পবিত্র শবে বরাতে যখন বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় মুসলমানরা আল্লাহর কাছে রহমত চায় তখন অমানুষগুলো কি করে? বাংলাদেশে শবে বরাত একটি বিশ্বাসের ব্যাপার। এখানকার মুসলমানরা বিশ্বাস করেন, শবে বরাতে আল্লাহতায়ালা তার রহমতের দরজা খুলে দেন, বান্দা যে যত পাপীই হোক না কেন, আল্লাহর কাছে পরিচ্ছন্ন মনে মাফ চাইলে আল্লাহ মাফ করে দেন। পানা চাইলে আল্লাহ পানা দেন। এটা হলো বিশ্বাসের কথা। বাংলাদেশের মুসলমানরা এরকম বিশ্বাস করে, সৌদি আরবে করে না। রিয়াদ থেকে বন্ধুবর শাজাহান ভুঁইয়া বরাতের রাত গত দিনে ফোন করেছিলেন। তিনি বললেন, ওখানে শবে বরাত বলতে আমাদের দেশের মতো কিছুই নাই।
সৌদি আরবের কথা থাক। বাংলাদেশের কথা বলি। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বাঙালিরা মানুষ হিসেবে, জাতি হিসেবে অনেক বড়। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলমান হলেও খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ দেশকে মডারেট গণতন্ত্রের দেশ বলে মনে করে। একেবারে সাম্প্রতিকতম কয়েকটি ঘটনা বাদ দিলে আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিমাণ কম। যাওবা হয়েছে তা যতটা না ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক, তারচেয়ে বেশি রাজনৈতিক কায়েমি স্বার্থবাদী। ধর্মকে সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে পালন করে, নীতিবোধ হিসেবে মেনে চলে। কিন্তু যারা সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক উঁচুতে, যাদের অসাধারণ বলা যায়, তারা এ ধর্মীয় বোধকে ব্যবহার করে তাদের স্বার্থে কাজে লাগায়। আর যখন প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় তখন এসব মূল্যবোধ ও নৈতিকতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নিচে দাবিয়ে রাখতে এতটুকু কুণ্ঠাবোধ করে না। আর যদি তারা বা তিনি হন একজন সরকারদলীয় নেতা, মন্ত্রী, এমপি তখন তো ধরা সরা সমান হয়ে যায়। আমি নিজেই নিজেকে জিজ্ঞাসা করছিলাম, যখন বরাতের রাতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আল্লাহর সামনে নত হয়, কোনো কোনো লেখায় আছে, বিশ্বের তাবৎ প্রাণী এমনকী উদ্ভিদ গোছেরও তো প্রাণ আছে। আল্লাহর সামনে হেলে পড়ে, তখন বোধ, হৃদয়, বিবেচনাহীন পাষণ্ডরা কি করে?
শবে বরাতের পরের ভোরে মিরপুর থেকে আমার সংগঠন নাগরিক ঐক্যের কেন্দ্রীয় নেতা শহীদুল্লাহ কায়সার ফোন করলেন। কালশীর বিহারি ক্যাম্পে মর্মস্তুদ হত্যাকাণ্ডের কথা বললেন। শবে বরাতে পত্রিকাগুলো বন্ধ থাকে, অতএব টেলিভিশনের আশ্রয় নিলাম। স্ক্রলে দেখলাম বলা হচ্ছে, আতশবাজির ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেখানে সংঘর্ষ হয়েছে। কিন্তু আমি যে শুনলাম ঘরে আগুন দেওয়া হয়েছে এবং সেই আগুনে পুড়ে মারা গেছে চার শিশুসহ অন্তত আট জন। এবং সেই ঘরে নাকি বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কি হৃদয়হীন বর্বরতা। উন্মত্ত পাষবিকতা। কালশীর বিহারি ক্যাম্পে যারা বাস করেন তাদের আমি আজ কয়েক বছর ধরে চিনি। এরাই হচ্ছে সত্যিকার সেই বিপর্যস্ত বিধ্বস্ত উদ্বাস্তু। সেই লিও উরিসের একসোডাস উপন্যাসের মতো। আমি অবশ্য ইহুদিদের সঙ্গে বিহারিদের তুলনা করছি না। কিন্তু উদ্বাস্তুদের কষ্টটা এক রকমই হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় মিরপুর মোহাম্মদপুরের বিহারিরা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল, তাই থাকার কথা। তারা তো বাঙালি নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তারা পাকিস্তানে ফেরত যেতে চেয়েছিল। নিজেদের তারা আটকেপড়া পাকিস্তানি হিসেবে পরিচয় দিত। কিন্তু ইতিহাসের নির্মম পরিণতি পাকিস্তান তাদের ফেরত নেয়নি। তখন তারা সত্যি সত্যি এক ভাসমান জনগোষ্ঠী, অজানায় আটকেপড়া।
সেই থেকে ৪৩ বছর পার হয়েছে। ছিন্নমূল বাস্তুহারা বিহারিরা ক্যাম্পের বস্তিতে আশ্রয় পেয়েছে এবং সেখানেই জীবনযাপন করছে। সেখানেই তাদের সন্তান-সন্ততি জন্মেছে। যাদের অনেকের বয়স এখন চলি্লশের কোঠায়। ওই সব মানুষ আর আটকেপড়া পাকিস্তানি নয়। জন্মগতভাবে তারা বাঙালি। নিজেদের অস্তিত্বের জন্যই তারা এক থেকেছে, লড়াই করেছে। আইনি লড়াইয়ে জিতে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়েছে।
নাগরিকত্ব পেয়েছে ঠিক, কিন্তু এখনো তারা নাগরিকের সব অধিকার ফিরে পায়নি। তাদের বাংলাদেশের পাসপোর্ট দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া বাসস্থান তো এখনো কার্যত নেই। এ জন্যই এখনো তারা একাট্টা। নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে দুর্গত মানুষদের একটা ঐক্য থাকেই। আমি যতবার তাদের দেখেছি, তাদের মধ্যে এ সুদৃঢ় ঐক্য দেখেছি। টেলিভিশনের স্ক্রলে আমার বিশ্বাসই হতে চাইল না যে, এরা শবে বরাতে নিজেদের মধ্যে এতবড় কোন্দলে জড়িয়ে গেছে খুব তুচ্ছ আতশবাজিকে কেন্দ্র করে। যা শেষ পর্যন্ত ঘরে তালা লাগিয়ে আগুন দিয়ে ৮/৯ জন মানুষকে হত্যা করেছে। কিন্তু সময় যত এগুতে লাগল তখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে তথ্যটি জানা গেল, তা হলো এই, ক্যাম্পবাসি সবাই একত্রিত হয়ে লাশ ছিনিয়ে নেওয়ার পুলিশি অপতৎপরতাকে রুখে দিয়েছে। কই তাদের মধ্যে সংঘাত তো দূরের কথা অনৈক্যের চিহ্ন পর্যন্ত দেখা গেল না।
পাঠকবৃন্দ পরবর্তী ঘটনা প্রবাহগুলো আপনারা নিশ্চয়ই পত্রিকায় পড়েছেন। সংবাদ মাধ্যমগুলো বলেছে, এক. চার একরেরও বেশি কিছু জমির ওপর লোভ ছিল একটি হাউজিং কোম্পানির। যার মালিকের আত্দীয় ওখানকার স্থানীয় সংসদ সদস্য। দুই. আতশবাজিকে কেন্দ্র করে যে সংঘাতের কথা বলা হচ্ছে, সেটি আসলে বিহারিদের সঙ্গে যুবলীগের সংঘর্ষ ছিল। আতশবাজি নিয়ে সেখানে কোনো সমস্যা তৈরি হয়নি। তিন. এ পর্যন্ত মারা গেছেন ১০ জন। এর মধ্যে নয় জন আগুনে পুড়ে আর একজন পুলিশের গুলিতে। এ তথ্যগুলো কী ঠিক? ঠিক নয়? পুলিশ এবং প্রশাসনের কাছে জবাব চাই। নয়জন মানুষ পুড়িয়ে মারার পরও সেই ভারাক্রান্ত মানুষগুলোর ওপর গুলি চালাতে হলো পুলিশের? এর আগেও পুলিশের ওপর বিহারি যুবক জনিকে শত শত লোকের সামনে পেটাতে পেটাতে ধরে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ আছে। অভিযোগ আছে জানির পায়ে গুলি করে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার। এই দুই যুবকই পুলিশের হেফাজতে মৃত্যুবরণ করে বলে অভিযোগ আছে। দুঃখজনক হলেও এ ঘটনা ঘটার পর পুলিশ যাদের নামে মামলা দিয়েছে তারা সবাই বিহারি। আজাদ বলে এক যুবকের নামে তিনটি মামলা দেওয়া হয়েছে, যে মারা গেছে।
দেশজুড়ে দীর্ঘদিন পুলিশ-র্যাবের বিরুদ্ধে এ ধরনের নিষ্ঠুরতার অনেক অভিযোগ আছে এবং অভিযোগ আছে এসবই করা হয় ক্ষমতার চাপে। কালশীর বিহারিরা অভিযোগ করেছেন, এ ঘটনায় স্থানীয় এমপি সরাসরি যুক্ত আছেন। বিদ্যুতের সংযোগ নিয়ে বিহারিদের সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্যের ঝগড়ার কথা সবাই অবগত আছেন।
স্বাধীনতার চার দশক পরে আজ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় হয়েছে এই বিহারিদের সম্পর্কে রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার করার। হাইকোর্টের রায়ের পরও কি বাংলাদেশ তাদের নাগরিক বলে স্বীকার করবে না? তাদের সম্পূর্ণ নাগরিক অধিকার দেবে না? এই যে দশজন মানুষ সকরুণ মৃত্যুবরণ করল তার তদন্ত হবে না? বিচার হবে না? নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা যেমন হৃদয়বিদারক এই দশজনের মৃত্যু তার চেয়ে বেশি করে হৃদয়কে বিদীর্ণ করে না? রাষ্ট্রের হৃদয় না থাকতে পারে; রাষ্ট্র যারা চালান তারা কি সবাই হৃদয়হীন? সরকারের যিনি কর্ণধার তিনি নিজে নিজেই নারায়ণগঞ্জের একটি পরিবারের দায়িত্ব নিতে চান। এই বিহারিদের, সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর দায়িত্ব নেওয়ার কেউ নেই? এই যে দশজন মানুষ আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেল তারপরও কি আমাদের বিবেক জাগ্রত হবে না। আর কত জীবন গেলে আমরা হৃদয়বান হব? সাহসী হব?
৬৫ বছরের পুরনো দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছে আমি কি প্রশ্ন করতে পারি_ ফেনী, লক্ষ্মীপুর, নারায়ণগঞ্জ হয়ে মিরপুর পর্যন্ত অন্তত চারজন সংসদ সদস্যের নামে খুনের অভিযোগ উঠেছে। আওয়ামী লীগ নির্বিকার থাকছে কিভাবে? মিরপুরের হৃদয়হীন বর্বরতার পর আমাদের অবশ্যই জেগে ওঠার সময় হয়েছে। বলার সময় হয়েছে, 'মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাহি, নাহি কিছু মহীয়ান।
লেখক : রাজনীতিক, আহ্বায়ক নাগরিক ঐক্য।
ই-মেইল :[email protected]