ভারতের স্বাধীনতা বা হিন্দু ও মুসলিমদের ধর্মনির্ভর দেশান্তরের বিষয়টি চলে আসছে ৫৭ বছর ধরে। আমার শিয়ালকোট শহরে ১৪ আগস্ট বাসা ছাড়ার স্মৃতি উঁকি দিচ্ছে মনে। কারণ পাকিস্তানের নতুন অঙ্গরাজ্য অমুসলিমদের আতিথ্য প্রদর্শন করেনি। ঠিক পূর্ব পাঞ্জাব যেমন মোটেই চায়নি সেখানে কোনো মুসলিম থাকুক। আমি শুনেছি পাকিস্তানে জওয়াহেরলাল নেহরুর বিখ্যাত 'সাংকেতিক' উক্তি, কারণ শিয়ালকোট ছিল আমার নিজ শহর। যাই হোক, আমি সীমান্ত পাড়ি দিলাম ১৭ সেপ্টেম্বর, স্বাধীনতার ৩২ দিন পরে। এর পরই হত্যাযজ্ঞ ও লুটতরাজ প্রশমিত হয়ে আসে। আমি হিন্দু-মুসলিমের মধ্যকার ঝগড়া, অর্থাৎ মারামারি দেখিনি। কিন্তু আমি দেখেছি মুখমণ্ডলে খোদাইয়ের ব্যথা- নারী-পুরুষের মাথায় অল্পসল্প মালামাল আর ত্রস্ত শিশু, যারা তাদের অনুসরণ করছিল। হিন্দু-মুসলিম উভয়ই পেছনে ফেলে গিয়েছিল ভিটেমাটি, বাড়িঘর, বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশী। ইতিহাসের তাকে সাজানো তাদের চোখের জল। উভয়ই হয়েছিল শরণার্থী।
পৃথক হওয়ার ট্র্যাজেডি এতটাই গভীর, যা শব্দবন্ধে বাঁধা সম্ভব নয়। কিন্তু হিন্দু ও মুসলিমে রূপান্তরের প্রশ্ন সমস্যাকে আরও রাজনৈতিকীকরণ করেছে। দাঙ্গায় (রায়ট) ১০ লাখ মানুষকে মাশুল গুনতে হয়েছে। নির্মূল করেছে দুই কোটি হিন্দু, মুসলিম ও শিখকে। পাকিস্তানে পক্ষপাতদুষ্ট কিছু বিষয় দাঙ্গাকে চিত্রিত করেছে 'মুসলিম নিপীড়ন' বলে। দুর্ভাগ্যবশত তা হিন্দুদের বিরুদ্ধে উসকে দিয়েছে ঘৃণাকে। নৃশংস হত্যাযজ্ঞের রূপকথা সত্ত্বেও মুসলিমদের দ্বারা হিন্দুদের রক্ষার নির্ভীক ও সাহসী উদাহরণ যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে ভারতে হিন্দুদের দ্বারা মুসলিম রক্ষার উদাহরণ। ভারতের নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবী আশিষ নন্দীর এক গবেষণায় দেখা যায়, উভয় কমিউনিটি প্রাণ বাঁচিয়েছে বিপরীত কমিউনিটির অন্তত ৫০ শতাংশ মানুষ। কেন এই হত্যাযজ্ঞ, যেখানে তারা দেশে বসবাস করেন একসঙ্গে? উপমহাদেশকে পৃথক করার দায় কার, এটি খুঁজতে গেলে গলদঘর্ম হতে হয়। এরপর পেরিয়ে গেছে ছয় দশক, এ প্রশ্নের জবাব খোঁজা এখন অবান্তর। কিন্তু এটি পরিষ্কার, হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যকার যে বিভাজন, তাতে দেশ ভাগ হবে এ বিষয়টি ছিল অবশ্যম্ভাবী। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রায়ই একটা কথা বলতেন যে, হিন্দু ও মুসলিম পৃথক দুই জাতি। আর তার এ কথায় এ দুই জাতিসত্তার বিভাজন আরও প্রকট রূপ লাভ করে। এখনো অনেকে আছেন যারা বিভাজনের জন্য অনুতপ্ত। আমি শুধু বলব, ব্রিটিশরা চেয়েছিল এ উপমহাদেশকে এক রাখা যায় কিনা। ১৯৪২ পর্যন্ত তারা ভালোভাবেই এটিকে এক রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালায়। এ বিভাজনকে তুলনা করা যায় গ্রিক ট্র্যাজেডির সঙ্গে। সবাই জানত কী ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু এটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি তারা। দেশের পরিস্থিতি এতটাই দূষিত হয়ে উঠেছিল যে, প্রাণসংহারের ভয়ে নিজ বাসভূম ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে শরণার্থীর পথ বেছে নিয়েছিল অনেকে। ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ একটি বিবৃতি পেলেন মহাত্দা গান্ধীর পক্ষ থেকে। এটি ছিল- 'হয় তুমি পাকিস্তানি, নয় ভারতীয়। ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না।' তবে এমন বিবৃতি এসেছিল অনেক দেরিতে।
বিভাজন কি মুসলিমদের কোনো স্বার্থসিদ্ধি করতে পেরেছে? আমার এমন কিছু জানা নেই। দেশ ভ্রমণের সময় আমি মানুষকে বলতে শুনেছি, তারা খুশি যে অন্তত 'কিছু জায়গা' পেয়েছে, যেখানে নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারবে, মুক্ত ভাবতে পারবে 'হিন্দু অত্যাচার' ও 'হিন্দু আগ্রাসন' থেকে। কিন্তু আমি অনুভব করি, মুসলমানরা বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এখন তারা ছড়িয়ে পড়েছে পৃথক তিনটি দেশে- ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে। ভাবুন তো, যদি এটি একীভূত উপমহাদেশ থাকত তবে সংখ্যাগত দিক দিয়ে তারা কতটা শক্তিশালী হতো, তাদের ভোট কতটা বিশালসংখ্যক হতো! তারা হতে পারত মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। সীমানা পৃথক হওয়ার পর দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে শুধুই দূরত্ব বেড়েছে। বেড়েছে একের প্রতি অন্যের দোষারোপ। আমি ভাঙা মন নিয়ে ফিরে এসেছি ওয়াঘা-অমৃতসর থেকে, এ কারণে নয় যে, সেখানকার সৈন্যরা সূর্যাস্তের কুচকাওয়াজে এখনো অংশ নেয় বুক ফুলিয়ে, এ জন্য যে, সেখানে জায়গা করে নিয়েছে নতুন পৈশাচিকতা। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ সেখানে সাজিয়েছে ১০টি বিষয়। এর মধ্যে তারা প্রদর্শন করেছে হিন্দু ও শিখরা কীভাবে হত্যা করেছে মুসলিমদের আর বিভাজনের সময় কীভাবে তারা লুট করেছে মুসলিমদের সম্পদ। এটি এমন একটি স্থানে প্রদর্শন করেছে, যা শুধু দেখা যায় ভারত থেকে। এটি পাকিস্তান ভূখণ্ড থেকে দেখা যায় না। সেখান থেকে এটিকে মনে হয় একটি বড়সড় বিলবোর্ড। সেখানে এমন কিছু বিষয় প্রদর্শন করা হয়েছে, যা কিনা আক্রমণাত্দক, এর অন্তর্নিহিত অর্থ অত্যন্ত কলুষ। এগুলো করা হয়েছে সম্ভবত বিগত দুই মাসে। কারণ পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের শান্তি আলোচনার দাবি ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে এবং এ কারণে যে, গোটা পঞ্চাশেক লোক গত বছর এখানে এসেছেন প্রথমবারের মতো ছয় দশক আগে লব্ধ স্বাধীনতাকে মোমবাতি জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে। তবে এটা ঠিক যে, ভারতে মুসলিমরা আর পাকিস্তানে হিন্দু ও শিখরা হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছে ব্যাপকভাবে। এ সময় মূলত টার্গেট করা হয়েছে নারী ও শিশুদের। যদি কেউ আমাকে বলে যে, হিন্দুত্ববাদ মহত্ত্বের দিক দিয়ে মহান, কিংবা ইসলাম ভালোবাসাকে বিস্তৃত করে, তবে আমি তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করব। কারণ আমি দেখেছি দুই ধর্মের অনুসারীরাই বিশ্বাসের ধুয়া তুলে হত্যাযজ্ঞ চালায়। তারা হর হর মহাদেব বা ইয়া আলী বলে স্লোগান দিয়ে একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শরীরে তলোয়ার বা বল্লম বিদ্ধ করে।
লেখক : ভারতীয় সাংবাদিক, কলামিস্ট, রাজনীতি বিশ্লেষক
ইংরেজি থেকে অনুবাদ : মুজাহিদুল হক।