বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন লক্ষ্যহীন অভিযাত্রায় বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক হুইপ, বিএনপির সাবেক যুগ্ম-মহাসচিব আশরাফ হোসেন। তিনি বলেন, এখন প্রধান দলগুলোর লক্ষ্যই হচ্ছে যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকা বা যাওয়া। দেশ নয়, ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতা। প্রকৃতপক্ষে জনগণের কথা কেউ ভাবে না। সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে। জনগণই ক্ষমতার উৎস- এ মূলমন্ত্র এখন আর নেই। কিছু সুবিধাভোগীই এখন ক্ষমতার উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তারাই এখন দেশ ও জনগণের মালিক বনে গেছেন। এভাবে একটি রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় তিনি এসব কথা বলেন। রাজধানীর নিকুঞ্জে অনেকটা অবসর জীবনযাপন করছেন ৭৩ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদ। বই পড়ে লেখালেখি করে সময় কাটছে তার। আশরাফ হোসেনের মতে, রাজনীতি এখন কলুষিত। রাজনীতিবিদদের হাতে রাজনীতি নেই। আর দেশের মানুষ ডাকাত দলের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, দেশে এখন আইনের শাসন নেই। চলছে লুটপাটতন্ত্রের রাজনীতি। সাধারণ কোনো মানুষ আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটালে তাকে জেলে থেকে মরতে হচ্ছে। কিন্তু কোনো লেজুড়ভিত্তিক রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী হলে তার সাত খুন মাফ। ফাঁসির আসামিকে পর্যন্ত বেকসুর খালাস দেওয়া হচ্ছে। এটা আইনের শাসনের পরিপন্থী। দেশের প্রতি কারো কোনো ভালোবাসা নেই। আশরাফ হোসেন বলেন, আজ যারা দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করছেন তাদের কিছুই হয় না। তাদের পক্ষে সরকার ও রাষ্ট্র। আর যারা দেশের বাইরে মাথার ঘাম ঝরিয়ে কিছু টাকা বা অন্য কোনো সামগ্রী নিয়ে বাংলাদেশে আসছেন, তাদের বিমানবন্দরে আটকে দিয়ে জেলে পুরে দেওয়া হচ্ছে। দু-একটি ডলার আনলেই তারা হয়ে যান মহাঅপরাধী!
প্রবীণ এই রাজনীতিবিদের মতে, গণতন্ত্র আজ পরিবারতন্ত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ, যা রাজতন্ত্রের চেয়েও খারাপ। কারণ, রাজতন্ত্রে রাজা-রানির ক্ষমতা খুব একটা বেশি থাকে না। কিন্তু পরিবারতন্ত্রে রাজা-রানিই সব ক্ষমতার উৎস। আজ পরিবারতন্ত্রের বাইরে গিয়ে বড় নেতা হওয়ার সুযোগ নেই। স্বামী মারা গেলে স্ত্রী, বাবা মারা গেলে মেয়ে বা ছেলে, কিংবা পরিবারের অন্য কেউই হবেন দল বা সরকার প্রধান। এটা গণতন্ত্রের জন্য কোনো শুভলক্ষণ নয়। এ অবস্থার উত্তরণে গণতান্ত্রিক পন্থায় দল ও দেশ পরিচালনা করতে হবে। আমরাও রাজনীতি করতে চাই। কিন্তু বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণ না হলে কীভাবে রাজনীতি করব? সৎভাবে রাজনীতি করারও কোনো সুযোগ নেই। করতে হবে লেজুড়ভিত্তিক। নইলে পরিবারতন্ত্রকে খুশি করা যাবে না। এসবের পরিবর্তন না হলে দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন কখনো প্রতিষ্ঠিত হবে না। বর্তমানে শ্রমিকদের প্রতি সরকার ও মালিকদের আচরণে দুঃখ প্রকাশ করে সাবেক এই শ্রমিকনেতা বলেন, শ্রমিক আন্দোলনকে ধ্বংস করে দিচ্ছে সরকার ও মালিকরা। সরকারের অনেক মন্ত্রী, এমপি, নেতা বা ঘনিষ্ঠজনই শিল্প কারখানার মালিক। স্বাভাবিকভাবে শ্রমিকদের কোনো ন্যায্য দাবি থাকলে সরকার তা আদায় করে দিতে মালিকদের বাধ্য করে। কিন্তু সরকার মালিকদের স্বার্থ রক্ষায় সব সময়ই মরিয়া হয়ে থাকে। আবার কিছু কিছু শ্রমিকনেতাও বিদেশি টাকায় সরকার ও মালিকদের পক্ষে দালালি করছেন। বর্তমানে 'ভাড়াটে' রাজনীতি চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, ভাড়াটে রাজনীতিবিদদের জীবনযাত্রার মান দেখলেই সবকিছু বোঝা যায়। তারা কত টাকা মাসে ব্যয় করেন, তাদের চলন-বলন কীভাবে হয়, তাদের আয়ের উৎস কী- তা কম-বেশি সবাই জানেন। আমাদের এই রাজনীতিবিদরা এখন যেভাবে জীবনযাপন করেন, ব্রিটেনের রানিও সেভাবে জীবনযাপন করেন না। বিদেশি স্বার্থরক্ষার রাজনীতিও দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি বলেও মনে করেন আশরাফ হোসেন।
তিনি বলেন, দেশে এখন সামাজিক নিরাপত্তা নেই। রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি স্তরে ঘুষ আর দুর্নীতি। দলীয়করণে ছেয়ে গেছে পুরো দেশ। তা ছাড়া জাতিসত্তা বিকাশেও আমরা বিভক্ত। এগুলো থেকে উত্তরণ ঘটাতে আমাদের সবাইকে এক প্লাটফরমে আসতে হবে। দেশের উন্নয়নে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। বিএনপির 'কথিত সংস্কারপন্থি' এই নেতার রাজনৈতিক জীবন শুরু শ্রমিক নেতৃত্ব দিয়ে। '৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে তৎকালীন মজদুর ফেডারেশনের পূর্ব পাকিস্তানের যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। এর আগে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্র সংসদে দুবার সম্পাদক নির্বাচিত হন। '৬৩ সালে খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলস শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সম্পাদক নির্বাচিত হন। '৭১-এর ২৯ মার্চ যশোরে জেল ভেঙে ভারতের আগরতলায় যান এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে কাজ করেন তিনি। '৭৮ সালে বিএনপিতে যোগ দেন আশরাফ হোসেন। এরপর চারবার সংসদ নির্বাচনে বিএনপির পক্ষে খুলনা-২ আসনে বিজয়ী হন। এর মধ্যে উপমন্ত্রী মর্যাদার ডিডিসি ও হুইপের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সংস্কারের কথা বলায় দল তাকে বহিষ্কার করে।