অনেকেই আমাকে স্মৃতিকথা লিখতে বলেন। বিশেষ করে পুরনো দিনের বন্ধুরা, যারা নিজেরাই স্মৃতি-কাতর। মানুষ মাত্রেই নস্টালজিয়ায় কাতর হয়। স্মৃতির সুতার এক প্রান্ত ধরিয়ে দিলে সেই সুতা ধরে দূরদূরান্তে হারিয়ে যায়। একটা থেকে আরেকটা ঘটনার স্মৃতি মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। ষাটের দশকের 'ছয় দফা' আন্দোলন এবং '৬৬-র ৭ জুনের হরতাল নিয়ে কিছু কথা ইতিপূর্বে লিখেছি। তারপর '৬৭ সালে কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কয়েক সপ্তাহ কাছাকাছি থাকার যে দুর্লভ সুযোগ হয়েছিল তার উল্লেখ করেছি। আমার ইচ্ছা ষাটের দশক নিয়ে বিস্তারিত কিছু লিখি। পুরনো দিনের বন্ধু-সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এবং বই-পত্র, দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে ঝাপসা স্মৃতির ধুলো-বালি ঝেড়ে-মুছে তারপর লিখতে বসব। কিন্তু রাধার নাচন দেখার জন্য সেই দশ মণ গব্যঘৃত কখনো পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না। শেষতক স্থির করেছি স্মৃতির পাতা থেকে যখন যেটুকু সম্ভব উদ্ধার করে ষাটের দশকের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নানা রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহে যখন যেটুকু সম্পৃক্ত থাকার সুযোগ হয়েছে, যা দেখেছি এবং উপলব্ধি করেছি, তা আজকের দিনের পাঠকদের জন্য লিপিবদ্ধ করি, বিচ্ছিন্নভাবে হলেও।
'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা' : '৬৭ সালে প্রায় সাত মাস জেলখানায় থাকার পর ডিসেম্ব্বরের শেষ দিকে হঠাৎ করেই আমার রিলিজ অর্ডার আসে। পাকিস্তানি শাসনেও রাজনৈতিক বন্দীদের সঙ্গে আচরণে কিছু বিচার-বিবেচনা ছিল! বন্দীদের ছয় মাস পর পর 'বিভিউ বোর্ডের' সামনে হাজির করা হতো। আমাকে এমন এক সময় জেলে নেওয়া হয় যখন আমি এমএসসি ফাইনাল পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। '৬৩ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশমতো 'সদাচরণের মুচলেকা' দিতে অস্বীকার করায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হতে হয়েছে। অতঃপর প্রায় দুই বছর কারাগারে থাকতে হয়েছে, তারপর ডাকসুর সহসভাপতি ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে রাজনীতিতে গভীরভাবে জড়িয়ে থাকায় ঠিকমতো ক্লাস করা হয়ে ওঠেনি। বরাবরের মতো এবারও সহকর্মীদের সঙ্গে বোঝাপড়া করে পরীক্ষার আগের কয়েকটা সপ্তাহ পড়াশোনার জন্য নির্দিষ্ট করে নিয়েছিলাম। পরীক্ষার ফরম পূরণের পালা শেষ হয়েছে। মাসখানেক পরে পরীক্ষা। আমার বিভাগীয় শিক্ষকরা সবাই আমার প্রতি খুব সহানভূতিশীল ছিলেন। আমার পার্সেন্টেজ (ক্লাসে উপস্থিতি) খুব কম ছিল। শিক্ষকরা বিশেষ বিবেচনায় সেটা মার্জনা করে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করেন। এমন সময় এই বিপত্তি।
জেলখানা থেকে পরীক্ষা দেবার অনুমতি চাইলাম। বিজ্ঞানের ছাত্রদের জেলে বসে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হতো না। কারণ জেলের ভেতরে প্রাকটিকাল পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যায় না। জেল কর্তৃপক্ষ আমার প্রতি সদয় ছিলেন। তারা সরকারের বিশেষ অনুমতি নিয়ে জানালেন যে, যদি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রাজি হন তাহলে প্রাকটিকাল পরীক্ষার দিনে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আনা-নেওয়ার বিশেষ ব্যবস্থা তারা করবেন। শুনেছিলাম গভর্নর মোনায়েম খাঁ, যার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে জেলে গেছি, তিনিও এতে সম্মতি দিয়েছেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রাজি হলেন না। বললেন, ওকে জেল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আনা হলে গোলযোগ হবে, আমি দায়িত্ব নিতে পারব না। ফলে আমার আর পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। প্রিলিমিনারিতে ফার্স্টস ক্লাস পাওয়া সত্ত্বেও আমার পদার্থবিদ্যার পাঠ সেখানেই সমাপ্তি। এতে আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। আমার খুব ইচ্ছা ছিল পদার্থবিদ্যায় আরও পড়াশোনা করব। তা আর হলো না। এ বিষয়টি রিভিউ বোর্ডকে জানাতে গিয়ে প্রায় কেঁদেই ফেলেছিলাম। সম্ভবত সেজন্যই অপ্রত্যাশিত মুক্তি।
সে বছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের দিক থেকেই জেলখানা হঠাৎ করে খুব 'গরম' হয়ে উঠেছিল। কী ঘটেছে ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। নানা গুজব ডালপালা বিস্তার করছে। নিত্য নতুন লোককে গ্রেফতার করা হচ্ছে। তন্মধ্যে সামরিক বাহিনীর লোকজনই বেশি। জেলখানার ভেতরে মুখে মুখে এ নিয়ে নানা আলোচনা। ওরা নাকি আইয়ুব খানকে বোমা মেরে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিল। পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের একজোট করে অভ্যুত্থান ঘটানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল ইত্যাদি। তাদের জেল থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাইরে নিয়ে ভীষণভাবে টর্চার করা হচ্ছে। যখন ফেরত আনা হচ্ছে তখন আর লোকটিকে চেনাই যাচ্ছে না। (একজনের চেহারা নাকি এতই বদলে গিয়েছিল যে জেল কর্মকর্তারা তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন।) কয়েকজন সিএসপি অফিসার এবং আওয়ামী লীগের কিছু মধ্যম সারির নেতাও আছেন তাদের মধ্যে। তন্মধ্যে চট্টগ্রামের মানিক চৌধুরী, বিধান কৃষ্ণ সেন ও ডা. সৈয়দুর রহমান ছিলেন আমার খুব কাছের ও প্রিয় মানুষ। চট্টগ্রামে থাকতে তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি হয়। তারা চট্টগ্রাম থেকে কোনো কাজে ঢাকায় এলে হলে এসে খোঁজখবর নিতেন। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটি বৈঠকে শরিক হয়েছিলাম। সে কারণে কিছুটা চিন্তিত ছিলাম। আমাকে আবার তাদের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলবে না তো? জেল থেকে মুক্তি দিয়ে জেল গেটেই আবার অন্য মামলায় গ্রেফতার নতুন কিছু নয়। সেই আশঙ্কা মনে উঁকি দিচ্ছিল।
এমন সময় একজন 'মেট' (জেলখানার কয়েদিদের মধ্য থেকে বাছাই করা ব্যক্তি, যাদের জেলখানার প্রশাসনিক কাজে খাটানো হয়) হাসপাতালের স্লিপ নিয়ে হাজির। আমাকে হাসপাতালে যেতে হবে। এ সময় হাসপাতাল! 'মেট' ইসমাইল মিটি মিটি হাসছে। একটা কিছু আঁচ করে তার সঙ্গে ওয়ার্ড থেকে বের হলাম। জেল হাসপাতালটি জেলখানার আরেক প্রান্তে। কিছু দূর যেতেই পাশে শেখ সাহেবের ওয়ার্ড। যা অনুমান করেছিলাম তাই। দেখলাম তিনি তার ওয়ার্ডের গেট খুলে দাঁড়িয়ে আছেন। ঝট করে গেটের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। মুজিব ভাই আমাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে থাকলেন, তুমি এ সময় বাইরে যাচ্ছ। এটা খুব খুশির ব্যাপার। আমরা সবাই তো জেলে। সংগঠনের দিকে খেয়াল রাখবে। তোমার ওপর অনেক চাপ পড়বে। সামনে খারাপ সময় আসছে। ওরা তোমাকে আবার আটকাতে পারে। তোমাকে বাইরে থাকতে হবে। খুব সাবধানে থাকবে। কিছুতেই ধরা দেবে না ইত্যাদি।
তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিয়ম রক্ষার জন্য জেল হাসপাতাল ঘুরে আসলাম। ফেরার পথে অন্য ওয়ার্ডের গ্রিল ধরে বন্ধুরা চিৎকার করে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। শেখ মণি, ওবায়দুর রহমান, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, নূরে আলম সিদ্দিকী, আরও অনেকে। সবার এক কথা_ 'তুমি সাবধানে থাকবে। সবাইকে আমাদের সালাম জানাবে'। মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। ওদের ভেতরে রেখে বাইরে যাচ্ছি। মুক্তির আনন্দটা যেন ম্লান হয়ে গেল। আমার মুক্তির খবর বাইরে দেওয়ার কোনো সময় পাওয়া যায়নি। অন্যবারে খবর পেয়ে বন্ধুরা জেলগেটে ভিড় করেছে। সেদিন কেউ নেই। পরদিন ছিল ঈদ। একটা রিকশা চেপে ফজলুল হক হলে গিয়ে দেখলাম সব খাঁ খাঁ করছে। রিকশা ঘুরিয়ে চলে গেলাম বনগ্রাম রোডে হাসুদের বাড়ি। শামসুল আলম হাসু তখন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র। আমাদের নগর কমিটির প্রাণ। আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা মাওলানা তর্কবাগীশের ছেলে। বাড়ির গেট খুললেন মাওলানা তর্কবাগীশ নিজে। আমাকে দেখেই শিশুর মতো চিৎকার দিয়ে সবাইকে ডাকতে থাকলেন, হাসু, আলম, দ্যাখো দ্যাখো, কে এসেছে!
রাতে সেখানে থেকে পরদিন পল্টন ময়দানে মাওলানা সাহেবের পাশে বসে ঈদের নামাজ পড়লাম। তারপর চট্টগ্রামে বাবা-মা, ভাই-বোনদের দেখার জন্য ছুটলাম। সেখানে তিন-চার দিন থাকার পরই একদিন কাগজের হেডলাইন : 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা'! 'শেখ মুজিব প্রধান আসামি'! বুঝলাম মুজিব ভাই কেন 'সামনে খারাপ সময়' বলেছিলেন।
সেদিনই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সহকর্মীদের নিয়ে ফজলুল হক হলে গিয়ে দেখলাম আমার কক্ষটি অন্য একজনকে বরাদ্দ করে দেওয়া হয়েছে। তোফায়েল আহমদ তখন ইকবাল হলের ভিপি (এখনকার সার্জেন্ট জহুরুল হক হল)। বলল, 'আমাদের হলে চলেন। সেখানে আপনি আমার রুমে থাকবেন। আমি পাশের রুমে থাকব'। সবাই তাতে সায় দিল। তখনকার দিনে ইকবাল হল ছিল ছাত্র সংগঠনগুলোর অলিখিত কার্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বাকি কয়েকটা মাস সেখানে থেকেই সংগঠনের কাজ চালিয়েছি।
ছাত্রলীগের সিনিয়র সহকর্মীরা সবাই তখন জেলে। ভয়ানক দুঃসময়। এই দুঃসময়ে কীভাবে কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই সংগঠন চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। সব ভয়ভীতি উপেক্ষা করে লড়াকু সহযোদ্ধারা এগিয়ে এসেছে। কার নাম বাদ দিয়ে কার নাম বলব!
শুরু হয়ে গেল আমাদের যুদ্ধ। 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার' বিরুদ্ধে যুদ্ধ। সে যুদ্ধের কাহিনী এবং কাহিনীর পেছনের কাহিনী অনেক দীর্ঘ। পত্রিকার কলামে দু-চার কিস্তিতে লেখার মতো নয়। এই মামলাকে কেন্দ্র করে আমাদের আন্দোলন-সংগ্রাম পেয়েছে নতুন মাত্রা। এর মধ্য দিয়েই বাঙালি জাতির আত্দ-পরিচয়ের লড়াই চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে। ছাত্র-তরুণ-যুব সম্প্রদায়ের আবেগ-উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সর্বস্তরের মানুষের মনে ছড়িয়ে পড়েছে। সারা দেশ স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েছে। স্বায়ত্তশাসনের দাবির উত্তরণ ঘটেছে 'স্বাধীনতার' দাবিতে। সে কাহিনী বিস্তারিত বর্ণনার ইচ্ছা রইল।
ওরা এখন কোথায়?
দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিষয়টি ফুটনোটের অধিক গুরুত্ব পায় না। এ নিয়ে আশির দশকে একটা নিবন্ধ লিখেছিলাম। যা চার কিস্তিতে ছাপা হয়েছিল 'সাপ্তাহিক রোববার' পত্রিকায়_ 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা : ওরা এখন কোথায়?' এই শিরনামে (সাপ্তাহিক রোববার, ২১ সেপ্টেম্বর, ৫ অক্টোবর, ১২ অক্টোবর ও ১৯ অক্টোবর, ১৯৮৬)। সেই লেখায় আক্ষেপ ছিল_ ওই মামলায় অভিযুক্ত হয়ে যারা সেদিন পাক বাহিনীর বর্বর নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার দুঃসাহস দেখিয়ে আমাদের দুঃসাহসের পথ দেখিয়েছেন, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তনটি ঘটিয়েছেন, এই জাতি তাদের সম্মান বা মর্যাদা দিতে এত কৃপণ কেন? আমাদের আন্দোলনের মুখে 'ষড়যন্ত্র মামলার ষড়যন্ত্র' নস্যাৎ হওয়ার পর সেদিনের রেসকোর্স ময়দানে (আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সংবর্ধনা সভার আয়োজন হয়েছিল। সেখানেই ঘটেছে আমাদের কৃপণতার নিষ্ঠুর বহিঃপ্রকাশ। সবার প্রত্যাশা ছিল সেই বিশাল জনসমাবেশের মঞ্চে থাকবেন মামলায় অভিযুক্ত ৩৫ আসামি। ইতিহাসের এই নায়কদের সবাই এক নজর দেখতে উদগ্রীব ছিলেন। ভেবেছিলাম আমাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান নিজে তার এই সহবন্দীদের এক এক করে জাতির সামনে তুলে ধরবেন। কিন্তু তা হয়নি। তাদের মঞ্চে উঠতে দেওয়া হয়নি। নেতা একাই মঞ্চে উঠলেন। তাদের অনেকে জনতার কাতারে এতিমের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। আক্ষেপ করে লিখেছিলাম, 'ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্তদের কাউকেই মঞ্চে দেখলাম না, একমাত্র রুহুল কুদ্দুস সাহেব ছাড়া'। কয়েক দিন পর 'সাপ্তাহিক রোববার' অফিসের মাধ্যমে একখানা চিঠি পেলাম। চিঠিটা লিখেছেন স্বয়ং রুহুল কুদ্দুস সাহেব। তিনি পাকিস্তান সরকারের জাঁদরেল সিএসপি অফিসারদের একজন। বলা হয়, শেখ সাহেবের ঐতিহাসিক 'ছয় দফা' দাবিনামা তিনি এবং আরও দুই সিএসপি শামসুর রহমান খান ও আহমদ ফজলুর রহমান তৈরি করেছিলেন। তারা তিনজনই ওই মামলায় আসামি হয়ে চাকরিচ্যুত ও চরম নিগ্রহের শিকার হন। রুহুল কুদ্দুস সাহেব আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে এবং বিলম্বে হলেও তাদের স্মরণ করার জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সব শেষে লিখেছেন, 'তবে আপনি যে লিখেছেন আমি ওই দিন সভামঞ্চে ছিলাম, তা ঠিক নয়। আমিও সেদিন অন্যদের মতো মঞ্চের বাইরে জনতার কাতারেই ছিলাম'!
ওরা সব স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার লক্ষ্য ছিল স্পষ্ট। বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ জনকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন চিরদিনের মতো স্তব্ধ করে দেওয়া। 'রক্তের ভাষায়' ৬-দফার জবাব দেওয়ার হুংকার দিয়েছিলেন আইয়ুব খান। তারই প্রথম পদক্ষেপ ছিল এই 'ষড়যন্ত্র মামলার ষড়যন্ত্র'। মূল টার্গেট শেখ মুজিবুর রহমান। আমরা সেদিনের ছাত্র সমাজ, বিশেষ করে সেদিনের ছাত্রলীগের অকুতোভয় সৈনিকরা, তার বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধে নেমেছিলাম। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা তো বটেই, দ্বিতীয় সারির নেতারাও প্রায় সবাই তখন কারাগারে। তাই এ যুদ্ধের দায়-দায়িত্ব বারোআনাই পড়েছিল ছাত্রসমাজের ওপর।
কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় 'মুজিব ভাইকে' যে কথা দিয়েছিলাম তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। সামরিক সরকারের নির্মম দমন-পীড়ন ও দলের ভেতরে ভাঙন ধরানোর নানামুখী প্রয়াস ঠেকিয়ে আন্দোলন জোরদার করার জন্য আমরা সারা দেশ চষে বেড়িয়েছি। সেই যুদ্ধে আমরা জয়ী হয়েছিলাম। কীভাবে জয়ী হয়েছিলাম, সেজন্য কতটা জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়েছে, কী অমানুষিক শ্রম বিনিয়োগ করতে হয়েছে, সে কাহিনী স্বাধীনতার সর্বোচ্চ বেনিফিশিয়ারি আজকের শাসকশ্রেণি ভুলেও মনে করতে চায় না। বঙ্গবন্ধুর পরিবারও না। তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে সেদিন আমরা যদি সেই যুদ্ধে জয়ী হতে না পারতাম, তথাকথিত 'ষড়যন্ত্র মামলার' বিশেষ আদালতে পাকিস্তানি বিচারপতি এস এ রহমান যদি তার 'পূর্ব-নির্ধারিত' রায় পড়ে শোনানোর সুযোগ পেতেন, তাহলে ওই অভিযুক্তদের কাউকেই হয়তো আর আমরা ফিরে পেতাম না। তার জের কি শেখ হাসিনা এবং তার পরিবারকেই সবচেয়ে বেশি বহন করতে হতো না? যেমন বহন করতে হচ্ছে কর্নেল তাহের, জেনারেল মনজুর এবং অন্য অনেক পিতৃহারা পরিবারকে?
আল্লাহতায়ালা অনেক মেহেরবান। তিনি শেখ হাসিনাকে স্বজন হারানোর রক্তক্ষরা বেদনার মূল্যে জয়মাল্য দিয়েছেন। সেজন্য তিনি শোকর-গোজার করবেন। তবে ক্ষমতার মঞ্চের চোখ-ধাঁধানো আলোকচ্ছটায় ইতিহাস ভুলে যাওয়া ঠিক নয়। সেই চরম দুঃসময়ে ইতিহাসের চাকা ঘুরিয়ে দেওয়ার নির্মাণ-শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধ করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। তার পক্ষেও নয়।
লেখক : রাজনীতিক, ভূ-রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক।