বাঙালির জাতীয় জীবনে ১৫ আগস্ট সবচেয়ে বেধনাবিধুর রাত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে বাঙালি হারিয়েছিল তাদের জাতির জনককে আর বাংলাদেশ হারিয়েছিল তার হাজারও বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে। ওই দিন রাতে শুধু বঙ্গবন্ধু নয়, হত্যা করা হয় বেগম মুজিবসহ প্রায় পুরো পরিবার, সেই বর্বরতা থেকে বাদ যায়নি ছোট রাসেলও। তাই আজও বাঙালিরা ওই দিনটিকে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। দিনটিকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করে। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে, তার আত্মার শান্তির জন্য দোয়া মিলাদ-মাহফিলের আয়োজন করে। আর বাঙালি জাতির সেই কলঙ্কিত দিনটিতে আমাদের বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তার বিতর্কিত জন্মদিনটিকে খুব উৎসব আমেজের সঙ্গে পালন করে থাকেন।
তার এ জন্মদিনটি নিয়ে অনেক তর্ক ও বিতর্ক আছে। এ পর্যন্ত বিভিন্ন ডকুমেন্ট থেকে তার তিনটি ভুয়া জন্মদিনের তারিখ পাওয়া গেছে। স্কুল সার্টিফিকেট, বিয়ের কাবিননামা ও পাসপোর্ট প্রতিটিতে তার পৃথক জন্মদিনের তারিখ উল্লেখ রয়েছে। ম্যাট্রিক পরীক্ষার মার্কশিট অনুসারে খালেদা জিয়ার জন্মদিন ১৯৪৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। বিয়ের কাবিননামা অনুসারে তার জন্মদিন ১৯৪৪ সালের ৯ আগস্ট। ২০০০ সালের ভোটারের তথ্য বিবরণী ফরমে খালেদা জিয়া উল্লেখ করেন, তার জন্মদিন ১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট! ১৯৯১ সালের ২০ মার্চ দৈনিক বাংলা পত্রিকায় সরকারি সংবাদ সংস্থা বাসস থেকে পাঠানো তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জীবনী ছাপা হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, তার জন্মদিন ১৯৪৫ সালের ১৯ আগস্ট। আগে এত ঘটা করে তার জন্মদিন পালনের কথা শোনা না গেলেও ক্ষমতা হারানোর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ১৫ আগস্ট বেশ ঘটা করে সারা দেশকে জানিয়ে আনন্দ মিছিল বের করে তিনি তার জন্মদিন পালন করে থাকেন। ১৫ আগস্ট ২০১০ তারিখের দৈনিক যুগান্তরের রিপোর্ট অনুসারে সাবেক হুইপ জামালের পরামর্শে তিনি ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন করা শুরু করেন।
তার দলের অনেকেই এই দিনে জন্মদিন পালন নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেন। জানা গেছে, বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতা জাতীয় শোক দিবসের দিনে ফলাও করে জন্মদিন পালনে আগ্রহী নন। তা ছাড়া দলের শতকরা ৯০ ভাগ নেতা-কর্মীর প্রশ্ন কেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন করা হচ্ছে। যিনি জাতির মহান নেতা, যার সংগ্রামের কারণে আত্দত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হলো, এমনকি যার কারণে বেগম খালেদা জিয়ার নিজের সম্মান, মর্যাদা নিশ্চিত হলো, যার মহানুভবতায় বেগম জিয়া পারিবারিক ও সামাজিকভাবে পুনরায় স্বীকৃতি পেলেন, তার মৃত্যু দিবসে তিনি কেক কেটে জন্মদিন পালন করেন। এটি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত নিকৃষ্ট ও অসভ্য মানসিকতার পরিচয় বহন করে। এভাবে জন্মদিন পালন করা নিয়ে অনেক কঠোর সমালোচনার সম্মুখীন তিনি হয়েছেন, তারপরও তিনি ক্ষান্ত হননি। তার বিবেকে সামান্যতম লজ্জাবোধ অনুতাপ জাগ্রত হয়নি।
বিএনপির দলীয় নেতা-কর্মীদের অনেকেই তাকে এ দিনে জন্মদিন পালন না করতে অনুরোধ করেন। প্রথম সেই কাজটি করলেন সাবেক সংসদ সদস্য, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান। এই নেতা বলেছেন, 'আমাদের নেত্রীর ১৫ আগস্টে ফেইক জন্মদিন পালন করাটা আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।' তিনি এ দিনে জন্মদিন পালনকে অশালীন, অসৌজন্যমূলক বলে অভিহিত করেন। দল ও দেশের বৃৃহত্তর স্বার্থে ১৫ আগস্ট তথাকথিত জন্মদিন পালন থেকে বিরত থাকার জন্য খালেদা জিয়ার প্রতি অনুরোধ জানান। তারপরও বেশ ধুমধাম করে বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন কেক কেটে ব্যান্ড বাজিয়ে পালন করা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার টেলিফোন সংলাপের সময় খালেদা জিয়া ১৫ আগস্ট কেন জন্মদিন পালন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রশ্ন তুললে জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, ১৫ আগস্ট আমার জন্মদিন। আমি কেক কাটবই। এতে বোঝা যায় তিনি কতখানি শিষ্টাচার-বহির্ভূত।
তার এই জন্মদিন পালনের পেছনের মূল কারণ হলো প্রতিহিংসাপরায়ণতা। কৃতজ্ঞতাবোধহীন, শ্রদ্ধাহীন, সামান্যতম সম্মানবোধহীন, দেশপ্রেমহীন, জনগণের প্রতি সম্মানবোধহীন একজন মানুষ তিনি। খালেদা জিয়ার যদি সামান্য কৃতজ্ঞতাবোধ থাকত, নিজের ইজ্জতের প্রতি যদি সামান্য সম্মানবোধ থাকত, তাহলে এই দিনে উৎসব করতে পারতেন না। মাঝে মাঝে ভেবে অবাক হতে হয়, আমাদের দেশের সেরা প্রথম সারির নেতাদের আপসহীনতা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সত্যি না হলেও তর্কের খাতিরে ১৫ আগস্ট যদি বেগম জিয়ার জন্মদিন হয়েও থাকে তবুও জাতির জনকের নির্মম হত্যার এই শোকাহত দিনে রাজকীয়ভাবে বর্ণাঢ্য জন্মদিনের উৎসব এভাবে পালন না করলেই তিনি অনেক বেশি গৌরবের অধিকারী হতেন। যা তিনি তার মূর্খতা ও অশিষ্টতার কারণে বুঝতে সক্ষম হচ্ছেন না। ১৫ আগস্টে জন্মদিন পালন কৌশলে বঙ্গবন্ধুকে মরণোত্তর অপমানের একটি প্রক্রিয়া। বঙ্গবন্ধুকে তিনি জাতীয় নেতা হিসেবে মূল্যায়ন তো করেন না, বরং তার অপমান করছেন। হিংসার বশবর্তী হয়ে, বঙ্গবন্ধুকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য তিনি এসব করছেন। এভাবে তিনি শুধু বঙ্গবন্ধুকে অপমান করছেন না, বাঙালি জাতিকে অপমান করছেন, স্বাধীনতাকে অপমান করছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করছেন, আমাদের দেশপ্রেমকে পদদলিত করছেন। ১৫ আগস্টের দিনে এত বড় একজন নেত্রীর মিথ্যা জন্ম নিয়ে আস্ফালন করা কখনো সুস্থ মানসিকতার পর্যায়ে পড়ে না।
১৫ আগস্টকে শোক দিবস হিসেবে পালনের রায়ে বিচারপতি আবদুর রশিদ লিখেছেন- 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানুষের ধরাছোঁয়ার ঊর্ধ্বে একটি ইতিহাস। তার কণ্ঠস্বর আজও লাখ লাখ মানুষের হৃদয়কে আন্দোলিত করে। এ জাতি হয়তো নিজ রাষ্ট্রের সংগ্রাম ও বিজয়ের অর্জনসমূহের মূল্যায়নে অভিন্ন অবস্থানে নাও পৌঁছাতে পারে, কিন্তু তাই বলে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতাকে কাপুরুষোচিতভাবে হত্যার দিনটিকে সবটুকু শ্রদ্ধা ও গাম্ভীর্যে স্মরণ করার অধিকার হতে বঞ্চিত হতে পারে না। জাতীয় শোক দিবস পালন হবে মুজিব নামের এক কিংবদন্তির প্রতি নূ্যনতম শ্রদ্ধা নিবেদন।' যার কাছে সব বাঙালি চিরকৃতজ্ঞ। দেশে দেশে যে জাতির জনকদের নাম মানুষের মুখে ধ্বনিত হয়- মহাত্মা গান্ধী, নেলসন ম্যান্ডেলা, জর্জ ওয়াশিংটন। তাদের নামের কাতারে শেখ মুজিবের নাম কোনোভাবেই বেমানান নয়। অবদানে শৌর্যে-বীর্যে এবং এই আসনে দ্বিতীয়জন অনুপস্থিত। এটা আমাদের স্বীকার করতেই হবে। সমমর্মিতা মানুষের সহজাত ধর্ম। পাশের বাড়িতে কোনো শোক সংবাদে প্রতিবেশী তার আনন্দ উৎসবগুলো সেভাবে প্রকাশ করে না, বরং সমমর্মী হয়ে তাদের পাশে দাঁড়ায়। এটাই আমাদের সামাজিক রীতি। আমাদের রাজনীতিবিদরা সেটা বিচার-বিবেচনা করে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবেন এটাই তাদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : সাবেক কূটনীতিবিদ
Email: wali.heritage¦gmail.com