ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখার্জির এডিশনাল প্রাইভেট সেক্রেটারি প্রদ্যুৎ গুহর ছেলে অভিমন্যুর বিয়েতে ২ আগস্ট দিল্লি গিয়েছিলাম। ৩ আগস্ট রাষ্ট্রপতি ভবনের আর বি ক্লাবের খোলা মাঠে এক বিশাল আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। শ্রী প্রদ্যুৎ গুহ অনেক বছর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আছেন। আমি যখন ভারতে নির্বাসিত ছিলাম তখন তিনি পশ্চিমবঙ্গ যুব কংগ্রেসের খুবই জনপ্রিয় সভাপতি ছিলেন। তাই তার একমাত্র ছেলের বিয়েতে উপস্থিত থাকার আহ্বান উপেক্ষা করতে পারিনি। কয়েক হাজার অতিথির মধ্যে ছেলে এবং ছেলের বউকে দেখাতে তিনি যে যত্ন নিয়েছেন তা মনে রাখার মতো। বিয়েতে গিয়ে সবচেয়ে লাভ হয়েছে প্রায় ৫-৭ বছর পর মায়া রায় এবং তপন চক্রবর্তীর সঙ্গে একসঙ্গে খাওয়া। নির্বাসিত থাকার সময়ে রাশ বিহার এভিনিউর তপন চক্রবর্তীর বাড়িতে আমরা বেশ কিছু দিন কাটিয়েছি। সেখানে যেমন গিয়াস ছিল, সুলতান ছিল, সদ্য প্রয়াত নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য নাসিম ওসমানও ছিল। সেই তপন চক্রবর্তীকে হঠাৎই বিয়ের অনুষ্ঠানে পেলাম। পশ্চিমবঙ্গ রাজনীতির অনেক রথি-মহারথি তার বন্ধু। প্রিয়রঞ্জন দাস মুন্সী, সৌগত রায়, সোমেন মিত্র, সুব্রত মুখার্জি অনেকে তার বন্ধু, অনেকে আবার সাথী। আমি যখন সুবীর ঘোষের এলগিনের বাড়িতে থাকতাম তখন প্রিয় রঞ্জন দাস মুন্সীর ছোট ভাই গোপাল দাস মুন্সীর বিয়েতে গিয়েছিলাম। প্রিয় বাবু রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন তাই তার ছোট ভাই আগে বিয়ে করেছেন। বড় ভাইর বিয়ে হয়েছে অনেক পরে। প্রদ্যুৎ গুহর ছেলের বিয়েতে ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি, বর্ষীয়ান জননেতা শ্রী প্রণব মুখার্জি এসেছিলেন। প্রায় চার ঘণ্টা ছিলেন, সবার সঙ্গে দেখা করেছেন। আমিও আর বি ক্লাবে এক ঝলক দেখা করেছি। আমাকে দেখেই বলেছিলেন, 'বাঘা, এদিকে এসো। আমার পাশে বসো।' ধুতি পাঞ্জাবি, সাদা জওহর কোট পরা তাকে দারুণ দেখাচ্ছিল। আমার পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা, গলায় গামছা কালো মুজিব কোট। আমার দেশে যেটা মুজিব কোট, ভারতে সেটা জওহর কোট। পণ্ডিত জওহর লাল নেহেরু সব সময় গায়ে দিতেন বলে ভারতে জওহর কোট। তারটার রঙ সাদা, আমারটা কালো- এই যা পার্থক্য। পরদিন রাষ্ট্রপতি ভবনে তার অফিসে সাক্ষাৎ। ১০ মাস আগেও ৪-৫ বার সাক্ষাৎ করেছি, মাতৃসম দিদি সুভ্রা মুখার্জির পাশে বসে খাবার খেয়েছি। কিন্তু মহামান্য রাষ্ট্রপতির সরকারি অফিসে এই প্রথম দেখা। অনেকগুলো বই নিয়ে গিয়েছিলাম তার জন্য। রাষ্ট্রাচারের লোকজন প্রথম আপত্তি করেছিল, পরে সবক'টি নিতে রাজি হয়। অনেক আলাপ হয়েছে। অন্যখানে অন্য কোনো দিন শুধু মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথাবার্তা নিয়ে লিখব। আজ অন্য কথা। দিল্লি রওনা হয়েছিলাম ২ আগস্ট। ১২.৫০ এ ফ্লাইট ছিল। ১.০৫ বা ১.০৭ এ জাহাজ আকাশে উড়ে। কিন্তু দিল্লি পৌঁছে ছিল একেবারে ঘড়ির কাঁটা ধরে ভারতীয় সময় ২.৫০ মিনিটে। জাহাজের চালক ছিলেন ক্যাপ্টেন জয়নাল। অসম্ভব সুন্দর ওঠানামা করেছেন। নামার সময় ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দরে আমি তাকে ধন্যবাদ জানাতে গিয়েছিলাম। বিমানবালাদের মধ্যে হঠাৎই টুঙ্গিপাড়ার কাজী পরিবারের রুনু কাজীর ছোট বোন মৌর সঙ্গে দেখা। '৯৩-৯৪ এর দিকে আমি যখন টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার মৃত্যুবার্ষিকী পালন করতে যেতাম, রাস্তাঘাট ঝাড়ু দিতাম তখন খুব ছোট বাচ্চা হিসেবে রুনু এবং অন্য মেয়েরা, আক্কাস এবং ১০-১২ বছরের ছেলেরা আমার সঙ্গে মাইলকে মাইল রাস্তা ঝাড়ু দিত। মেয়েটি আমাকে দেখে পাগল হয়ে গিয়েছিল। তার প্রথম কথা, 'মামা, টুঙ্গিপাড়ার রুনুকে চেনেন? আমি তার ছোট বোন। মাস কয়েক হয়েছে চাকরি হয়েছে।' ছুটে এসে সালাম করতে করতে বলছিল, 'মামা, ড্রেস পরেই সালাম করলাম।' ওর হয়তো মনে হয়েছে ড্রেস পরে সালাম করা যায় না। যাই হোক ওর জাহাজে আমাকে পেয়ে একেবারে পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল। কি রেখে কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। সামনে পেছনে ছোটাছুটি করছিল আর ক্ষণে ক্ষণে আমাকে জিজ্ঞেস করছিল, 'মামা, তোমার কিছু লাগবে?' আমি পেটুক স্বভাবের নই, বেশি কথা বলাও আমার ভালো লাগে না। তাই তাকে খুশি করতে পারিনি। আরেক বিমানবালা মিলি, তার নানার বাড়ি টাঙ্গাইলের বাজিতপুরে। পরিচয় দিয়ে বলছিল, চা না কফি দিব? বলছিলাম মৌ আমাকে ভালো করে চা খাওয়াতে চেয়েছে।
এখন আমি কী করব? ওর সঙ্গে কথা বলে নেও। রুনুর বোন মৌ চা খাইয়েছে। ৯ তারিখ একই বিমানে ফিরেছি। যাওয়ার পথে ঠিক টাইম থাকলেও ফেরার পথে দুই ঘণ্টা লেট। তবে দিল্লি বিমানবন্দরে অপেক্ষা করতে খারাপ লাগেনি। সরকারি লোকজন সুন্দরভাবে বডিং করিয়ে ইমিগ্রেশন শেষ করে সুন্দরভাবে বসিয়ে দিয়েছিল। বিমান যখন রানওয়ের দিকে বেরোয় আমাদের সামনে আরও ৬-৭টা জাহাজ ছিল। মনে হয় এয়ার ইন্ডিয়া ৩টি, জেড এয়ার ২টি, ইন্ডিগো ২টি ওড়ার জন্য রানওয়েতে লাইনে ছিল। বছর বিশেক আগে হিব্রু আর ফ্র্যাঙ্কফোর্টে অমন দেখেছিলাম। এবার দিল্লি ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দেখলাম। কেবিন ক্রু এনাউন্স করছিল ক্যাপ্টেন শাহানা জাহাজের মূল পাইলট। ঘোষণা শুনে চমকে উঠেছিলাম। শাহানা আমার খুব প্রিয় নাম। আমার সব থেকে ছোট বোন শাহানা সিদ্দিকী। বিয়ের পর এখন শাহানা আহমেদ। ক্যাপ্টেন শাহানা একটি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। তার স্বামী ক্যাপ্টেন ইশতিয়াক হোসেন, শ্বশুর ক্যাপ্টেন মনোয়ার, খুব সম্ভবত সিরাজগঞ্জের দিকে ওদের বাড়ি। জীবনে অনেকের জাহাজে ভ্রমণ করেছি, ক্যাপ্টেন মাজেদ, ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন বীরউত্তম এ রকম আরও কতজনের বিমানে উঠেছি। আমার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ সংগ্রামী আশরাফ গিরানীর বড় ভাই ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ শাজাহান (নবাব) বহুদিন বিমান চালিয়েছেন। এমনকি মালয়েশিয়ার প্রাণপুরুষ মাহাথির মোহাম্মদের বিমান চালক ছিলেন। তাদের জাহাজেও উড়েছি। কিন্তু কোনো মেয়ে ক্যাপ্টেনের জাহাজে এই প্রথম। মাজেদকে যখনই কাছে পেয়েছি তার কাছে বিমান চালানোর অভিজ্ঞতা নিতে চেয়েছি। ওর কাছেই জেনেছি ওঠানামা ছাড়া এখন আর পাইলটের তেমন কাজ নেই। অনেক সময় ঘুমিয়েও চলে। তবে শাহানার চেয়ে ক্যাপ্টেন জয়নালের ওঠানামা ভালো লেগেছে। কিন্তু আমার দেশের একটা মেয়ে পাইলটের জাহাজে প্রথম উঠতে পেরে ভীষণ গর্ববোধ করেছি। আমার মেয়েরা যে অবলা নয়, সুযোগ পেলে তারাও যে আকাশে উড়তে পারে, দক্ষতার সঙ্গে জাহাজ উড়াতে পারে ভাবতে বড় গর্ব হয়েছে। ক'দিন হবে, ২-৩ বছর আগে পত্রিকায় দেখছিলাম আমাদের দেশে প্রথম মহিলা ট্রেন চালক, কিন্তু মেয়েরা প্লেন চালাচ্ছে তার অনেক আগে থেকে। ধীরস্থির শান্তভাবে আমার মেয়ে সন্তানেরা আরও অনেক এগিয়ে যাক, তারা বিশ্ব জয় করুক এমন প্রত্যাশা বুকে লালন করেই চলছি।
এবার শিরোনামের দিকে দৃষ্টি দিই। শিরোনাম করেছি এম জে আকবর। এম জে আকবর একজন মুসলমান সাংবাদিক, কলামিস্ট হিসেবে ভারতে প্রচুর নাম করেছেন। '৮৯ সালে কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে বিহারের কিশানগঞ্জ থেকে পার্লামেন্ট মেম্বার হয়েছিলেন। ভদ্রলোকের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় কলকাতার 'দি টেলিগ্রাফ'-এর সম্পাদক থাকার সময় থেকে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময় ঢাকায় এসেছিলেন। এম জে আকবরের কাছ থেকে জনাব এরশাদ যেভাবে লেখালেখি আশা করেছিলেন সেভাবে হয়নি, তাই হয়তো এরশাদ সাহেব কিছুটা মনোক্ষুণ্ন ছিলেন। ভদ্রলোক অনেক বই লিখেছেন। আগে কংগ্রেস করতেন, এখন বিজেপির মুখপাত্র। নির্বাচনের আগে শ্রী দামাদোর দাস নরেন্দ্র মোদির প্রতিনিধি হিসেবে মিডিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন। এখনো সে দায়িত্ব পালন করছেন। বহুদিন পর তার সঙ্গে দেখা হয়ে আমি যেমন খুশি হয়েছি, তার আগ্রহ দেখে মনে হয়েছে তিনিও খুশি হয়েছেন। তিনি ‘Tender Box The past & Future of Pakistan’ খুব আগ্রহ ভরে ‘To Tiger Siddique’ লিখে উপহার দিয়েছেন। বইটা পুরো পড়া হয়নি। পড়ে তাকে জানাব। কিন্তু এ ক'দিনে খণ্ড খণ্ড যতটুকু পড়েছি ভীষণ ভালো লেগেছে। সে কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান, খাজা নাজিমউদ্দিন, ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান অথবা মহাত্দা গান্ধী, পণ্ডিত জওহর লাল নেহরু, বল্লব ভাই প্যাটেল, নেতাজী সুভাষ যখন যার প্রসঙ্গই এসে থাকুক ভীষণ ভালো লেগেছে। আমি আবার ভালো ইংরেজি জানি না, কিন্তু তবু কোনো কোনো ইংরেজি পড়তে গিয়ে বাংলার মতো মনে হয়। শবেকদরের রাত বসে বসে কোরআন পড়ব, হাতিপাতি করে দেখি কোনো বাংলা কোরআন নেই। হঠাৎ দেখি আরবি থেকে ইংরেজি এক কোরআন রয়েছে। বের করে শুরু করেছিলাম ৯৭ নম্বর সুরা কদর। পড়তে গিয়ে মনে হলো এ যেন বাংলারও বাংলা। শত শতবার বাংলা কোরআন পড়েছি বলেই কিনা ইংরেজিতে শবেকদর সুরাটি পড়েও বাংলার মতো মনে হলো। হৃদয়ঙ্গম করতে সময়ের প্রয়োজন হলো না। ৯৭ সুরা থেকে শুরু করে কোরআনের ১১৪ সুরা শেষ হলে আবার প্রথমদিকে এলাম। ৭ আয়াতের সুরা ফাতেহা মুহূর্তেই শেষ হয়ে গেল। কোরআনের সারাংশ ২৮৬ আয়াতের সুরা বাকারা, যাকে অনেক সময় ছোট কোরআন বলা হয়। সুরা বাকারার ১৪০-১৪৭ আয়াত পর্যন্ত যেতে যেতে ফজরের আজান পড়েছিল। নামাজ পড়ে আরও কয়েক আয়াত পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কোরআনের ইংরেজি তর্জমা আমার কাছে ভীষণ ভালো লেগেছে। তাই খটমট ছাড়া সোজা ইংরেজি অনেক সময় বাংলার মতো মনে হয়।
এম জে আকবরের ‘Tender Box The past & Future of Pakistan’আমার কাছে তেমনই মনে হয়েছে। পড়ছি, আরও হয়তো কয়েক দিন লাগবে। জনাব আকবর বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে খুবই আগ্রহী। বর্তমান সরকার বাংলাদেশ নিয়ে কী ভাবছে, কীভাবে দুই দেশের কার্যকরী সুসম্পর্ক আরও বৃদ্ধি করা যায় তা নিয়ে তারা চিন্তাভাবনা করছেন। জনাব আকবরের সঙ্গে কথা বলে যা মনে হলো তা হলো- তারা কোনো ব্যক্তি বা দলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী নন। তারা বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে একটা স্থায়ী সম্পর্ক তৈরি করতে চান। সেক্ষেত্রে যখন যিনি সরকারে আসবেন তার সঙ্গে একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক রক্ষা করে চলবেন। কিন্তু বিশেষ সম্পর্কে তারা পক্ষপাতী নন। তারা মূলত বাংলাদেশের সুস্থিতি চান। ভূখণ্ডের দিক থেকে বাংলাদেশ ছোট হলেও অবস্থানের দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গতকাল ছিল ১১ আগস্ট। মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীর জন্য একটি খুবই স্মরণীয় দিন। ঢাকার সদরঘাট থেকে সাতটি জাহাজে অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই করে ফুলছড়ি ঘাট থেকে ট্রেনে রংপুরে নিয়ে যাওয়ার পাকিস্তানি হানাদারদের একটা পরিকল্পনা ছিল। ওই সময় কিছু বাঙালি বন্দী ইপিআর দিয়ে সদরঘাটে যখন জাহাজভর্তি হচ্ছিল তখনই আমরা খবর পাই। সে হিসেবে ১১ আগস্ট ভূইয়াপুরের মাটিকাটায় হানাদারদের জাহাজের বহরের ওপর আক্রমণ করা হয়। ওই আক্রমণে বহরের সবচেয়ে বড় একটি জাহাজ ও একটি ট্যাঙ্কার মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। এই অভিযানের মূল দায়িত্বে ছিলেন কমান্ডার হাবিব। তার সঙ্গে সহযোগিতায় ছিল কমান্ডার রেজাউল করিম। জাহাজ দখলের পর প্রথম জাহাজে উঠেছিল কমান্ডার হাবিব, জমশেদ, সামাদ। সামাদ জাহাজে উঠে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় জাহাজের রান্নাঘরে গিয়েছিল। ক্ষুধার্ত ছিল, এক কোম্পানি হানাদারের খাবারের প্রায় ১২ আনা মাংস সামাদ চাকতে চাকতে খেয়ে ফেলেছিল। যে কারণে পরবর্তীতে তাকে গামা খেতাবে ভূষিত করেছিলাম। সমগ্র মুক্তিযুদ্ধে সে গামার মতোই কাজ করেছে। জামালপুর প্রেসক্লাবে ১১ তারিখ সামাদকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে বলে এক অ্যাডভোকেট ফোন করেছিলেন ক'দিন আগে। পিংনার সামাদ গামা মুক্তিযুদ্ধের এক বিখ্যাত যোদ্ধা। কিন্তু আজ সে নিঃস্ব রিক্ত। ভালোভাবে দুই বেলা খেতে পায় না। অ্যাডভোকেট বলেছিলেন, স্যার আপনার মনে আছে কিনা? স্বাধীনতার পরপরই আপনি পিংনা এসেছিলেন, লাখের ওপর লোক হয়েছিল। পিংনার সামাদ গামা এখন খুবই নিঃস্ব রিক্ত। আমরা তাকে জাহাজ মারা দিবস উপলক্ষে জামালপুর প্রেসক্লাবে সম্মান জানাব। ঠিক জানি না আদৌ সম্মান জানানো হয়েছে কিনা? আর কি সম্মান জানাবেন, পেটে ভাত না থাকলে তার কি সম্মান থাকে? তবু ভদ্রলোক সম্মান জানাতে চেয়েছিলেন তাই তাকে বা তাদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীতে বীরপ্রতীক আবদুল্লাহ সাহসিকতার জন্য খেতাব পেয়েছে। ভালুকার তামাটের আবদুল্লাহ এখনো আমার সঙ্গে থাকে। সাত-আট বছর আগে একদিন ইউনাইটেড হাসপাতালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে দেখতে গিয়েছিলাম।
রাষ্ট্রপতি থাকতে গুলশানের অমন জায়গা বিনা পয়সায় হাসপাতালের নামে বরাদ্দ দেওয়ায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হয়তো জনাব এরশাদের ফ্রি ট্রিটমেন্ট করেন কিংবা সম্মান দেখান। লিফটে ওঠার সময় একজন অবসরপ্রাপ্ত বীরপ্রতীক জেনারেল ছিলেন আর আমার সঙ্গে আবদুল্লাহ বীরপ্রতীক। টাই টুই কোট ছাড়া লিফটে জায়গা হচ্ছিল না বলে আবদুল্লাহকে নামিয়ে দিতে যাচ্ছিল। আমি যখন নেমে যেতে চাচ্ছিলাম তখন জেনারেল বীরপ্রতীকের কিছুটা হুঁশ হয়। তিনি হাসপাতাল দেখাশোনার চাকরি টাকরি করেন। বিরক্ত হয়ে বলেছিলাম, এখানে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বীরপ্রতীক মুখ্য নয়, এখানে মুখ্য হলো সামাজিক অবস্থান। আপনিও বীরপ্রতীক, আবদুল্লাহও বীরপ্রতীক। আপনার কত পজিশন, আর গরিব বলে আবদুল্লাহ কত অবহেলিত। তাই কী বলব, সামাদ গামার কথা! স্বাধীনতার পর সামাদেরও যদি কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা হতো, শিক্ষা-দীক্ষা থাকলে বড় পদ নিয়ে অবসর নিত, ধানমন্ডি-গুলশানে বাড়ি থাকত তাহলে কিনা হতো? আগস্ট বেদনার মাস, হৃদয় আমার খণ্ড-বিখণ্ড করা মাস। ১০ তারিখ রাখিবন্ধনের দিন বদিউর রহমান এসেছিল মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় ভূমিহীন ও দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৮-৯ লাখ টাকার তিন কামরার ৫০০ স্কয়ার ফিটের একটি বাড়ি নির্মাণের প্রকল্প নিয়েছে। প্রতি উপজেলায় সমানতালে ৮ জন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কোনো কোনো উপজেলায় ১০ জন মুক্তিযোদ্ধাও ছিল না, আবার কোনো উপজেলায় ২-৪-৫ হাজার বা তারও বেশি ছিল। কিন্তু বরাদ্দ একই রকম। আমার জেলায় কোনো কোনো উপজেলায় ২-৩ হাজার মুক্তিযোদ্ধাও ছিল। কিন্তু যে উপজেলায় ১০০ মুক্তিযোদ্ধা ছিল সেখানে ৮, যেখানে ৪-৫ হাজার সেখানেও ৮। ওসবের কোনো অর্থ বুঝি না। বদি এসেছিল ভূইয়াপুর উপজেলায় ৮ জনের মধ্যে তারও নাম আছে। প্রকল্প কমিটি বড় মজার। ইউএনও সভাপতি, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সহ-সভাপতি, সমাজসেবা অফিসার সদস্য, পল্লী উন্নয়ন অফিসার সদস্য, প্রাথমিক-মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার সদস্য, মুক্তিযোদ্ধা ডেপুটি কমান্ডার সদস্য-সচিব। হয়তো দেখা যাবে সভাপতি ইউএনও, সহ-সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের নাতির চেয়ে ছোট। কিন্তু তারই হাত-পা নাড়ানি সইতে হবে মুক্তিযোদ্ধাদের। কী করার! জামানা যেমন। বদির সমস্যা হলো মহামান্য উপজেলা অফিসার তালিকা পাঠানোর সময় ৫ জনের নামে যেখানে বাড়ি করতে হবে তার দাগ খতিয়ান দিয়েছে, বদিসহ ৩ জনের নামে দাগ খতিয়ান দেয়নি। এলজিআরডি-কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে গৃহনির্মাণ করতে। দাগ খতিয়ান নেই, তারা কোথায় বাড়ি করবে! ইউএনও'র কাছে দাগ খতিয়ান দিয়ে সুপারিশ পাঠাতে অনুরোধ জানালে তিনি ভেংচি কেটে বলেছেন, এলজিআরডি দাগ খতিয়ান চেয়ে চিঠি দিলে তবে তিনি দাগ খতিয়ান দিতে পারবেন, না হলে নয়। অভিযোগ শুনছি, পাঁচজনের টাকা-পয়সা খেয়ে দাগ খতিয়ান দিয়ে সুপারিশ করেছেন, তিনজন দেয়নি তাদের সুপারিশ করেননি। এখন এর বিচার কার কাছে দেব? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বোনের প্রতি গভীর আস্থা নিয়ে কখনো সখনো এটা ওটা বলতাম কিন্তু আশপাশে কুকর্ম দেখে মনটা বিষিয়ে যায়। এক্ষেত্রেও তাই পাখের তলে না থাকলে মুরগির বাচ্চার মতো সবাই যেন চিল দিয়ে খাওয়াতে চায়। বদি, আকরাম, সাঈদ এরা শুধু স্বাধীনতা যুদ্ধই করেনি, '৭৫-এ প্রতিরোধ সংগ্রামে শরিক হয়েছিল। যে কারণে তারা বহুদিন জেল খেটেছে। অবাক লাগে, '৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হলে ডিজিএফআই-র মেজর হিসেবে যে হেলাল মোর্শেদ টাঙ্গাইলের দায়িত্বে ছিল, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ সংগ্রামীদের চামড়া তুলে ফেলত, সে হেলাল মোর্শেদও নাকি আমার ভগ্নীর অতি বিশ্বস্ত। এখন কী বলি! জীবন বাজি রাখা মুক্তিযোদ্ধা, '৭৫-এর প্রতিরোধ সংগ্রামী তারা যদি এই সরকারের কাছ থেকে সামান্য সম্মান এবং মর্যাদা পেত তাহলে হয়তো ভবিষ্যতে আবার কেউ কোনো দুর্যোগে দেশ ও জাতির জন্য ত্যাগ স্বীকারে উৎসাহ পেত। সামাদ গামাকে জামালপুর প্রেসক্লাব অথবা সুধীজন সম্মান দেখিয়ে আমি মনে করি তারা নিজেরাই সম্মানিত হয়েছেন। আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
লেখক : রাজনীতিক।