ঈদের আগে থেকে বেগম জিয়া বলে আসছেন, ঈদের পরে তিনি আন্দোলনের কর্মসূচি দেবেন। ইফতার পার্টিসহ প্রায় প্রতিদিনের বক্তব্যে তিনি বলতেন এসব কথা। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনী প্রহসনের পর নিস্তরঙ্গ পুকুরে খানিকটা ঢেউ উঠেছিল। রংপুরের এক জনসভায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের পক্ষ থেকে হরতাল অবরোধের পক্ষে স্লোগান উঠেছিল। বেগম জিয়া বলেছিলেন, হবে সেসবও হবে। অনেকের মনে হয়েছিল, ঈদের পরে আবার বোধহয় নতুন করে শুরু হবে। প্রকৃতপক্ষে ৫ জানুয়ারির আগের আন্দোলন বিশেষ করে ২৯ ডিসেম্বরের 'গণতন্ত্র অভিযাত্রা'র সীমাহীন ব্যর্থতার পর দেশের মানুষের আস্থা হারিয়েছিল বিএনপি। এত কথা বলল, কিন্তু কিছুই তো করতে পারল না। আসলে ৫ জানুয়ারির পর বাংলাদেশের রাজনীতির চালচিত্র ও চরিত্র দুটোই বদলে গিয়েছিল। আমি এরকম করে বলি, ৫ জানুয়ারির পর থেকে এই সরকার ও সরকারি দল অনির্বাচিত, বিতর্কিত, দেশে-বিদেশে সমালোচিত আর বিরোধী দল পরাজিত, বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত। সারা দেশের চিত্রটা কিন্তু অন্যরকম ছিল। '৬৯-এও আন্দোলনের যতটা বিস্তার ছিল না, এবার রাজধানী ঢাকা বাদে এ আন্দোলনের বিস্তার ছিল তারও বেশি। কিন্তু সারা বাংলাদেশের ক্ষমতা যেখানে কেন্দ্রীভূত, সেখানকার পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশের পট বদলে যায় সেই রাজধানী ঢাকায় আন্দোলনের বিস্তার ছিল শূন্য। ২৯ ডিসেম্বর গণতন্ত্র অভিযাত্রার দিন এক মালিবাগের কাছে ছাত্রশিবির মিছিল বের করেছিল যেখানে পুলিশ গুলি চালালে শিবিরের এক নেতা নিহত হয়। এ ছাড়া ঢাকা শহরের আর কোথাও কিছু হয়নি। শুনেছি বাইরের জেলাগুলো থেকে কয়েক হাজার নেতা-কর্মী ঢাকায় এসেছিলেন। তারা অসহায় দিনটি পার করেছেন। দলের পক্ষ থেকে কেউ তাদের সঙ্গে যোগাযোগও করেনি। কয়েকটি বালুর ট্রাক দলের চেয়ারপারসন বেগম জিয়াকে ঘিরে রেখেছিল। কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে যেতে পর্যন্ত সাহস পায়নি। নির্দিষ্ট সময়ে দলের নয়াপল্টনের কার্যালয়ে কর্মসূচির অনেক পরে হাতে একটি ফ্ল্যাগ এবং কাজের বুয়া নিয়ে তিনি নিচে নেমেছিলেন, গাড়িতে উঠেছিলেন কিন্তু বেরুতে পারেননি। ব্যস, পুরো গণতন্ত্র অভিযাত্রা ওই পর্যন্তই।
লন্ডনে অবস্থানরত বিরোধীদলীয় নেতার পুত্র, বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান খুব রুষ্ট হয়েছিলেন। যদিও দলে আরও অনেক প্রবীণ ভাইস চেয়ারম্যান আছেন, স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্যরা আছেন, তারপরও উত্তরাধিকারের কারণে তিনিই তো সিনিয়র মোস্ট। রুষ্ট হওয়ার অধিকার তো তার আছেই। ঢাকা মহানগরে বিএনপির এই নিদারুণ ব্যর্থতার কারণ কী? এ ব্যাপারে বিএনপি দল হিসেবে কিংবা দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে তারেক রহমানের কোনো মূল্যায়ন আছে কি? আমি জানি না। বিএনপি নেতাদের কাউকে কাউকে বলতে শুনি, কীভাবে কিছু করা সম্ভব। দেখামাত্র গুলির নির্দেশ ছিল তো। হয়তো তাই। মালিবাগে তো প্রায় সেরকম ঘটনাই ঘটেছিল। কিন্তু এই যুক্তি যদি মেনে নিই তাহলে এটাও মানতে হবে, যতদিন পর্যন্ত এরকম নির্দেশ থাকবে ততদিন পর্যন্ত বিএনপি আর কোনো আন্দোলন করতে পারবে না।
অথচ আমাদের দেশে '৬৯-এ যে অভ্যুত্থান হয়েছিল, স্বাধীনতার পক্ষে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তা দমন করার জন্য কতবার ১৪৪ ধারা, এমনকি কারফিউ পর্যন্ত জারি করা হয়েছিল, মিসরের তেহরির স্কোয়ারে পাখির মতো লোককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। পৃথিবীর দেশে দেশে যেখানে বৃহৎ সব গণআন্দোলন হয়েছে সেখানে সরকার পক্ষ কখনোই হাত গুটিয়ে বসে ছিল না। গণঅভ্যুত্থান সব সরকারি প্রতিরোধ চূর্ণ করেই এগিয়ে যায় বিজয়ের পথে। ব্যাপারটা খুব সহজ তা বলছি না। এতগুলো বছর গণতন্ত্রের লড়াই করার পর সরকারের আচরণ এমন হবে কেন যা নূ্যনতম প্রতিবাদ, প্রতিরোধও সহ্য করে না। কিন্তু এটাই তো এখনকার বাস্তবতা। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, কিংবা এরশাদ, তখন তারাও তাই করেছিল, এরশাদ তো ছাত্রদের মিছিলের ওপর ট্রাকই তুলে দিয়েছিল, সেই ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা গিয়েছিল সেলিম, দেলোয়ার। তারপরও ভয় পায়নি আন্দোলনকারীরা। আন্দোলনের কাফেলা সামনে এগিয়ে গিয়েছিল। হ্যাঁ, বাংলাদেশে বিশেষত আওয়ামী লীগের সময় নির্লজ্জতা বেড়েছে। আমি, যে কোনো রাজনৈতিক, বিশ্লেষক, কলাম লেখক যখন এভাবে কথা বলে তখন সেটা যৌক্তিক। কিন্তু সরকার নিজেই যদি সেরকম বলে তাহলে সেটা কেমন? তারাই মারবে আবার তারাই বলবে এরকমই হয়। কি নির্লজ্জ আস্ফালন! ক্ষমতার দম্ভ! আর যাই হোক এই সরকারকে অথবা এই সরকারি দলকে এই আচরণের জন্য গণতান্ত্রিক বলা যায় না।
বিএনপি এ পরিস্থিতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করে? যত দোষ, নন্দ ঘোষ বিএনপি মহানগর কমিটির? এই মহানগরেই তো বিএনপির একপাল কেন্দ্রীয় নেতা অবস্থান করেন। তারা কী করেছেন? নাকি সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতাদের মহানগরীর ওপর কোনো প্রভাবই নেই? নাকি কেন্দ্রীয় নেতা বলে মহানগরের ব্যাপারে মাথা ঘামান না তারা? দলের চেয়ারপারসন কি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত? তিনি কি পরিস্থিতি আগে থাকতে অাঁচই করতে পারেননি? সংগঠনের চেয়ারপারসন কি কোনো সুপার পার্সোনালিটি? তৃণমূল বা মাটির সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগই থাকবে না? আমরা ঢাকা মহানগর বিএনপির কমিটিকে ভেঙে দিতে দেখলাম এবং তার জায়গায় নতুন কমিটি ঘোষণা করলেন বেগম খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়া নিজে এটা করলেন কেন? আমরা দেখেছি ছাত্রদলের কমিটিও তিনি এভাবে ঘোষণা করেন। এই কমিটি যদি ঠিকমতো কাজ না করে, যে আন্দোলন তারা গড়ে তুলতে চাইছেন তা করতে না পারে তবে তার দায়িত্ব কি দলের সুপ্রিম নেতা বেগম জিয়ার ওপর বর্তায় না? আমরা তো সবাই দেখলাম মহানগরের আহ্বায়কের দায়িত্ব যাকে দেওয়া হয়েছে তিনি এই কমিটিতে খুশি নন এবং তিনি সেটা গোপনও রাখেননি। সদস্য সচিবকে যে তার অপছন্দ সেটা তিনি প্রকাশ্যেই দেখিয়ে দিলেন। এতে করে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি তার অনাস্থাও প্রকাশ হয়ে গেল। এই কমিটি মহানগরে একটি সফল, সাহসী আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে?
আমি বিএনপির বন্ধু-সমর্থকদের নিরাশ করছি না। একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে উঠুক তা আমি চাই। এখানে গণতন্ত্র বলতে আমি কি বুঝি, গণতান্ত্রিক আন্দোলন বলতে কি বোঝায় সেটা নিয়ে কথা বলার অবকাশ আছে। পরিধিতে কুলালে তা আমি খানিকটা বলবও। কিন্তু আমরা দেখেছি আন্দোলন সংগঠন নিয়ে মাতা-পুত্রের ভিন্নমত। বোধ হয় এ জন্যই মা গিয়েছিলেন সৌদি আরবে। পুত্রও এসেছিলেন সেখানে। কি কথা বলেছেন তারা, কতখানি দৃষ্টিভঙ্গিগত ঐক্য হয়েছে সে রিপোর্ট আমি পাইনি। এখন কর্মসূচি দেখিছি এবং ধরে নিচ্ছি এ ধরনের কর্মসূচিতে বিএনপি ভাইস চেয়ারম্যানের আপত্তি নেই। মির্জা ফখরুল তো আর নিজে নিজে কোনো কর্মসূচি দেননি। ১২ আগস্ট মির্জা ফখরুল যে কর্মসূচি দিয়েছেন তার শিরোনাম পত্রিকাটি করেছে এভাবে 'বিএনপি জোটের আন্দোলন কর্মসূচি : নির্বাচনের কথা নেই' ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনের পর প্রথমবারের মতো এই জোটের ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচিতে ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে ১৬ আগস্ট কালো পতাকা মিছিল এবং জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার প্রতিবাদে ১৯ আগস্ট ঢাকাসহ সারা দেশে সমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা করেন তিনি। এ ছাড়া ২১ থেকে ৩১ আগস্ট জেলা ও মহানগরে গণসংযোগ করবেন জোটের নেতারা। এর আগে রমজান মাসে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ঈদের পরই সরকার পতনের দাবিতে আন্দোলনের শুরুর কথা বলেছিলেন। এ ব্যাপারে সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হলে মির্জা ফখরুল বলেন, তাদের এসব কর্মসূচি মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে চলমান আন্দোলনেরই অংশ।
সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে এরকম প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। বিএনপির সমর্থকদের মধ্যেও এ প্রশ্ন উঠবে। কারণ বেগম জিয়া তো ওই ভাষায় কথা বলেছিলেন। আন্দোলনের প্রশ্নে বিএনপির ওপর এমনিতেই মানুষের আর সেরকম আস্থা নেই। সে ক্ষেত্রে বিএনপির আরও সতর্ক হওয়া দরকার। নিজেদের ওপর তারা কতখানি আস্থাশীল হতে পেরেছে সেটা এ কর্মসূচিতে বোঝা গেছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে, বিএনপি এখন আকাশ ছেড়ে মাটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এটা আমি বলছি তার সংগঠনের আত্দমুখী শক্তির প্রশ্নে। আন্দোলন করবে যে জনগণ, সেই জনগণের জন্য তাদের বার্তাটি পরিষ্কার নয়।
দেশের অবস্থা এখন নিশ্চিতভাবেই ভয়াবহ। বর্তমান সরকার নিন্দিত ও জনবিচ্ছিন্ন এটা অস্বীকার করা যায় না। এই সরকার কতটা জনবিচ্ছিন্ন সেটা প্রমাণে ঘটনার অভাব নেই। র্যাব-পুলিশ ও আমলাদের ওপর নির্ভর করে দেশ চালাতে গিয়ে সর্বত্র নির্যাতন, অপহরণ, গুম-খুনের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে। ভোট ছাড়া ঘোষিত এমপিদের দাপটে এখন সবার দিশাহারা অবস্থা। তাদের অবৈধ কাজের বিরোধিতা করলেই হামলা-মামলা, গুম-খুনের শিকার হতে হচ্ছে মানুষকে। দেশজুড়ে দুর্নীতি-লুটপাট-দুর্বৃত্তায়ন এমন হয়ে উঠেছে যা বলার অপেক্ষা রাখে না। ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটের মতোই হত্যা-গুমের একটি ঘটনারও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত ও বিচারে অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। প্রতিবাদ দূরে থাক সমালোচনা সহ্য না করে যেভাবে ফ্যাসিস্ট কায়দায় দমন-পীড়ন চালানো হচ্ছে, তার নজিরও খুঁজে পাওয়া ভার। জনগণের আন্দোলনের মতো উৎপাদন ও উন্নয়নের সুফলকেও আমরা আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির কাজে লাগাতে পারিনি। ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে সমাজে বৈষম্য বেড়েছে, অসঙ্গতি বেড়েছে। দুর্নীতি লাগামছাড়া হয়ে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রের লক্ষ্য হারিয়ে গেছে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশের জনগণের জন্য যে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে, তা থেকে দেশকে দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। সংবিধানে সব ক্ষমতার মালিক জনগণ বলা হলেও কার্যত পাঁচ বছর পর পর ভোট দেওয়ার অধিকার ছাড়া জনগণ সবকিছু থেকেই বঞ্চিত। এখন সেই ভোটের অধিকারটুকুও হারিয়ে জনগণের অসহায়ত্ব সাদা চোখেই ধরা পড়েছে। এমন অবস্থায় শুধু সরকার পরিবর্তন বা নির্বাচনের কথা মানুষের মনকে নাড়া না দিলে কাউকে দোষ দেওয়া যাবে না। রাজনীতিকে শুধু ক্ষমতার পালাবদলের হাতিয়ার করে পুরোপুরি জনবিচ্ছিন্ন করা হয়েছে, দুর্বৃত্তায়িত করা হয়েছে। অথচ আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির বাধা দূর করে রাজনীতিই পারে সমাজের এগিয়ে চলার পথ দেখাতে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের এই ভূমিকাই পারে মানুষকে ভাগ্য পরিবর্তনে সাহসী করে তুলতে।
লেখক : রাজনীতিক, আহ্বায়ক নাগরিক ঐক্য।
ই-মেইল : [email protected]