একজন বাংলাদেশির কাছে ফুটবল মানে কি? এটা কি শুধুই কোনো খেলা? নাকি ফুটবল গ্রামবাংলার আনাচে-কানাচে পৌঁছে যাওয়া কোনো উৎসব?
বিখ্যাত ইংলিশ ক্লাব লিভারপুলের ম্যানেজার বিল শ্যাংকলি একবার বলেছিলেন, 'লোকে বলে ফুটবল নাকি জীবন-মরণ বিষয়। তাদের আমি এইটুকু নিশ্চিত করে বলতে পারি- এটা তার চেয়েও অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।'ফুটবল শুধুই একটা খেলার নাম নয়। গত দুই দশকে ফুটবলের নান্দনিক রূপান্তর দেখেছে বিশ্ব। '৮০-এর দশকে বাংলাদেশে ফুটবল ছিল খুবই জনপ্রিয় একটি খেলা। '৯০-এর দশকে টেলিভিশন সম্প্রচারের বিস্তৃতির মধ্য দিয়ে আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ফুটবল। আর এখন তো স্যাটেলাইট টেলিভিশন, ক্যাবল আর ইন্টারনেটের যুগ। এখন দর্শক চাইলেই যে কোনো আন্তর্জাতিক ইভেন্টের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন, চাইলেই তা উপভোগ করতে পারেন।
আগামীকাল বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১৪ এর প্রথম ম্যাচ। গত সপ্তাহ থেকেই বর্ণিল সব পতাকায় ছেয়ে গেছে বাংলাদেশ। কিন্তু এ উৎসবমুখরতা কি শুধু শহরেই? বিশ্বকাপ জ্বর কি শুধু শহরেই সীমাবদ্ধ? এ উৎসব কি শুধুই শহুরেদের? উত্তরে আমাকে বলতেই হচ্ছে, ফুটবলের ব্যাপকতা এর চাইতেও অনেক বেশি। একজন উন্নয়ন সাংবাদিক হিসেবে আমাকে গ্রামীণ জনপদ আর সেখানকার মানুষের কাছে যেতে হচ্ছে সবসময়। '৭০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকেই আমি এই বাংলাকে ছোটপর্দায় ধারণ করে চলেছি। আমি দেখেছি মানুষের বিনোদনের আকাঙ্ক্ষা। তাদের বেশির ভাগই এ বাংলার কৃষক, যারা ছড়িয়ে আছেন এ দেশের আনাচে-কানাচে।
২০০০ সালের পর থেকে চিত্রটা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। এখন দর্শকের সংখ্যা যেমন বেশি, তাদের মধ্যে সচেতনতাও বেশি। বেড়েছে বিনোদনের চাহিদাও। কিছুদিন আগে চাঁদপুরের একটি গ্রামে শুটিংয়ে গিয়ে দেখেছি, তরুণ ও বৃদ্ধ কৃষকেরা জমিতে কাজ করছেন, তাদের পরনে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার জার্সি! দেখে অবাক হই। তাদের কাছে গিয়ে কথা বলার পর বুঝলাম, জনপ্রিয় এই দুই দলের একাধিক খেলোয়াড়কে চেনেন তারা। একজন তো বলেই বসলেন, 'দল ভিন্ন, তাই আমরা এখন প্রতিদ্বন্দ্বী'।
'ম্যারাডোনা আমার সবচেয়ে প্রিয় খেলোয়াড়- জানালেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কৃষক জামাল। বিশ্বায়নের এ যুগে, কৃষকরাও প্রতিটি খেলা দেখতে চান। বিদ্যুৎ বিভ্রাট বড় সমস্যা হলেও তার জবাবে ব্যাটারি নিয়ে প্রস্তুত কৃষকরা। 'আমরা সারা রাত জেগে খেলা দেখব_ বললেন দিনাজপুরের কৃষক জামাল।
জিজ্ঞেস করলাম, 'তাহলে দিনে কাজ করতে কষ্ট হবে না?'
সাহসী ভঙ্গিতে জামালের জবাব, 'তাতো হবেই!'
জামালপুরের কৃষক নূরুল ইসলাম বললেন- আমি ব্রাজিলের বড় সমর্থক, সাম্বা খুবই ভালোবাসি।' তাকে একটু সাম্বা নেচে দেখানোর অনুরোধ করতেই লজ্জা পেলেন। ব্যবসা-বাণিজ্যও ভালোই চলছে। বিশ্বকাপকে সামনে রেখে গ্রামে গ্রামে নতুন টিভি কিনছে মানুষ।
'আমি ব্রাজিল সমর্থন করি, কারণ ওদের পতাকার রং সবুজ, আমার ধানের রংও সবুজ' বললেন বগুড়ার কৃষক তাজুল। মনে মনে কৃষকের সরল চিন্তার তারিফ করি। 'রাজনৈতিক নেতারাও এখন একই দলের সমর্থক' বিজ্ঞভাবে বললেন ফেনীর কৃষক রহমান।
কৃষকরা খুব সহজেই মেসি, নেইমার কিংবা রোনাল্ডোকে চিনে যান। এমনও ফুটবলভক্ত কৃষকের দেখা মেলে যারা ব্রাজিলের মার্সেলো কিংবা আর্জেন্টিনার ডি মারিয়ার নাম শুনেছেন। কৃষকদের মধ্যে যাদের বয়স কম তাদের কেউ কেউ 'টিকি-টাকা' কৌশলের কথাও জানেন। তরুণ কৃষক লুৎফরের কাছ থেকে এমন তথ্য জেনে অবাক হয়ে যাই। ফুটবলের কৌশল বলতে আমি শুধু 'ওয়াল পাসিং' এর নাম স্মরণ করতে পারি। কিন্তু গ্রাম বাংলার হাস্যোজ্জ্বল, কর্মঠ এক যুবকের কাছ থেকে শোনা টিকি-টাকা শব্দটি আমার জন্য নতুন।
সবসময়ই আমার স্বপ্ন ছিল, কৃষকদের জন্য কিছু করব। বিশেষত যখন তারা খারাপ সময় পার করছে। কৃষকদের জন্য যত বিনোদনমূলক আয়োজন রয়েছে তার সবগুলোরই উদ্দেশ্য একটাই- তাদের মুখে হাসি ফোটানো। গ্রামীণ জনগোষ্ঠী, বাংলার কৃষক এবং নিরন্তর খেটে যাওয়া মানুষ যারা সব প্রতিকূলতাকে জয় করে দেশের জন্য খাদ্য উৎপাদন করে চলেছেন, কি করে তাদের জন্য আরও ভালো টেলিভিশন অনুষ্ঠান বানানো যায় তা নিয়ে আমার চিন্তা অব্যাহত থাকে। এই চিন্তা থেকেই 'কৃষকের ঈদ আনন্দ অনুষ্ঠানটি আয়োজনের কথা মাথায় আসে। ঈদ এ দেশের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য উৎসব। আমি লক্ষ্য করি, ঈদে সাত দিনের বিশেষ অনুষ্ঠানমালার পুরোটাই শহুরে জনগণের কথা মাথায় রেখে তৈরি। গ্রামের মানুষ এখানে অনেকটাই উপেক্ষিত। মনে প্রশ্ন জেগেছিল, কেন গ্রামের মানুষগুলোর জন্য কোনো বিশেষ অনুষ্ঠান নেই। সিদ্ধান্ত নেই নিজেই এমন একটি অনুষ্ঠান নির্মাণের। এক্ষেত্রে অবশ্যই বলতে চাই ফারমার্স ওয়ার্ল্ড কাপ ক্রিকেট ২০১১ আয়োজনের অভিজ্ঞতার কথা। কৃষকদের জন্য বিশ্বকাপ আয়োজনের আইডিয়া এবং আয়োজনের পুরো দায়িত্বটুকুই পালন করেছিলেন ময়মনসিংহের চরপুলিয়ামারির কৃষকরা।
এ দেশে ফুটবল নিয়ে কৃষকদের আগ্রহ সত্যিই হৃদয়কে নাড়া দেওয়ার মতো। ২০০৬ বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় আমি একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলাম। কিন্তু এরপর ৮টি বছরে কেটে গেছে এবং তখনকার চেয়ে এখনকার পরিবেশ অনেকটাই ভিন্ন। এবারও সারা দেশে কৃষকদের মাঝে বিশ্বকাপ উত্তেজনা দেখছি। তাই আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছি কৃষকের ফুটবল বিশ্বকাপ। এর জন্য ভেন্যু নির্ধারণ করেছি সিরাজগঞ্জের চর মালসাপাড়া যমুনার বালুচর। ব্রাজিল যেমন সেজে উঠেছে ফুটবল আয়োজনে, সেরকম বর্ণাঢ্য আর সারা বিশ্বকে জাগানোর মতো নয়, তবে সিরাজগঞ্জের মালসাপাড়াও সেজে উঠছে নিজেদের মতো করে। সেখানেও রাতে ফ্ল্যাড লাইটের আলোয় কৃষকের ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা সমর্থকদলের খেলা হবে আগামী ১৬ জুন। এখন রীতিমতো সারা জেলায় মাইকিং চলছে। চরে চলছে কৃষকদের প্র্যাকটিস। খেলোয়াড়দের জন্য জার্সি তৈরি হচ্ছে, নেওয়া হচ্ছে নানারকম প্রস্তুতি। চ্যানেল আই সিরাজগঞ্জের স্টাফ রিপোর্টার ফেরদৌস রবিনের নেতৃত্বে সেখানকার একঝাঁক উদ্যোমী মানুষ দিনরাত ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকের এ বর্ণাঢ্য আয়োজনকে বর্ণিল করে তুলতে।
এর সঙ্গে দারুণ উচ্ছ্বাস নিয়ে যুক্ত হয়েছেন স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন। সারা বছর নানা সমস্যা, সংকট ও বঞ্চনা মোকাবিলা করে টিকে থাকা কৃষকের মুখে হাসি ফোটানোর জন্যই এ আয়োজন। এই একটি আয়োজনের আনন্দের রেশ নিয়ে সারাটি বছর উজ্জীবিত থাকবেন কৃষক- আয়োজনের লক্ষ্যই এটা।
আমি বিশ্বাস করি দারুণ উদ্দমী এ কৃষকরা সব প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে ফসল চাষ ও আবাদের কাজ করে যাবেন। কে জানে, হয়তো টিকি-টাকা স্টাইলেই ঋতু ও জলবায়ু ক্রমপরিবর্তনের বাধাগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাবেন তারা, নিজ দক্ষতায় নিশ্চিত করবেন ফসলের উৎপাদন। কারণ ১৬ কোটি মানুষের মুখে খাবার তোলবার ক্ষমতাটুকুতো তাদেরই দখলে। শহরের বাসিন্দার বুঝুন আর নাইবা বুঝুন, দিন শেষে বল কিন্তু কৃষকের কোর্টেই।
লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব
ই-মেইল : [email protected]