এক. সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী এলজিআরডি ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণে বলেন, সব জায়গায় দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে। এটি হচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে। যত্রতত্র নগরায়ণের ফলে ফসলি জমি নষ্ট হচ্ছে। পরিবেশ বসবাসের অনুপযোগী হচ্ছে। ...সবাই ঢাকায় থাকতে চায়। যারা গ্রামে থাকে, তারা কেন নগরের সুবিধা পাবে না? তারাও ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকবে। ... স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর স্তর পুনর্বিন্যাস করে পর্যায়ক্রমে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আইনশৃঙ্খলা, অবকাঠামো উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা এবং অন্যান্য উন্নয়ন পরিকল্পনা এসব সংস্থায় ন্যস্ত করা হবে (সমকাল, ১৮ জুলাই-১৪)। তিনি এর আগেও কয়েকবার বলেছেন- 'জেলাকে কার্যকর করা হবে। জেলার হাতে শিক্ষা, চিকিৎসাসহ বহু কিছু ছেড়ে দেওয়া হবে'। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে স্থানীয় সরকারকে কার্যকর করার জন্য সুন্দর সুন্দর কথা ছিল। কিন্তু দীর্ঘ ছয় বছরে স্থানীয় সরকারের পক্ষে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। উপজেলা ও জেলা পরিষদগুলোকে কার্যকর করা হয়নি। তারপরেও সরকার প্রধানের মুখে এরকম সুন্দর কথা শুনলে আমরা খুশি হই, নতুন করে আশায় বুক বাঁধি। কিন্তু তার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর মুখে উল্টাপাল্টা কথা শুনে হতবাক হই। তিনি কিছুদিন আগে তিন দিনব্যাপী ডিসিদের সম্মেলনে জেলা পরিষদ বিলুপ্তির ইঙ্গিত দিয়ে বলেন- 'বেশি বেশি স্থানীয় সরকার কাজে আসে না। এত সরকার ভালো না। যত সরকার কম, ততই ভালো' (প্রথম আলো ১০ জুলাই-১৪)। এর আগে ২০০৯ সালে উপজেলা নির্বাচনকালে বলেছিলেন, 'তারা উপজেলায় বিশ্বাস করেন না। যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকার উপজেলা নির্বাচন দিয়ে গেছে, সেজন্য তারা নির্বাচন দিতে বাধ্য হচ্ছেন। কারণ নির্বাচন না দিলে জনগণের কাছে ভুল মেসেজ পৌঁছাবে।' আমরা দেখেছি গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পূর্ণ মেয়াদে উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানরা ক্ষমতায় থেকেছেন। কিন্তু তাদের ক্ষমতা ও দায়িত্ব রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ উপজেলাকে কার্যকর করা সম্ভব নয় জেনেও বর্তমান সরকার আবারও উপজেলা নির্বাচন দিয়েছে শুধু জাতীয় রাজনীতির প্রয়োজনে। দুই. অভিযোগ রয়েছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি নামক দলগুলো কাজে গণতান্ত্রিক না হলেও মুখে গণতন্ত্রের কথা বলছে। তারা স্থানীয় সরকারগুলো কার্যকর না করলেও ক্ষমতায় গিয়ে এগুলোকে একেবারে বিলুপ্ত করে দেয়নি। সে জন্য আমরা মনে করি, দলগুলোর সুমতি হলে এ দেশে অদূরভবিষ্যতে সত্যিকারের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। তাই এখন থেকেই প্রয়োজন গণতন্ত্রায়নের জন্য সামাজিক চাপ সৃষ্টি করা। লক্ষণীয়, প্রধানমন্ত্রী ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী উভয়ই স্থানীয় সরকারের স্তর বিন্যাসের কথা বলছেন। ব্রিটিশ সরকার জেলাকে স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ ও ইউনিয়নকে সর্বনিম্ন স্তর ধরে তাদের শাসন কাঠামো কার্যকর করেছিল। জেলাকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগসহ বেশ কিছু কাজ করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল। সে কারণে স্থানীয় সরকারের ক্ষেত্রে এ দুটি স্তরই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তবে বাংলাদেশ আমলে নির্বাচিত ও অনির্বাচিত সরকারগুলো রাজনৈতিক প্রয়োজনে ইউনিয়নের নিচে গ্রাম সরকার, পল্লী পরিষদ, গ্রামসভা নামে একটি স্তর এবং মহকুমা ও উপজেলা নামে পরিচিত মধ্যবর্তী আরেকটি স্তর সৃষ্টি করে। একই কারণে সেগুলোর অধিকাংশ বিলুপ্তও করা হয়। কিন্তু ইউনিয়ন ও জেলার গুরুত্ব থাকায় এ দুটি স্তরকে কখনই বিলুপ্ত করা হয়নি। তিন. জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান 'বাকশাল' ব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছিলেন জেলাকে কার্যকর করেই। তিনি তার বহু ভাষণে বলতেন, সচিবালয়ে বসে জেলার উন্নয়নের চিন্তার প্রয়োজন নেই। জেলায় বসে জেলার উন্নয়নের চিন্তা করতে হবে। তিনি ৬৪টি জেলার প্রায় সবগুলোতে গভর্নর নিযুক্ত করেছিলেন। সেই সঙ্গে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা পুলিশ কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে নির্বাচনের মাধ্যমে জেলা গভর্নর ও তার পরিষদের সদস্যদের নির্বাচিত করার চিন্তা করেছিলেন। এসব জানা থাকার পরেও আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী কেন জেলার বিলুপ্তি চাচ্ছেন তা বোধগম্য নয়। মজার বিষয় হলো, তাকে মানুষ কিশোরগঞ্জের লোক হিসেবে ইঙ্গিত করতে বেশি পছন্দ করে। এ স্থানীয়তার টানেই সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ঘোষণা দিয়েছিলেন- তিনি জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও ভৈরবকে জেলা করে ছাড়বেন।
চার. স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'সিডিএলজি' তথা সেন্টার ফর ডেমোক্রেটিক লোকাল গভর্ন্যান্স দীর্ঘদিন আগে থেকেই বলে আসছে, এ দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, আয়তন, ভৌগোলিক অবস্থান ইত্যাদির বিবেচনায় প্রদেশ সৃষ্টি বাস্তবানুগ নয়। প্রদেশের বিকল্প হিসেবে জেলাকে স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ ইউনিট ধরে গণতান্ত্রিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব। এখানে উল্লেখ্য, বিভাগকে সর্বোচ্চ ইউনিট ধরে স্থানীয় সরকারের স্তরবিন্যাস করলে বহু স্তরবিশিষ্ট স্থানীয় সরকারের সমস্যাটি থেকে যাবে। সে জন্য স্তর হ্রাসের জন্য হলেও জেলাকে সর্বোচ্চ ইউনিট হিসেবে কার্যকর করা উচিত। অর্থাৎ জেলাকে কার্যকর করে কেন্দ্রীয় সরকারের ভার লাঘব, পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নগরায়নের ডিজাইন গ্রহণসহ গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রায়নের পক্ষে বহু কিছুই করা সম্ভব। সিডিএলজির প্রস্তাবিত স্তরবিন্যাস সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী, এলজিআরডি মন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা অবগত আছেন। সবার জানা রয়েছে, দেশের সব জনগোষ্ঠী স্থানীয় সরকারের চারটি মৌলিক ইউনিট অর্থাৎ ইউনিয়ন, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড নামক প্রশাসনিক ইউনিটগুলোতে বসবাস করেন। কিন্তু এগুলোকে নিম্নতম মৌলিক ইউনিট (Basic Unit)হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়নি। বরং এ ইউনিটগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বহু স্তরবিশিষ্ট প্রশাসনিক স্তর রেখে দেওয়া হয়েছে। যেমন- ইউনিয়নকে উপজেলা, জেলা, বিভাগ, সর্বশেষে দূরবর্তী অবস্থান থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ করছে। কিন্তু একাধিক কর্তৃপক্ষ ও দূরবর্তী কর্তৃপক্ষ যে কোনো কাজের কর্তৃপক্ষ নয়, এটি বিভিন্ন ঘটনায় বারবার প্রমাণিত হয়েছে।
পাঁচ. কতিপয় রাজনীতিক ও আমলা শ্রেণীর লোকেরা এ দেশের স্থানীয় সরকারগুলোকে ইংল্যান্ড ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর মতো দেখতে চান। তারা ভুলে যান, সেসব দেশ কখনো আমাদের মতো দীর্ঘকাল পরাধীন থাকেনি। সেখানে স্থানীয় সরকারগুলো আপনা-আপনি গড়ে উঠেছে এবং স্থানীয় সরকার ও জাতীয় সরকার হাত ধরাধরি করে বিকশিত হয়েছে। কিন্তু এ দেশের মানুষের মনে এখনো ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব রয়ে গেছে। তারা স্বাধীন ও নৈর্ব্যক্তিকভাবে পরিচালিত হতে অভ্যস্ত নয়। সে কারণে, স্থানীয় সরকারগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য নিকটতম একক কর্তৃপক্ষীয় প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। জেলা এক হাতে গ্রামীণ ইউনিটগুলো এবং অন্য হাতে নগরীয় ইউনিটগুলো নিয়ন্ত্রণ করবে। জেলার সঙ্গে শুধু কেন্দ্রের সম্পর্ক থাকবে। তার আগে দুই প্রকারের সরকার পদ্ধতি তথা কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকার বাস্তবায়ন করতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে শুধু জাতীয় ও বৈশ্বিক কাজগুলো নির্দিষ্ট থাকবে এবং অবশিষ্ট স্থানীয় কাজগুলো স্থানীয় সরকার বাস্তবায়ন করবে। সেইসঙ্গে প্রতিটি স্থানীয় ইউনিটকে প্রজাতান্ত্রিক রূপ দিয়ে সেগুলো পরিচালনার ভার স্থানীয়দের হাতে ছেড়ে দিতে হবে, যেমন- ইউনিয়ন সরকার, নগর সরকার, জেলা সরকার ইত্যাদি। এ ব্যবস্থা গৃহীত হলে অনেক অপ্রয়োজনীয় ব্যয় স্তর হ্রাস পাবে। স্থানীয়দের ক্ষমতায়ন ঘটবে। পরিকল্পিত নগরায়ণসহ গণতন্ত্রমনা সব রাজনৈতিক দলের পছন্দনীয় দেশোপযোগী সরকার ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হবে। তাই আমরা মনে করি, একটি সমন্বিত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কার্যকর করার চিন্তা মাথায় নিলে জাতীয় নেতাদের আর দ্বৈত ভূমিকা পালন করতে হবে না।
লেখক : চেয়ারম্যান, জানিপপ। সহলেখক : ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান, ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার, জানিপপ; এবং মোশাররফ হোসেন মুসা, সদস্য, সিডিএলজি ও ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার, জানিপপ।
ই-মেইল- [email protected]