১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট বিকালবেলা আমি বঙ্গভবনে জেলা গভর্নরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির শেষ ক্লাসটি নিই। ক্লাস শেষে জেলা গভর্নররা আমার সঙ্গে কথা বলেন। তাদের প্রায় সবাই একযোগে প্রতি জেলায় রক্ষীবাহিনীর একটি করে ইউনিট নিয়োগ করার জন্য আমাকে অনুরোধ করেন। আমি তাদের বলি, রক্ষীবাহিনীর এত সদস্য আমাদের নেই। যা আছে ইতিমধ্যে তাদের প্রয়োজনীয় স্থানে নিয়োগ করা হয়েছে। এরপরও তারা আমাকে এ ব্যাপারে অনুরোধ করতে থাকেন। কারণ, বেশির ভাগ জেলায় তখন সন্ত্রাসী তৎপরতা আবার বেড়ে গিয়েছিল। বাকশালের সদস্যরা আক্রান্ত হচ্ছিলেন। এতে তাদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়েছিল। তখনই সর্বত্র রক্ষীবাহিনী নিয়োগ করা সম্ভব নয়- এ কথা তাদের বোঝাতে আমার যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। তারপর সন্ধ্যাবেলা আমি অফিসে চলে আসি। ইতিমধ্যে সাভার রক্ষী প্রশিক্ষণকেন্দ্র থেকে লিডার এ কে এম নুরুল হোসেন, মঈন উদ্দিন চৌধুরী, দীপককুমার হালদার, সিরাজুল হক দেওয়ান ও সাহেব আলী মিয়া তাদের অধীন রক্ষী সদস্যদের নিয়ে ঢাকায় আসেন। তাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারদিকে টহল দেওয়ার জন্য পাঠানো হয়। উদ্দেশ্য ছিল একটাই- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সফরকালে যাতে কোনো ধরনের অঘটন না ঘটে, সব অনুষ্ঠান যাতে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সম্পন্ন হয়।
রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত আমি অফিসে ছিলাম। এরপর আমি অফিস থেকে বেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যাই। সেখানে টহলরত রক্ষী সদস্যদের সঙ্গে কথা বলি। কোথাও কোনো গণ্ডগোলের আভাস না পেয়ে আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত আমার স্ত্রী ডা. সাঈদা খানকে সঙ্গে নিয়ে আসাদ গেট এলাকায় বাসায় ফিরি। তারপর রাতের খাবার খেয়ে দ্রুত ঘুমাতে যাই। কারণ অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্য পরদিন সকালে আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কর্মসূচি ছিল।
সকাল সাড়ে ৫টা বা পৌনে ৬টা হবে। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। এমন সময় হঠাৎ টেলিফোনের শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি দ্রুত টেলিফোন ধরি। টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ শুনে আমি তো হতভম্ব। বঙ্গবন্ধু বললেন, 'শহীদ, মণির (শেখ মণি) বাসায় কালো পোশাক পরা কারা যেন অ্যাটাক করেছে। দেখ তো, কী করা যায়? আমি সঙ্গে সঙ্গে বলি, 'স্যার, আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি।' বঙ্গবন্ধু লাইন কেটে দেওয়ামাত্র আমি আমাদের ডিউটি রুমে ফোন করি। ডিউটি রুমে কর্তব্যরত রক্ষী কর্মকর্তার মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আমাদের যারা প্যাট্রোল ডিউটিতে ছিলেন তাদের তাড়াতাড়ি ধানমন্ডি এলাকায় শেখ মণির বাসায় যেতে বলি। আমার সরকারি গাড়ি থাকত আমাদের যানবাহন শাখায়। আমাদের যানবাহন শাখা ছিল সংসদ সদস্যদের বাসস্থান এলাকায়। সেখানে ফোন করে কাউকে না পেয়ে আমি ডিউটি রুমে বলি তাড়াতাড়ি আমার জন্য একটা গাড়ি পাঠাতে। এর মধ্যে আমি অফিসে যাওয়ার জন্য কোনো রকমে তৈরি হয়ে নিই। কারণ, বাসা থেকে সরাসরি যোগাযোগ করার কোনো সুবিধা ছিল না।
এ সময় আবার আমার বাসার টেলিফোন বেজে ওঠে। আমি দ্রুত টেলিফোন ধরি। এবার বঙ্গবন্ধুর বিশেষ সহকারী তোফায়েল আহমেদ আমাকে ফোন করে বলেন, 'রক্ষীবাহিনীর লোকেরা নাকি মণি ভাইয়ের বাড়িতে অ্যাটাক করেছে, তাড়াতাড়ি দেখ।' আমি তাকে বলি, 'রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা কেন মণি ভাইয়ের বাড়িতে অ্যাটাক করবে!' 'আমি দেখছি' বা 'ব্যবস্থা নিচ্ছি'- এ রকম কিছু বলেই ফোনটা রেখে আবার ডিউটি রুমে ফোন করি। ডিউটি রুমে কর্তব্যরত কর্মকর্তার কাছে আমি জানতে চাই, প্যাট্রোল ডিউটিতে যারা আছেন তাদের শেখ মণির বাড়ি যেতে বলা হয়েছে কি-না। উত্তরে তিনি জানান, মন্ত্রিপাড়ায়ও গোলাগুলি হচ্ছে। আমি বুঝতে পারি, ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে যাচ্ছে বা ঘটেছে। তাই আর দেরি না করে উপপরিচালক (অপারেশন) সরোয়ার হোসেন মোল্লাকে ফোন করি। তাকে অফিসে আসতে বলে আমি বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ি। ঠিক তখনই পরপর দুটি আর্টিলারি শেল আমার বাসার পাশে সেন্ট যোসেফ স্কুলের দেয়ালে পড়ে। দেয়ালটি ধসে যায়। সেখানে কয়েকজন হতাহত হন। আমার বাসার কাচের জানালায় ফাটল ধরে। ভাগ্যক্রমে আমার কোনো ক্ষতি হয়নি। আমার মনে হলো, হয়তো মিলিটারি ক্যু হয়েছে।
আর্টিলারি গোলাগুলো হয়তো আমার বাড়ি লক্ষ্য করেই নিক্ষেপ করা হয়েছে। কিন্তু লক্ষ্যচ্যুত হয়ে পাশে পড়েছে। তাই স্ত্রীকে বাসা ছেড়ে চলে যেতে বলে আমি প্রায় দৌড়ে যাই অফিসের দিকে।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমি অফিসে পৌঁছাই। আমাদের পরিচালকের কক্ষে গিয়ে টেলিফোনে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আবুল হাসান খানকে আমি তাড়াতাড়ি অফিসে আসতে বলি এবং সরোয়ারের বাসায় আবার ফোন করি। এবার তাকে পাইনি। পরে জেনেছিলাম, সরোয়ারও আমার মতো গাড়ি না পেয়ে দৌড়ে অফিসের দিকে রওনা হয়েছিল। রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে তখন মাত্র কয়েকজন কর্মকর্তা এবং এক কোম্পানি রক্ষী সদস্য ছিল। তারা প্রধান কার্যালয়ে বিভিন্ন ধরনের দায়িত্ব পালন করত। লিডারদের মধ্যে আলিমুজ্জামান জোয়ারদার এবং এ কে নুরুল বাহারকে দ্রুত তৈরি হওয়ার নির্দেশ দিই। আরও দুজন লিডার এন এ রফিকুল হোসেন এবং এম এম ইকবাল আলম প্রশিক্ষণের জন্য প্রধান কার্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। তারাও প্রস্তুত থাকলেন।
প্যাট্রোল ডিউটিতে থাকা লিডার সাহেব আলী মিয়া ধানমন্ডিতে শেখ ফজলুল হক মণির বাড়িতে গিয়ে আমাকে জানান, সেনা পোশাক পরিহিত একদল আক্রমণকারী শেখ ফজলুল হক মণির বাড়িতে আক্রমণ করে তাকে ও তার স্ত্রী আরজু মণিকে হত্যা করে সেখান থেকে চলে গেছে। সাহেব আলী আরও জানান, তিনি শুনেছেন, বঙ্গবন্ধুর বাড়িতেও নাকি হামলা হয়েছে। আমি সাহেব আলীকে দ্রুত বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যেতে বলি, যাতে ওই বাড়িতে কেউ প্রবেশ করতে না পারে।
রক্ষীবাহিনীর পরিচালক নুরুজ্জামান ১২ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রওনা হওয়ার আগে বড় ধরনের কোনো সমস্যা হলে সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছিলেন। আরও বলেছিলেন, জরুরি প্রয়োজনে সফিউল্লাহকে টেলিফোন করতে। তখন কথাটা আমার মনে পড়ে। আমি পরিচালকের লাল টেলিফোনে সেনাপ্রধান সফিউল্লাহকে ফোন করি এবং ঘটনা জানাই। তিনি আমাকে বলেন, বঙ্গবন্ধু তাকেও ফোন করে ফোর্স পাঠাতে বলেছেন। কারণ, সেনা পোশাক পরিহিত কে বা কারা তার বাড়িতে আক্রমণ করেছে। আমি তার কাছে আমরা কী করব জানতে চাই এবং তাকে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে তাড়াতাড়ি ফোর্স পাঠাতে অনুরোধ করি। সফিউল্লাহ আমাকে বললেন, তিনি ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিলকে পাচ্ছেন না। তারপর তিনি ফোন রেখে দিলেন।
এ সময় আমাদের উপপরিচালক (অপারেশন) সরোয়ার হোসেন মোল্লা অফিসে উপস্থিত হন। তার মাধ্যমে জানতে পারি, ঢাকা বিমানবন্দরের দেয়াল ভেঙে কয়েকটি ট্যাংক রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়েছে। আমরা বুঝতে পারি, সেনাবাহিনীর একটা অংশ বিদ্রোহ করেছে এবং তারাই অভ্যুত্থান সংঘটিত করছে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে রক্ষীবাহিনীর সবাইকে প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দিই। সরোয়ার দেশের বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের তৈরি থাকতে বলেন। আমরা যখন এসব করছি তখন লিডার আলিমুজ্জামান জোয়ারদার দৌড়ে এসে জানান, রেডিও থেকে ঘোষণা করা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। বুঝতে পারি, আমাদের সামনে মহাসংকট। দেরি না করে আমি সেনাপ্রধান সফিউল্লাহকে আবার ফোন করি। তিনি আমাকে বললেন, সেনাবাহিনীর উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, সিজিএস ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ এবং ডিজিএফআই-প্রধান আবদুর রউফ তার সঙ্গে আছেন। আরও বললেন, ‘we are going to do something, তোমরা অপেক্ষা কর এবং তৈরি থাক।' সরোয়ার ও আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমরা অ্যাকশনে যাব। সেনাবাহিনী-প্রধান যদি সঙ্গে থাকেন তাহলে ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ নিয়ে আমরা বিদ্রোহীদের দমন করতে পারব। বিমানবাহিনী কী ভাবছে জানার জন্য আমি এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারকে ফোন করি। তিনি জানান, তিনি সেনাপ্রধান সফিউল্লাহর কাছে যাচ্ছেন। আমরা ভাবলাম, তারা একটা পদক্ষেপ নেবেন।
এর মধ্যে টহল ডিউটিতে থাকা লিডার সাহেব আলী বঙ্গবন্ধু ভবন থেকে আমাদের প্রধান কার্যালয়ে ফিরে আসেন। সাহেব আলী সেখানকার যে মর্মস্পর্শী ও রোমহর্ষ চিত্র তুলে ধরলেন, তা বিশ্বাস করা আমাদের জন্য কঠিন ছিল। আরেক টহলদারি দলের লিডার দীপককুমার হালদার প্রধান কার্যালয়ে এসে আমাদের জানালেন, মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতেও আক্রমণ হয়েছে এবং সেখানে অনেকেই হতাহত। এ সময় আমি উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের কী অবস্থা জানতে তাকে ফোন করি। সৈয়দ নজরুল ইসলাম আমার কণ্ঠস্বরের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। ফোন ধরার পর তিনি কোনো কথা বললেন না। আমার মনে হলো, বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর পেয়ে তিনি যেন নির্বাক হয়ে গেছেন। আমি সাহস করে তাকে বললাম, 'স্যার, রাষ্ট্রপতি নিহত, এখন উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে আপনার ওপরই সব দায়িত্ব। আপনি রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে নিয়ে সব বাহিনী-প্রধানকে ফোন করে বিদ্রোহী সেনাদের প্রতিহত করার আদেশ দিন।' উত্তরে তিনি জানান, তার ওখানে কোনো স্টাফ নেই। আমি বললাম, 'আমি তাহলে আপনাকে রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে আসি।' তিনি বললেন, 'আসো'। এরপর আমি প্রধানমন্ত্রী এম মনসুর আলীকে ফোন করে একই কথা বললাম। তার কণ্ঠে একটু দৃঢ়তা ছিল। খুনিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের মনোভাবও ছিল তার মধ্যে। তিনি আমাকে তার বাড়িতে যেতে বললেন।
আমি মনে মনে ভাবলাম, উপ-রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে যখন পেয়েছি, দেরি না করে তাদের কাছে আমার যাওয়া প্রয়োজন। আমি একটি গাড়ি নিয়ে তাদের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলাম। বেরোনোর সময় দেখলাম রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ের সামনে ট্যাংক। জীবনের ভয় না করে আমি ট্যাংকের সামনে দিয়ে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলাম। তখন সময় আনুমানিক সকাল সোয়া ৬টা। ফার্মগেট হয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পেলাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পতাকা উড়িয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের গাড়িতে দুটি পতাকা থাকে। একটি জাতীয় এবং অপরটি তিনি যে অঙ্গরাজ্যের নাগরিক সেই রাজ্যের পতাকা। এটা আমি জানতাম। ওই গাড়িতে দুটি পতাকাই ছিল। দুটি পতাকা দেখেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে একটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টারের গাড়ি। ভিতরে কে ছিল দেখতে পাইনি। আমার মনে খটকা এবং সন্দেহ হলো যে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে হয়তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাত আছে।
সূত্র : আনোয়ার উল আলম রচিত 'রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যা' বই থেকে।