ সালে দেশে ফিরে দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তার মধ্যে এই বিশ্বাস দৃঢ় হতে থাকে যে, দলের নেতারা '৭৫-এর পরে ক্ষমতার সঙ্গে এক ধরনের আপস করে টিকে ছিলেন। পিতৃ হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার যে আগুন তার বুকে ধিকে ধিকে জ্বলছিল তার এতটুকু আভা তিনি কারও মধ্যে দেখতে পাননি। অতএব নিজের এই অনুভূতির কথা ক্ষোভের কথা তিনি একাই বলতে শুরু করেন। ব্যতিক্রম ছিলেন কেবল কাদের সিদ্দিকী; কিন্তু তার সঙ্গেও তার শেষ পর্যন্ত হয়নি। কেন, সেই আলোচনা করছি না। কাদের সিদ্দিকী শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ছেড়ে দিয়ে নতুন দল করেছেন। তাকে শেখ হাসিনা বজ্র বলে ডাকতেন। কিন্তু রাজনীতি এমন নিষ্ঠুর বাস্তবতা যে, সেই বজ্র অাঁটুনি ছেড়ে শেখ হাসিনাকে ফসকা গেরোদের নিয়ে রাজনীতি করতে হচ্ছে। তার কথা তিনি বলছেন, অন্যদের তোয়াক্কা করছেন না। ফলে আবেগ জেদে পরিণত হয়েছে। তথ্য ও যুক্তি পালিয়ে গেছে।
২৭ এপ্রিল দুপুরবেলা নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়র নজরুল এবং আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন অপহরণের ১০ মিনিটের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ-৪ এর সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমান তাকে ফোন করে জানান। শামীম ওসমান এবং প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে কী কথা হয়েছিল তা আমরা আজো জানতে পারিনি। প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নিয়েছিলেন তাও জানি না। কিন্তু ৩০ এপ্রিল যখন শীতলক্ষ্যার বুকচিরে মানবতার ধর্ষণচিত্র দেখিয়ে সাতটি লাশ ভেসে উঠল তখন মানুষের কষ্টের সীমা রইল না। এ কথা ঠিক, এক সময়ের প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এ ব্যাপারে সরকারকে দায়ী করে প্রথমে বক্তব্য রেখেছিলেন। কিন্তু এটাকে আমি দোষারোপের সংস্কৃতি বলব না। সাত সাতটা জলজ্যান্ত মানুষ দুপুরের খররোদ্রালোকের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন সেটা দেখার দায়িত্ব কার? নিশ্চয়ই প্রশাসনের, পুলিশের, র্যাবের এবং সর্বোপরি সরকারের। সরকারের সে দায় তো নিতে হবেই। ইতিমধ্যে দেশের মানুষ জেনেছে, নারায়ণগঞ্জের মানুষ তো আগে থেকেই জানত যে এটা বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের নারায়ণগঞ্জ চ্যাপ্টারের রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন, ক্ষমতার লিপ্সা এবং অর্থলোভের পরিণতি। যে কেউ এ ঘটনার দায় সরকার কিংবা সরকার দলের ওপর চাপাতেই পারেন। কিন্তু বিস্ময়করভাবে প্রধানমন্ত্রী ১ মে গাজীপুরের জনসভায় এ ঘটনার জন্য প্রকারান্তরে বিএনপিকে দায়ী করলেন। এটা নিশ্চয়ই দোষারোপের রাজনীতি এবং প্রধানমন্ত্রী এটা শুরু করেছিলেন এবং ফেনীর ফুলগাজীতেও আমরা প্রধানমন্ত্রীর সেই একই কণ্ঠ শুনতে পাই।
বেগম জিয়া যে রাজনীতিতে দোষারোপের সংস্কৃতি চর্চা করেন না, তা আমি বলছি না। গত টার্মে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার প্রথমদিকে বেগম জিয়া সিরাজগঞ্জে গিয়েছিলেন এক জনসভায় বক্তৃতা করতে। যমুনার ওই পাড়ে রেলস্টেশনের পাশে এক বড় মাঠে ছিল তার জনসভা। প্রচুর জনসমাগম হয়েছিল। রেললাইন ছাপিয়ে উঠেছিল সেই জনতা এবং রেললাইনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মানুষগুলোর ওপর দিয়ে চলে গিয়েছিল একটি ট্রেন। ট্রেনের নিচে পিষ্ট হয়ে কাটা পড়ে মারা গিয়েছিল ৬-৭ জন মানুষ। বিক্ষুব্ধ জনতা আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল স্টেশনে, তার আশপাশ এলাকার যানবাহনে। হৃদয়বিদারক এ ঘটনা নিয়ে পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছিল। দুর্ঘটনাটি এড়ানো যেত না? এতগুলো মানুষ ট্রেনলাইনে ড্রাইভার দেখতে পায়নি? সে থামাতে পারত না ট্রেনটা? এসব প্রশ্ন উঠেছিল আর বেগম জিয়া অভিযোগ করেছিলেন এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। সরকারের পরিকল্পনামাফিক জনসভার ওপর ট্রেন চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা ছিল এক ধরনের দোষারোপের সংস্কৃতি। কারণ অভিযোগটি অনেক বড়। বেগম জিয়ার অভিযোগ যদি সত্যি হয় তাহলে শেখ হাসিনাকে একটি রাক্ষুসি ডাইনি বলতে হবে। মনে মনে থাকলেও প্রমাণ ছাড়াই দায়িত্বশীল লোকদের এত বড় অভিযোগ করা উচিত নয়। আমার যতদূর মনে পড়ে ট্রেনের সেই ড্রাইভার, সহকারী ড্রাইভারদের এবং লোকোমোটিভ ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে কথা বলেছিলেন সাংবাদিকরা। যেখানে জনসভা হচ্ছিল তার একটু আগেই ট্রেনলাইন একটি বাঁক নিয়েছে। ওই বাঁক নেওয়ার আগে ট্রেনের ড্রাইভারের সামনের জনসভা দৃষ্টিগোচর হয় না। যখন তিনি দেখতে পান তখন চাইলেও এত কম দূরত্বে ট্রেন থামানো তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কোনটা সত্য সে কথা বলতে পারব না। মজার বিষয় হলো, বিদেশ সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই দিন পরে দেশে ফিরে এ ঘটনার জন্য সরাসরি খালেদা জিয়াকে দায়ী করে বলেন_ বিরোধী নেত্রী আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য লাশ চেয়েছিলেন সে জন্য তিনি ওই স্থানে জনসভা করে এ দুর্ঘটনার নীলনকশা তৈরি করেছিলেন। হায় আল্লাহ কার কাছে যাব! পাঠকবৃন্দ ভাবতে পারেন এত বড় হৃদয়বিদারক ঘটনায় দেশের দুই মূল নেত্রীর কী হৃদয়হীন অবিবেচক আচরণ ও উচ্চারণ? নিশ্চয়ই এটি মর্মান্তিক ঘটনা। এ ঘটনার একটি নিরপেক্ষ তদন্ত হতে পারত। বিশেষজ্ঞ একটি টিম গঠন করে নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা করতে পারলে বাস্তব সত্য বেরিয়ে আসত। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ছিলেন তিনি তা করেননি। বিরোধী নেতা খালেদা জিয়াও কোনো তদন্তের জোর দাবি জানাননি। তারা কেবল পরস্পরের বিরুদ্ধে দোষারোপ করেই তাদের দায়িত্ব শেষ করেছেন।
এসব নিয়েই কথা হচ্ছিল ৪ তারিখ রাতে '৭১ সংলাপে। আমি যতখানি বিস্তারিত বললাম সেভাবে কথা আসেনি। কিন্তু আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল প্রধানত রাজনীতিতে দোষারোপের সংস্কৃতি। আমার আজকের লেখার প্রতিপাদ্য আরেকটু সম্প্রসারিত করে বলছি, রাজনীতির কথাকথি। আমার ছোট বোন যার বিয়ে হয়েছে ফরিদপুরে তার কাছ থেকে আমি এ শব্দটি শিখেছি। কথাকথি মানে অপ্রয়োজনীয় কথা বলা, কথার পৃষ্ঠে কথা বলা, উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলা। ব্যাপারটা নতুন কিছু নয়। আমাদের দেশীয়ও নয়। পৃথিবীর দেশে দেশে রাজনীতিতে এ রকম হয়। এই যে ভারতে নির্বাচন হয়ে গেল সেখানেও তো আমরা কত কথাকথি দেখলাম। কিন্তু আমাদের দেশে যা হয় বিশেষ করে বর্তমানে যা হচ্ছে সেগুলো সীমা ছাড়া, যুক্তিহীন এবং আমি বলব যারা যখন ক্ষমতায় থাকেন তারাই তখন এই সংস্কৃতির চর্চা করেন।
জাপান থেকে ফিরে এসে প্রধানমন্ত্রী আবারও এই সংস্কৃতির চর্চা করতে শুরু করেছেন। জাপান সফরকে অতিমাত্রায় সফল দেখানোর চেষ্টা করেছেন, যদিও মিজানুর রহমান খান তার লেখায় লিখেছেন ব্যাপারটা সেরকম নয়। মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা ক্রেস্টে সোনা নেই, সেটা নিয়ে এমন একটি যুক্তি দিয়েছেন যাতে সোনা চোররা আশকারা পেয়ে যায়, আর আবারও প্রচণ্ড ক্ষোভ ঝেড়েছেন বিচারব্যবস্থার ওপর। একটা পর্যায়ে এমন হয়েছে যে তিনি বুঝেছেন এটা আদালত অবমাননার শামিল হচ্ছে, সেটাও তিনি সংবরণ করতে পারেননি। বলেছেন অবমাননা হলে হোক। আই ডোন্ট কেয়ার।
আমাকে অনেকেই বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী ধৈর্যহারা হয়েছেন বলে মনে হচ্ছে না। কেন? তার সামনে তো এখন অত বড় কোনো চ্যালেঞ্জ নেই। যেভাবেই হোক ৫ জানুয়ারি পার করেছেন এবং আবারও বাংলার মসনদে আরোহণ করেছেন। তাহলে এমন কেন?
মনে মনে ভেবেছি ৫ জানুয়ারি পার করেছেন, ক্ষমতায় আবার বসেছেন, বিরোধী দল বিএনপি-জামায়াত মিলেও কিছু করতে পারেনি। একটা ড্যামকেয়ার ভাব তো হবেই। সে জন্যই দম্ভ করে বলেন, মুন কেরির ফোনকে পাত্তা দেইনি। এটা হলো মুদ্রার একপিট। আরেকটি পিট হলো তার লোকেরা অন্যদের মারধর করার পর নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি শুরু করেছেন। র্যাবকে সঙ্গে নিয়ে মানুষ মেরে পেট কেটে ইজ্জতের দড়ি দিয়ে ইট বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কথায় বলে 'ধর্মের কল বাতাসে নড়ে'। নদীর তলদেশে যাদের থাকার কথা সেই মানুষগুলো তাদের অত্যাচারের সাক্ষী হয়ে পানিতে ভেসে উঠেছে। এই পাপ চাপা দেওয়ার কোনো উপায় থাকেনি। অ্যাটর্নি জেনারেল সাংবাদিকদের বোঝাবার চেষ্টা করেছেন এই হত্যাকাণ্ডে র্যাবের কোনো সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ তদন্তে পাওয়া যায়নি। অথচ সে দিনই র্যাবের কর্মকর্তা এক মেজর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে সব কিছু স্বীকার করে নিয়েছেন। সরকার এখন এখান থেকে বেরোবার পথ তো খুঁজবেই।
প্রয়াত নাসিম ওসমানের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে সংসদে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি এই পরিবারের দায়িত্ব নিচ্ছেন। এই পরিবারের দেখাশোনা করবেন। চমকপ্রদ নয় বক্তৃতাটি? খান সাহেব ওসমান আলী থেকে শুরু করে শামসুজ্জোহা পর্যন্ত এই পরিবারের অবদান কম-বেশি সবাই স্বীকার করবেন। আমি আগেও বলেছি, এখন যিনি আছেন সংসদ সদস্য শামীম ওসমান তিনি ছিলেন এই পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। কিন্তু বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের মানুষ এই পরিবার সম্পর্কে কী ভাবে?
গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় সেটা বোঝা যায়নি? আগামী ২৬ জুন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে যে উপনির্বাচন হবে সেখানেও এটা দেখা যাবে। প্রধানমন্ত্রী তার জোহা কাকার প্রতি যে কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জানিয়েছেন আমি তার কদর করি। এই পরিবারের দেখাশোনা যে তিনি করতে চান তাও আমার ভালো লেগেছে কিন্তু তিনি নিশ্চয়ই জানেন এই পরিবারের বর্তমান সামাজিক অবস্থা। প্রধানমন্ত্রী যদি এই হারানো সম্মান ও শ্রদ্ধা ফিরিয়ে আনতে চান তাহলে সেই কাজ করুন। এদের তো টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করার দরকার নেই। শামীম ওসমান তো প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার আগে সংসদে প্রদত্ত তার বক্তৃতায় বলেছেন, তার পরিচয় বাংলাদেশের কয়েকটি ধনী পরিবারের একটি। টাকা-পয়সার দরকার হতে পারে নিহত ওই সাতজনের কোনো কোনো পরিবারের। প্রধানমন্ত্রী সেরকম আশ্বাস দেননি। সেটা অবশ্য তার অভিরুচি। তার সিদ্ধান্ত। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি তার জোহা কাকার পরিবারকে দেখাশোনা করুন নিশ্চয়ই সেটা হবে আদর্শিক ও নৈতিক। তার বক্তব্য রাজনৈতিক, দলীয় ও নির্বাচনকেন্দ্রিক হবে না বলেই আমরা প্রত্যাশা করি। এটা কোনোক্রমেই ওসমান পরিবারের জন্য নির্বাচন প্রাক্কালে ক্ষমতার বলয় তৈরি করবে না। ওসমান পরিবার তার হারানো সম্মানের জায়গায় ফিরে আসুক, যে কোনো ভালো মানুষই তা কামনা করবে।
লেখক : রাজনীতিক, আহ্বায়ক নাগরিক ঐক্য।
ই-মেইল : [email protected]