(আজ প্রথমেই একটি ভুল সংশোধন করা দরকার। ক'দিন আগে দিল্লি গিয়েছিলাম। বহুদিন পর প্রখ্যাত সাংবাদিক কলামিস্ট এম জে আকবরের সঙ্গে দেখা। অনেক দিন পর দুজন প্রিয় মানুষ একত্রিত হলে যেমন হয়, আমারও তেমন হয়েছিল। ভালো লাগায়, বুক ভরে যাওয়ায় গত পর্বে এক মারাত্দক ভুল করে ফেলেছি। এম জে আকবর National Spokesman of BJP মানে বিজেপির জাতীয় মুখপাত্রের স্থলে ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদির জাতীয় তথ্য উপদেষ্টা লিখেছিলাম। কিন্তু তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নন, তিনি বিজেপির জাতীয় উপদেষ্টা। এ ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি।)
'৭৫-এর ১৫ আগস্ট ছিল শুক্রবার। ৩৯ বছর পর এবারের ১৫ আগস্টও শুক্রবার। সেদিন আকাশ ভেঙে কান্না ঝরছিল, এবার সকাল থেকে সারা দিন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার ৩৯ বছর পর আগের রাতে গলফ ক্লাবে ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ মিয়া খাজার ছেলে ক্যাপ্টেন আবদুল হামিদ মেহেদীর বিয়েতে গিয়েছিলাম। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, আমার স্ত্রী নাসরীনের জন্মও ১৪ আগস্ট। বিয়ের পর কখনো কোনো দিন ওর জন্মদিন পালন করিনি। তাতে মন খারাপ করে না। কারণ সে জানে আগস্ট আমার হৃদয়ের বোঁটা ছেঁড়া বেদনার মাস। আগস্টে আমি আমাতে থাকি না, কেমন যেন হয়ে যাই। শত চেষ্টা করেও ঠিক থাকতে পারি না। কিন্তু তবু ১৪ আগস্ট খাজার ছেলের বিয়েতে গিয়েছিলাম। না গিয়ে উপায় ছিল না। বগুড়া জেলা যুবলীগের সভাপতি আবদুল খালেক খসরু টাঙ্গাইলের নিশ্চিন্তপুরের চরে খুনিদের বিরুদ্ধে পিতৃ হত্যার প্রতিবাদে প্রতিরোধ যুদ্ধে আমার পাশে প্রথম শহীদ হয়। তখন তার একমাত্র ছেলে আবদুন নাসের মাহমুদ শিরীনের কোলে। শহীদ হওয়ার খবর যখন তার বাড়ি পৌঁছে তখন সবাই দিশাহারা হয়ে যায়। খসরুর বাবা আবদুল মালেক মিয়া অসাধারণ মেধাসম্পন্ন এক সাত্তি্বক শিক্ষক ছিলেন। নিজেকে দিয়ে অন্যকে শিক্ষা দেওয়াই ছিল তার সারা জীবনের কাজ। সন্তানসহ ছেলের বউকে বাড়ি ছাড়তে দেননি। শোক কেটে গেলে এক সময় খসরুর ছোট ভাই ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ খাজাকে বলেন, 'নাতি আর বউকে বাড়ি ছাড়তে দেবো না। তুমি মাকে বিয়ে করে আমার ইচ্ছে পূরণ করো।' পরম পিতৃভক্ত সন্তান বাপের আদেশ মাথা পেতে নেয়। দুনিয়ার সব অস্বস্তি ঝেড়ে ফেলে খাজা এবং শিরীন একে অপরকে বিয়ে করে। এক সময় হয়তো কষ্ট থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু দয়াময় পরম প্রভু আল্লাহর দয়ায় ওরা এখন ভীষণ ভালো। খসরু, খাজা, শাজাহান, মহ্ববত, মনির- ওরা পাঁচ ভাই। ওদের তিন ছেলে। এতদিন ঘরে কোনো মেয়ে ছিল না। কন্যাহীন পরিবারে এই সেদিন মাহমুদ আর নাজিয়ার ঘর আলো করে আরিবা এসেছে। কতখানি বিবেক বিবেচনা, দয়া-মায়া, মানবিক মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্ব থাকলে অমন সোনার সংসার গড়া যায় ক্যাপ্টেন খাজা আর শিরীনের পরিবার তার উজ্জ্বল প্রমাণ। খসরু শিরীনের ছেলে মাহমুদ, খাজা শিরীনের ছেলে মোস্তফা এবং মেহেদী। মাহমুদ অস্ট্রেলিয়া ক্যানবেরায় সাউথ ওয়েলস ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। আবদুল কাদের মোস্তাফা কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। যার বিয়েতে গিয়েছিলাম। মেহেদী বিমানের জুনিয়র পাইলট। তাই রীতি না ভেঙে পারিনি। ঠিক তেমনি রীতি ভেঙেছিলাম ১৫ আগস্ট ৭১ টিভিতে গিয়ে। কে যেন ১৪ তারিখ ফোন করেছিল, শুক্রবার '৭১-এ 'বাংলাদেশ সংযোগ' অনুষ্ঠানে আসুন। অনেক কথা হয়েছিল। যেতে মন সায় দেয়নি, তবু গিয়েছিলাম। মনে করেছিলাম অনুষ্ঠানটি শোক দিবস উপলক্ষে, কিন্তু গিয়ে দেখি সেটি একটি শুক্রবারের নিয়মিত সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান। প্রসঙ্গ ছিল 'গণমানুষের বঙ্গবন্ধু...'। '৭১ টিভিকে অনেকে আওয়ামী লীগের ভাবে। যেমন এক সময় মোসাদ্দেক হোসেন ফালুর এনটিভিকে বিএনপির ভাবত। কিন্তু এখন সেই এনটিভি আওয়ামী লীগের সব থেকে বড় পো ধরা। আমি তাই প্রচার মাধ্যমকে কারও স্থায়ী সমর্থক মনে করি না। এক্ষেত্রে মিরপুরের আবদুল খালেক যথার্থ ব্যক্তি। পাকিস্তানে ছিলেন আইয়ুব খানের, বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর, তার মৃত্যুর পর যোগ দেন বীরউত্তম জিয়াউর রহমানের দলে। দলবদল নিয়ে একদিন বলেছিলেন, কোথায় আমি দলবদল করি? আমি তো সব সময় সরকারি দলে। সরকার বদলে গেলে আমি কী করব? কত বড় সত্য কথা!
ইটিভির এক অনুষ্ঠানে একদিন '৭১-এর প্রাণপুরুষ মোজাম্মেল বাবুর সঙ্গে দেখা। আবদুস সালামের ইটিভি থেকে চলে গিয়ে কী করে ৭১ বানিয়েছে, কুয়োর ব্যাঙ সাগরের খবর রাখিনি। ইটিভি করেছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক সায়মন ডিং। তার কাছ থেকে কীভাবে সালাম নিয়েছেন জানি না। '৯০-এ দেশে ফেরার আগে সালামকে জানতাম না। তার বাবা আবদুল করিম মাস্টারকে জানতাম। তিনি কাদেরিয়া বাহিনীর শাহাজানী ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক কমান্ডার ছিলেন। যুদ্ধের সময় অসম্ভব পরিশ্রম করেছেন। তার নামে একটি স্কুলও আছে। সালাম কীভাবে জার্মান গিয়েছিল এবং কীভাবে তার উত্থান- ওসবের কিছুই জানি না। বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগের মুখপত্র মনে করে ইটিভি বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন ইটিভি খুলে দিতে সংসদে '৭১' বিধিতে নোটিস দিই, কয়েকবার পয়েন্ট অব অর্ডারে আলোচনা করি, ড. কামাল হোসেনকে বলে কয়ে ইটিভির পক্ষে আইনি লড়াই করতে রাজি করি। এসবের জন্য জনাব সালাম বেশ কয়েকবার ধন্যবাদ পত্র পাঠায়। এক পর্যায়ে ইটিভির উপদেষ্টা হয়ে পরামর্শ দিতে সম্মতির জন্য ২০-২৫ পৃষ্ঠার আবেদন করে। কী কারণে কীভাবে রাজি হয়েছিলাম মনে নেই। সব রকমের সুযোগ-সুবিধা সম্মানী প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে চিঠি দেয়। কয়েক মাস বেশ ভালো রকমের সম্মানীও পাঠায়। তারপর আর খবর নেই। তাদের হিসেবেই অনেক সম্মানী বকেয়া পড়ে আছে। পরে আর ওসবের খোঁজ নিতে যাইনি।
সেই ইটিভির বাবু চ্যানেল '৭১-এর কর্ণধার শুনে খুবই খুশি হয়েছি। কিন্তু কোনো দিন কোনো অনুষ্ঠানে যাইনি। ক্ষতবিক্ষত, খণ্ডবিখণ্ড হৃদয় নিয়ে এবার গিয়ে তাদের চরম ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি দেখে মর্মাহত হয়ে ফিরে এসেছিলাম। সমাজের জ্ঞানী-গুণী সুধীদের নিয়ে দীর্ঘ সময় অনুষ্ঠান। তার বেশি সময়ই বিজ্ঞাপন। মানে বাঘের সামনে ছাগল রাখা। অন্যদিন হলে হয়তো অত খারাপ লাগত না। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদিন ছিল বলে বড় বেশি খারাপ লেগেছে। অনুষ্ঠান সাজানো দেখে আরও বিরক্তি লেগেছে। প্রথমেই ছিল গফরগাঁওয়ের রিকশাওয়ালা হাসমত আলী প্রসঙ্গ। যে আপনাকে 'অসহায়' ভেবে একখণ্ড জমি দান করেছে। সে দানের কথা শুনে আপনি তার ঝগড়াঝাটি করা স্ত্রী-সন্তানদের কয়েক লাখ টাকার বাড়ি এবং প্রতি মাসে সরকারি কোষাগার থেকে টাকা পাঠাচ্ছেন। যে সাংবাদিক হাসমতকে আবিষ্কার করেছেন তাকে কিস্তিতে কিস্তিতে টাকা দিয়েছেন- ব্যাপারটা অবশ্যই প্রশংসার। কিন্তু '৭৫-এর ১২ অক্টোবর নিশ্চিন্তপুর চরে প্রতিরোধ যুদ্ধে আবদুল খালেক খসরু যে জীবন দিল তার পরিবার-পরিজনের খবর এক দিনের জন্যও কেউ কি নিয়েছে? চাটুকাররা যে যাই বলুক, পিতার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে এক অভিযানে গিয়ে '৭৬-এর ১৪ আগস্ট মুক্তাগাছার মহিষতারায় আওয়ামী লীগের মকবুল হোসেন চেয়ারম্যান বাড়িতে আশ্রয় নিলে, সে খবর দিয়ে সেনাবাহিনী আনে। যেমনটা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি দালালরা আনত। সারা দিন প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। ফুলবাড়িয়ার মফিজ, নিখিল, মুক্তাগাছার জাবেদ আলী, সুবোধ ধর ও দিপাল দাশ শহীদ হয়। একেবারে মৃতপ্রায় বিশ্বজিৎ নন্দী ধরা পড়ে তিন বছর চিকিৎসার পর সুস্থ হলে বিচারে তার ফাঁসি হয়। ১৪ বছর ফাঁসির সেলে থেকে ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহীয়সী নারী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এবং বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখার্জির ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এরশাদের আমলে মুক্তি পায়। মজার ব্যাপার, আমি দেশে ফিরলে সেই মকবুল চেয়ারম্যান '৯১ সালে মহিষতারায় আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে আমার জন্য এক গণসংবর্ধনার আয়োজন করলে সব শুনে ঘৃণায় সেখান থেকে চলে এসেছিলাম।
'৭১-এর অনুষ্ঠান প্রযোজক মনে হয় অনুষ্ঠানটি সাজিয়েছিলেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ সংগ্রাম কেউ করেনি প্রমাণ করতে। আর ছিটেফোঁটা যা করেছে চট্টগ্রামের জাসদ নেতা গণবাহিনীর মঈনুদ্দিন খান বাদল করেছে- এটাই ছিল অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য বা প্রতিপাদ্য। উপস্থাপিকা নাজনীন মুন্নীর স্বাধীনতার আগে না পরে জন্ম জানি না, তিনি জাসদ-বিএনপি-জামায়াতের কেউ কিনা তাও বলতে পারব না। মঈনুদ্দিন খান বাদলকে চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু হত্যার একমাত্র প্রতিবাদ প্রতিরোধকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে তার লাভ কী তাও জানি না। অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে মঈনুদ্দিন খান বাদল নিজেই বলেছেন, আমার পরিচয় ঠিকভাবে দেওয়া হচ্ছে না। আমি এখন জাসদের কার্যকরী সভাপতি। তখন ছিলাম চট্টগ্রামের গণবাহিনীর প্রধান। আমরা সরকারের বিরুদ্ধে একটা সশস্ত্র আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলাম। উপস্থাপিকা হয়তো বুঝতে পারেননি তারা যে সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন, সে সরকার ছিল বঙ্গবন্ধুর সরকার। তারা বঙ্গবন্ধু সরকারের উৎখাত চেয়েছেন, নেতা-এমপিদের হত্যা করেছেন। সেই বঙ্গবন্ধুর সরকার উৎখাত হলে তারা তার প্রতিবাদ করেন কী করে? তাদের তো খুশি হওয়ার কথা। যদি মঈনুদ্দিন খান বাদলকে '৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদী প্রমাণ করতে হয় তাহলে তো তার আগের অনেক বছরের বক্তৃতা-বিবৃতি ধ্বংসাত্দক কর্মকাণ্ড সব বদলে ফেলতে হবে। জনাবের কেউ যদি নির্যাতিত হয়েও থাকেন সে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে নয়, সেটা হয়েছে জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে যাওয়ার কারণে। আগরতলা আর চকিরতলা এক নয়। তখন খুনি ফারুক, রশিদ, ডালিমের ঘাতকদের চেয়ে বরং জাসদের গণবাহিনীকে আওয়ামী লীগের লোকেরা বেশি ভয় করত। বগুড়ার খসরু সরাসরি খুনিদের বিরুদ্ধে লড়াই করে জীবন দিয়ে প্রতিবাদী হলো না, চট্টগ্রামেরই মৌলভী সৈয়দ হলো না, প্রতিরোধী হলো হত্যাকারীরা- ভাবতেই যেন কেমন খারাপ লাগে। চট্টগ্রামে একমাত্র মঈনুদ্দিন খান বাদল বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করলে যুবলীগ নেতা মৌলভী সৈয়দ যে আমার সঙ্গে প্রত্যক্ষ প্রতিবাদ করে জীবন দিয়েছে তার কী হবে? মেয়র মহিউদ্দিনের কী হবে, কী হবে যুবলীগ নেতা এস এম ইউসুফ, এনামুল হক দানুসহ অন্যদের? এমন ইতিহাস বিকৃতি আগে কখনো দেখিনি বা শুনিনি। এসব রোধের জন্য করজোড় ক্ষমা প্রার্থনা চাইছি, আমাদের দুর্ভাগাদের ক্ষমা করে এসব ইতিহাস বিকৃতি বন্ধ করার চেষ্টা করুন। তাতে শহীদের আত্দা কিছুটা খুশি হবে, শান্তি পাবে। ইতিহাস বিকৃত করে আমাদের মুছে ফেলে আমার তো মনে হয় আপনার লাভের চেয়ে ক্ষতিই বরং বেশি। ঘাতকরা আপনার ছায়ায় পার পেয়ে গেলে সে দোষ ইতিহাস তো আপনাকেও দেবে। আপনি বাজে লোকদের দোষের বোঝা নিজের ঘাড়ে নেবেন কেন? তাই করজোড় অনুরোধ, '৭১ টিভির ১৫ আগস্টের নাজনীন মুন্নী উপস্থাপিত 'বাংলাদেশ সংযোগের' শেষ অংশটা একটু দেখুন। সত্যিই কি মঈনুদ্দিন খান বাদল ওই সময় বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে পারে? যারা বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উৎখাত করতে জীবন বাজি রেখেছিল, তাদের যদি আজ প্রতিবাদ বা প্রতিরোধকারী বলে স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টা করা হয় সেটা কি জঘন্য অন্যায় হবে না? বয়স হয়ে গেছে কবে চলে যাব জানি না। দুনিয়াদারির লাভালাভের ভাবনা এখন খুব একটা করি না। শুধু আমার প্রতি বিদ্বেষের কারণে প্রকৃত ত্যাগীরা বঞ্চিত হবে এটা কেমন কথা? আমাকে বাগে রাখতে হত্যাকারী বা হত্যার সহযোগীরা আশকারা পাবে কেন? বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সহকর্মী যারা মন্ত্রী হয়েছিলেন তাদের আমরা কত ঘৃণা করেছি, ব্যর্থতার জন্য তারা কত লানতের জীবনযাপন করেছেন, কিন্তু অরাজনৈতিক বা সরকারি কর্মচারীরা কি তা করেছে? বরং নানা কৌশলে আপনার ছায়া পেয়ে অনেকে সে যে কী বাহাদুরী করছে যা বলার মতো নয়।
জনাব এইচ টি ইমাম মুক্তিযুদ্ধে ক্যাবিনেট সেক্রেটারি ছিলেন, খন্দকার মোশতাকেরও ছিলেন। রাজনীতিকরা মন্ত্রী হয়ে যদি অপরাধ করে থাকে, মোশতাকের পায়ে চুমু খেয়ে শপথের আয়োজন করে জনাব এইচ টি ইমাম কি কোনো অপরাধ করেনি? ভদ্রলোকরা ইনিয়ে-বিনিয়ে আপনার কাছে যা বলে তার ১৪-১৫ আনাই মিথ্যা। জনাব সফিউল্লাহ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাকে মাথায় রাখি, বীরউত্তম হিসেবে তিনি আমার মাথার তাজ হতে পারেন, কিন্তু সেনাপ্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতিকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য শাস্তি কামনা কি আমার অপরাধ? জনাব এ কে খন্দকার হানাদারদের অস্ত্র সমর্পণের দিন মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে কলকাতা থেকে হাওয়ায় ভেসে এসেছিলেন। সে জন্য তাকে হৃদয়ের সিংহাসনে মহারাজার আসন দিতে আমি প্রস্তুত। কিন্তু বিমান বাহিনীর প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ প্রতিরোধ না করে পাগলের মতো ছুটে গিয়ে খুনিদের সমর্থন করা- কী করে সমর্থন করি? তার বিচার চাওয়া কি অপরাধ? সেদিন কয়েকটি চ্যানেলে রক্ষীবাহিনীর নেতা জনাব শহীদের সাক্ষাৎকার দেখলাম। কেউ কেউ তাকে বঙ্গবন্ধুর অতি বিশ্বস্ত বলে উল্লেখ করল। অস্ত্র জমা দেওয়া অনুষ্ঠানের দু-একটা ছবিও দেখাল, তাতে কৌশলে আমার ছবি কেটে দেওয়া হয়েছে- তাতে কি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হবে? কাদেরিয়া বাহিনী কি শহীদ বাহিনী হয়ে যাবে? তাহলেও আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমার ঘোরতর আপত্তি বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর এক মুহূর্ত দেরি না করে বেতারে গিয়ে খুনিদের অকুণ্ঠ সমর্থন জানানোও কি মেনে নিতে হবে? আপনি এখন হয়তো আমায় বিশ্বাস করেন না, আমি হয়তো আস্থায় নেই। তাই আমার কথা ছেড়ে দিন।
আপনি তো এখন প্রধানমন্ত্রী, ইচ্ছা করলেই সেই ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে খুনিরা সেদিন বেতারে যা যা বলেছে, যা যা করেছে সব কিছুর ওপর চোখ বুলাতে পারেন। ঠিক আছে, আমি কিছুই করিনি। কিন্তু এরা যারা করেছে তারা পক্ষে না বিপক্ষে করেছে এটুকু তো যাচাই-বাছাই করে নেবেন। মানলাম পিতার চামড়া ছোলা ডুগডুগি বাজানো বেগম মতিয়া চৌধুরীকে আপনার এখন খুবই দরকার। সঙ্গে রাখতে চান রাখুন। কিন্তু তিনি পিতাকে সম্মান করতেন, নাকি ঘৃণা করতেন, সেটা দেখেশুনে বুঝে নিয়ে রাখুন। আপনি প্রধানমন্ত্রী, আপনার মন্ত্রিসভায় কাকে রাখবেন কাকে রাখবেন না অনেকটাই আপনার ব্যাপার। তবে দেশের মালিক জনগণ, তাদের সরাসরি ইচ্ছার বিরুদ্ধে আপনি কিছু করবেন না, এটা তারা প্রত্যাশা করে। আপনার মন্ত্রিসভায় শাজাহান খান ভারী মন্ত্রী, লঞ্চ ডুবলে তুলতে পারেন না। অনেক টাকা খরচ করে অনেক যন্ত্রপাতি এনেছেন যা নাকি ২০-৫০ মিটার মাটির নিচেও দেখে। কিন্তু কদিন আগে মাওয়ায় পিনাক-৬ ডুবলে ঘোলা পানিতে দেখতে পায় না। '৭৪-'৭৫-এ একবার রিলিফ দিতে গিয়ে কালিহাতীর ফটিকজানী নদীতে আমার স্পিডবোটের ইঞ্জিন পড়ে গিয়েছিল। পরদিন তুলতে গেলে ভিড় করা হাজার মানুষ কত টিটকারি করেছিল- এটা মুক্তিযুদ্ধ নয়, হানাদারদের গুলি করে মারা নয়, পানিতে কোনো কিছু পড়লে সেখান থেকে তোলা অত কেরদানির কাজ নয়। যদিও কেউ সামনে বলেনি, দূর থেকে বলেছে। কয়েক ঘণ্টা পরিশ্রম করে বীরবিক্রম সবুর খানের নেতৃত্বে ৪০-৫০ জন খ্যাতিমান যোদ্ধা যখন ইঞ্জিনটি তুলে আনে তখন টিটকারি দেওয়া লোকজনই বলেছিল, আরে কাদের সিদ্দিকীর লোকজন অত বড় একটা যন্ত্র নদী থেকে তুলতে পারবে না! সমুদ্রে সুই ফেলে দিলে কাদের সিদ্দিকীর হুকুমে তারা তাও তুলে আনতে পারবে। এখন আপনিই বিচার করুন, গণবাহিনীর নেতা ২৮৬ জন আওয়ামী লীগার হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত শাজাহান খান পদ্মায় ডুবে যাওয়া অত বড় লঞ্চের খোঁজ করতে পারেননি। এদের জন্য আমাদের ক্ষমা না করে আপনার কী লাভ? ইউটিউব দেখুন, রক্ত গরম থাকার সময় হাসানুল হক ইনু বলেছিল, ‘Sheikh Mujibur Rahaman could not deal with the political movement in the democratic way. He fail cheatering about the whole situation. He was not also controlling the public. He could not face the criticism of opposition.’হাসানুল হক ইনু ছাড়া কি আর কোনো ভালো মানুষ নেই? তিনি তো গণবাহিনীর উপপ্রধান ছিলেন। ৭ নভেম্বর সিপাহি জনতার বিপ্লবে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে ট্যাঙ্কের ওপর নাচানাচি করেছেন। বেসুমার কাগজপত্র পড়ে আছে, চাইলেই দিতে পারি। জুতা হাতে ট্যাঙ্কের ওপর তার ছবির সাক্ষী হিসেবে সাভারের গিয়াসসহ এখনো চার-পাঁচজন বেঁচে আছে। গিয়াস উদ্দিন তখন তেজগাঁও পলিটেকনিকের ভিপি ছিল। সামরিক আদালতের ফাঁসির আদেশ মাথায় নিয়েও সে জাতির পিতার হত্যার প্রতিবাদ করেছিল। তা তো আপনি ভালো করেই জানেন। মুক্তিযুদ্ধের আর এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব স্বাধীনতা-উত্তর গণবাহিনীর প্রধান কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তম তখন নারায়ণগঞ্জে থাকতেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর শুনে বিরক্ত হয়ে তার নাম পর্যন্ত উচ্চারণ না করে বলেছিলেন, 'ওকে কবর দিল কেন? ওর লাশ সমুদ্রে ফেলে দেওয়া উচিত ছিল।' এটা আমার কথা নয়, ৬-৭ দিন আগে মানবজমিনের প্রথম পাতায় ব্যানার হেডিংয়ে বের হয়েছে। তারপরও তাহের পরিবার আপনার স্নেহের ছায়ায় নিরাপদ, আমার পরিবার কড়কড়ে নির্যাতনের ঝাঁজে পুড়ে ছারখার। এটা তো বিচার হতে পারে না। আপনার দ্বারা তো এমন অন্যায় হওয়ার কথা নয়। আপনি তো জাতির পিতার কন্যা। সেখানে আমি এবং আমার পরিবার নিরাপদ বা হেফাজতে থাকব না কেন? সংসদে শোক প্রস্তাবে নাসিমকে কী অসাধারণ স্বীকৃতি দিলেন, বিয়ানীবাজারের জলিল, আবদুর রহমান মাস্টার, সুলতান, নড়াইলের জিন্নাহ, অধ্যাপক আবু সাঈদ, রউফ সিকদার, মোবারক হোসেন সেলিম, নওশের আলী নসু, দীপংকর তালুকদার রাজা, মহিউদ্দিন চৌধুরী, চট্টগ্রামের এস এম ইউসুফ, আপনার গোপালগঞ্জের বিজন কুমার সাহা- এরা তো অনেকেই নাসিমের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিল। আমাকে না হয় কতল করলেন, করুন। তারা কী করেছে? তাদের সম্মান কোথায়? তারা জীবিত বলে তাদের না হয় মর্যাদা নেই। খসরু, মৌলভী সৈয়দ, গাইবান্ধার আলম, কাপাসিয়ার খালেদ খুররম, বিশেষ করে দুলাল দে বিপ্লব জামালপুরের ব্রহ্মপুত্র নদে খুনিদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে আহত হয়ে ধরা পড়ার আগে নিজের অস্ত্র মাথায় ঠেকিয়ে গুলি করে শহীদ হয়। '৭১ সেদিন তাদের কথা মনে করেনি। নন্দী, সাঈদ, বদি, আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী, গৌরাঙ্গ, বাবুল, যুগল- দীর্ঘদিন জেল খেটেছে, তাদের কথাও স্মরণ করেনি। তাই খুবই মর্মাহত হয়ে বাড়ি ফিরে বিকাল ৪.০৫ মিনিটে বুকের ধন আকাশ-বাতাস থেকে পাওয়া কুশিমণির হাত ধরে, ওর মা নাসরীনের সঙ্গে ৩২-এ গিয়েছিলাম। কয়েক মাস আগে লন্ডন থেকে টেলিফোনে রেহানা বলেছিল, ৩২-এর বাড়ি কি শুধু আমাদের? বঙ্গবন্ধু তো আপনারও বাপ। কাউকে পরোয়া করবেন না। ও বাড়িতে আমাদের যে অধিকার, আপনার তার চেয়ে বেশি অধিকার। মন চাইলেই যাবেন। বোনের কথায় সেদিন বুকভরে গিয়েছিল। তাই গিয়েছিলাম। কিন্তু স্বাভাবিক থাকতে পারিনি। উথাল-পাতাল বুকভরা কান্না চোখ বেয়ে বেরিয়ে এসেছিল। সিঁড়ির পাশে কে যেন দরুদ পড়ছিল। অঝর কান্না নিয়ে শিশুকন্যার হাত ধরে নীরবে দাঁড়িয়ে ছিলাম। রিসিপশন ঘরে গিয়েছিলাম। যে ঘর থেকে দোতলায় গিয়ে রাত ১টার পর পিতার সঙ্গে শেষ দেখা, শেষ কথা বলেছিলাম। যে ঘরে কয়েক ঘণ্টা পরই কামাল জীবন দিয়েছে। বেরিয়ে টিভি ক্যামেরাকে কিছু বলতে পারিনি। চোখে পানি থাকলেও মুখে কোনো কথা ছিল না। পাথর চাপা বুকে পিতার বাড়ি কিছু বলতে যাইনি, গিয়েছিলাম ভারী বুক হালকা করতে। হালকা তো হয়ইনি আরও ভারী বুকে অভাগা পুত্রকে পিতার দেওয়া বাবর রোডের অবৈধ বাড়িতে ফিরতে হয়েছে।
লেখক : রাজনীতিক।