গত পর্বের লেখা নিয়ে নানাজন নানা মন্তব্য করেছেন। তার মধ্যে যেমন প্রাক্তন ভিসি অধ্যাপক বোমা আনোয়ার আছেন, তেমনি চ্যানেল ৭১-এর প্রাণপুরুষ বাবুও আছে। সে ফোন করেছিল, 'মামা, আপনি আমায় খুঁজছেন? বাবা অসুস্থ তাই ফোন ধরতে পারিনি। মামা, মুসা সাদিক বলল, আপনি নাকি বাংলাদেশ প্রতিদিনে আমায় খুব করে গালি দিয়েছেন। তাকে বলেছি, আমার মামা আমাকে মারে কাটে গালি দেয় সেটা আমার ব্যাপার। তাতে আপনার কী?' বাবু মঞ্জু ভাই এবং আশা আপার মেয়ে কণ্ঠির জামাই। আশা আপা এখনো আমায় মায়ের মতো আদরযত্ন করেন, হাজার মানুষের মাঝে সন্তানের মতো বুকে জড়িয়ে নেন। তার মেয়ে আদরের ভাগ্নি জামাইকে গালি দিতে যাব কেন? আর কাউকে বকাঝকা করা আমার কাজ না। সত্য বলা যদি গালাগাল হয়, পরিস্থিতি তুলে ধরা যদি বকাঝকা হয় সেটা অন্য কথা। কোরআনে আছে, 'প্রতিটি মুহূর্ত মৃত্যু ভয় কর। মৃত্যু ভয়ে কাতর থেকো।' আমি সেটাই করি। সময় নাই তাই মৃত্যু ভয়ে থাকি। কেউ মেরে ফেলবে সেই ভয়ে নয়। সাধারণ ভুলত্রুটি ক্ষমা করতে সব সময়ই প্রস্তুত। কারণ দয়াশীল ক্ষমাকারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন। কিন্তু কেন জানি না, আমি কিছু বললেই ভাসুরের মুখ বেজার। আবার না বলেও পারি না। সত্য বলার জন্য পেটের ভেতর কেমন যেন কুরকুর করে। ছেলেবেলায় লেখাপড়া করতাম না, বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়াতাম। একদিন মির্জাপুরে এক দোকানে খাচ্ছিলাম। সেখানে এক ফকির এসে হাত পাতে, 'আল্লাহর ওয়াস্তে দু'এক পয়সা ভিক্ষা দেন গো।' দোকানদার দুই পয়সা হাতে দেয়। পয়সা নিয়ে যাই যাই করে বলে উঠে, 'দেহেনচে ওইহানে এক মিষ্টির দোহানে চাড়িতে ইন্দুর পড়ছে। আমার হেডা কওনের কী দরকার। আমি দেহিকি দোহানদার মিষ্টির চাড়ি থেইকা ইন্দুর ফালাইতাছে। আমি ফকির মিসকিন মানুষ। আমারে ভিক্ষা দেবো দুই পয়সা, চার পয়সা। আমি দেখছি দেইখা আমারে আট আনা দিয়া কয় কি আমি জানি ইন্দুর পড়ার কথা কাউরে না কই। এহন আপনেই কন, ওই দোহানে ইন্দুর পড়ছে হেডা কওনের আমার কী ঠেহা। ওডা কইলে কী তারা আমারে টেহা দিবো, নাকি না কইলি দিবো? এই যে আপনে গো দোহানে মিষ্টির চাড়িতে মাছি পড়তাছে, কত তেলচোরা পড়ছে এ্যাগুনা কী আমি কবার যামু?' দোকানি ফকিরকে দুই পয়সার জায়গায় দুই টাকা দিয়ে কত যে কারুবারু, 'বাবা তুমি কিন্তু কাউরে কিছু কইও না।' এটা ছিল '৬০-'৬১ সালের কথা। আমি তখন বরাটি স্কুলে পড়ি।
আমি শুধু চেষ্টা করছি, যখন যা ঘটেছে নিরাসক্তভাবে তুলে ধরতে। এখন পর্যন্ত মরচে ধরা কোনো কিছু ঘষামাজা করে রং-চং মেশানোর চেষ্টা করিনি। আমার ভাব ভাষা নেই, বাক্য গঠনের কলাকৌশল, শৈলী নেই, আকাশ বাতাস প্রকৃতি থেকে যা শিখেছি তাই সহজভাবে বলি বা লিখি। পাঠক দয়া করে ভালোবাসে, তাই তাদের ভালো লাগে। মুক্তিযুদ্ধে যেমন সবাই মেনেছে, যা বলেছি শুনেছে, দেওয়া দায়িত্বের দ্বিগুণ তিনগুণ বেশি পালন করেছে। কোনো কৃতিত্ব না থাকতেও আমি কৃতিমান হয়েছি। যখন যেখানে সবাইকে উৎসাহিত করা যায় তখন সেখানেই সাফল্য হয় পায়ের ভৃত্য। লেখালেখিতে আমার কৃতিত্ব কোথায়? যখন যা মন চায় তাই কাউকে বড়-ছোট না করে খোলাখুলি লিখি।
আপনি ভালো করেই জানেন, আমার যত দোষই থাকুক চাটুকারিতা নেই। কারও অনুপস্থিতিতে তার ভালো ছাড়া মন্দ ভাবি না। দয়া মায়ায় মন ভরে থাকে, তাই হাজারো কষ্ট আমায় কাবু করতে পারে না। ঘাতকের ভয় আমায় কখনো স্পর্শ করে না। পরের ধনে পোদ্দারি করি না, যা করি নিজের ধনেই করি। সারা জীবন যে অর্থ সহকর্মীদের জন্য খরচ করেছি, সেটা বাপের জমিদারির হলে জমিদারিও ধ্বংস হয়ে যেত। আবার লোকজনের টাকায় গাড়ি বাড়ি করিনি। তখন আমার ১৬-১৭ বছর বয়স। কেন যেন ৫ বা ১০ টাকা ভাঙতির প্রয়োজন ছিল। মাকে বলেছিলাম, 'ভাঙতি দাও।' মা বলেছিলেন, 'নেই'। কিন্তু আলমারিতে ছোট টাকা ছিল। বলেছিলাম, কেন মা, ওই যে ওখানেই তো ভাঙতি আছে। মা বলেছিলেন, 'বজ্র, ওগুলো একজন আমার কাছে রেখেছে। তার টাকা তাকে না দিয়ে বদলে দেওয়া ভালো না। আমি ওটা পারবো না। আমার কাছে রাখাটাই তাকে দেবো। তুই কোনো দোকান থেকে ভাঙতি করে নে।' মাকে খুবই ভালোবাসতাম তাই কিছু মনে করিনি। কিন্তু তার সেদিনের কথার কিছু সেদিন বুঝিনি। এখন বুঝি, মানুষের গচ্ছিত অক্ষত ফিরিয়ে দেওয়াই ভালো। কোরআনেও তেমন আছে। কিন্তু আমি তখন কোরআন পড়িনি। বড় হয়ে মাকে সব সময় কোরআন পড়তে দেখতাম। মা না ফেরার দেশে যাওয়ার ৫-৭ বছর আগে এক দু'বার জিজ্ঞেস করেছি, তুমি যে আরবি কোরআন পড়। নিজে না পারলে মহিলা রেখে কোরআন শোন। কি পড়, কি শুনো অর্থ বুঝ? মা বলতেন, 'অর্থ বুঝলে আরও ভালো হতো। কিন্তু কোরআন পড়লে আমার দেহে স্বর্গীয় মধুর এক অনুভূতি হয়। শুনলে তন্ময় হয়ে যাই। মনে হয় আমি আল্লাহর সঙ্গে, আল্লাহ আমার সঙ্গে কথা বলছেন।' চলে যাওয়ার আগে শেষের দিকে তাকে কটি বাংলা কোরআন দিয়েছিলাম। কোরআনের অনুবাদ পড়ে খুবই খুশি হতেন। আমাকে বলতেন, 'বজ্র, এখানে যেভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা, আমিও আরবিতে পড়ে আরবিতে শুনে এমনটাই অনুভব করতাম।' মার কথা শুনে খুবই ভালো লাগত। ভালো মানুষ, যে আল্লাহর ধ্যানে থাকে, আল্লাহই তাকে জ্ঞান দেন, আল্লাহই তাকে বুঝ দেন। আমাকেও যেমন ছিটেফোঁটা দিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদিনে আপনি এবং রেহানা ওয়াজেদ ভাইয়ের সঙ্গে জার্মানিতে ছিলেন। সেখান থেকে কদিন পর দিল্লি আসেন। এই সেদিন ৪ আগস্ট বেলা দেড়টায় দিল্লিতে মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে আপনার চরম দুঃসময়ের স্মৃতিবিজড়িত পান্ডারা রোডের বাড়ি গিয়েছিলাম। আগে বাড়িটি ছিল ডেপুটি সেক্রেটারিদের, এখন নাকি এক জয়েন সেক্রেটারি মিস্টার সিং কিনেছেন। ভেবেছিলাম, ড্রয়িং রুমের একটা ছবি তুলে আনব। দিল্লিতে যখন যেখানে যাই ভীষণ সমাদর পাই। তাই কাউকে কিছু না বলে গিয়েছিলাম। দোতলা সিঁড়ির মুখে কলিং বেল টিপতেই কাজের লোক এসে বলল, বাড়িতে কেউ নেই। সব বৃত্তান্ত শুনে ভদ্রলোক কেয়ারটেকারকে ফোন করল। আমি নিচে গাড়িতে বসেছিলাম। ৫-৭ মিনিট পর কেয়ারটেকার মিস্টার সতীশ (ফোন-৯৭৬৮৭১২৭৩৭) এসে বলল, মালিকের অনুমতি ছাড়া বৈঠকখানাও দেখাতে পারবে না। আমরা অবহেলায় কত কিছু নষ্ট করি। কষ্টের পান্ডারা রোডের ছোট বাড়িটা স্মৃতি হিসেবে কি রাখা যেত না? মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি হিসেবে কলকাতার থিয়েটার রোডের বাড়ি যেমন রাখিনি, পান্ডারা রোডের বাড়িও তেমন রাখা হলো না। বাড়ির সামনে জয় খেলত, পুতুল খেলত। সেসবের কত স্মৃতি। শত্রুরা তো কত কথাই বলবে। কিন্তু ইতিহাস কী বলবে? তার উপাদান নষ্ট করার জন্যে ভাবীকাল আমাদের কি মোটেই দায়ী করবে না? কত শুনি এখন ভারতের সঙ্গে নাকি আপনার সরকারের দারুণ সম্পর্ক। তারপরও কেন এমন হলো? সময় ছিল না তাই চলে এসেছিলাম। আমি এবার ছিলাম দিল্লি থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে হরিয়ানার নতুন শহর গুরগাঁওয়ে রাখীবোন শর্মিলা চক্রবর্তী মিলু বকশীর বিশাল বাড়িতে। তাকে আপনার চেনার কথা, বেশ ক'বার দেখেছেন। আমি যখন জে-১৮৮১ চিত্তরঞ্জন পার্কে থাকতাম, তখন এসি সেনের ছেলেমেয়ে নিউ দিল্লি মডার্ন স্কুলে পড়ত। যেখানে রাহুল প্রিয়াঙ্কাও পড়ত। ওদেরই বন্ধু মিলু। শঙ্খু, গার্গী কাকু বলে ডাকত, মিলু ডাকত দাদা বলে। শরীয়তপুরের ডিংগা মানিকের ড. পিকে চক্রবর্তী ওর বাবা। মিলু বাপ-মার একমাত্র সন্তান। ওর কোনো দাদা ছিল না, ছোট ভাইবোনও না। সেই মিলু '৭৮ সালে ভাই ফোঁটার চিঠি লিখে। আমি শিলিগুড়ি থেকে ফোঁটা নিতে দিল্লি যাই। সেই থেকে ও আমার রাখিবোন। মানুষের জীবন কেমন? কীভাবে সম্পর্ক হয়, সম্পর্কের মান রাখলে তার মূল্য অনেক, না রাখলে কিছুই না। এসি সেন আমার কেউ না। তিনি হিন্দু, আমি মুসলমান। বাঙালি বলে আমাদের দুজনের ভাষা এক, ভালোবাসা এক। ভারতের সর্বোদয় নেতা শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণের 'ওকে দেখো' এমন এক চিঠিতে তিনি আমায় ১২ বছর দেখাশোনা করেছেন। সেই এসি সেনের বাড়িতে বাংলাদেশের কোনো নেতা যায়নি? কোনো নেতা খায়নি? খোঁজাখুঁজি করে হয়তো দু-একজন বের করা যাবে। সিলেটের বাবরুল হোসেন বাবুল, মমতাজ হোসেন, হাশেমী মাসুদ জামিল যুগল, সাইফুল ইসলাম খোকা, UCBL-এর এক সময়ের চেয়ারম্যান জাফর আহমেদ চৌধুরী- কতজন মাসের পর মাস সিআর পার্কের বাড়িতে থেকেছে। আপনিও বেশ কয়েকবার গেছেন। দুলাভাইয়ের সঙ্গে জয়-পুতুলকে নিয়ে একবার দুপুরে চিত্তরঞ্জনে খেতে যেতে হজরত নিজামুদ্দিন চিশতীর মাজারের পাশে লোদি হোটেলের সামনে গাড়ি খারাপ হয়েছিল। ভাড়া ট্যাক্সিতে সেখান থেকে চিত্তরঞ্জন গিয়েছিলাম। তারপর আবার এসি সেনের গাড়ি করে পান্ডারা রোডে। লোদি রোড থেকে চিত্তরঞ্জন ট্যাক্সি ভাড়া ছিল ১৩-১৪ টাকা। কথা ছিল দুলাভাই দেবেন। কিন্তু পরে তিনি গড়িমসি করছিলেন। কবে কোন জামানায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় জননেতা আবদুর রাজ্জাককে ৫০ টাকা দিয়েছিলেন সেটা হাজারবার বলতেন। তাই বাসায় ফিরে বলেছিলেন, 'বজ্র, চেষ্টা করে দেখো দুলাভাইয়ের কাছ থেকে ট্যাঙ্ িভাড়া আদায় করতে পার কিনা। যদি পার তোমাকে উপহার দেব।' কয়েক ঘণ্টা প্রাণপাত করে আমি পেরেছিলাম। ১৫-১৬ টাকা আদায় করেছিলাম। সে জন্যে আপনি হাজার টাকা উপহার দিয়েছিলেন। এখন যে যতই উজির নাজির মারুক, তখন আপনার কাছে তেমন কোনো টাকা ছিল না। খান মার্কেটের ব্যাংকে আপনার যে অ্যাকাউন্ট ছিল তার একটা চেকের মুড়ি আমার কাছে আছে। তাতে হাজার, পনের শ, দুই হাজারের বেশি কোনো চেক কাটা নেই। নিশ্চয় বিষয়গুলো আপনার এখনো মনে আছে? ফরিদপুরের কিরন চন্দ্র লাহিড়ী আমার সঙ্গে বহুবার আপনার পান্ডারা রোডে গেছেন। কত আলাপ করেছেন। কিরন চন্দ্র লাহিড়ী দেখতে বিখ্যাত অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের মতো ছিলেন। যেদিন চলে আসেন সেদিনও তিনি পান্ডারা রোডে গিয়েছিলেন। ছবি খুঁজে পেলে আপনাকে পাঠাব অথবা পত্রিকায় ছেপে দেব। আরেকজন আমাদের বড় হিতৈষী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে বড় ভালোবাসতেন। বাঙালি নন, অবাঙালি। থাকতেন দিল্লির ডিফেন্স কলোনির ছোট্ট এক ঘরে। জনাব এল কে খতিব খুব সম্ভবত গুজরাটের মুসলমান। স্বাধীনতার পর ঢাকায় কোনো সংবাদ সংস্থার প্রতিনিধি ছিলেন। ‘Who Killed Mujib’ বঙ্গবন্ধুর হত্যা নিয়ে অসাধারণ তথ্যবহুল এক বই লিখেছিলেন। তিনিও আপনাকে আমাকে ভীষণ ভালোবাসতেন এবং তার বিশ্বাস ছিল মুজিব হত্যার বিচার হবে এবং আমরা সসম্মানে দেশে ফিরব। তার বিশ্বাস অমূলক ছিল না। তার বিশ্বাসের ভিত ছিল বড় পাকাপোক্ত।
ভাই ফোঁটা রাখি বন্ধনের কথা বলছিলাম। মিলু তার মা ড. অরুণা চক্রবর্তী, বাবা ড. পিকে চক্রবর্তীর একমাত্র মেয়ে। আমি থাকতাম জে-১৮৮১ তে, ওদের বাসা আই-১৮০৬। কত হবে, আমাদের বাড়ি থেকে এক-দেড়শ গজ। ওর বাবা হঠাৎই মারা যান। বাবা-মা দুজনই চাকরি করতেন বলে কোনো আর্থিক অভাব ছিল না। ওর মা পরে দিল্লির বিখ্যাত জানকী দেবী কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর নিয়েছেন। মিলু বিয়ে করেছে অসাধারণ এক পাঞ্জাবি অখিল বকশীকে। দুই ছেলে-মেয়ের মা এখন মিলু। আইসিএস পাস করে কিছু দিন চাকরিও করেছে। সাংবাদিক রাজেন্দ্র সারীনের মেয়ে শিল্পী, মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির মেয়ে শর্মিষ্ঠা মুখার্জি মুন্নী এবং শর্মিলা চক্রবর্তী মিলু ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পাস করে চাকরি নিয়েছিল। কেন যে তিনজনই চাকরি ছেড়ে দিয়েছে জানি না। মিলু এখন মাস্টারি করে, অখিল এটা ওটা নিয়ে সারা দিন পড়ে থাকে। গাড়ি-ঘোড়ার বহর নিয়ে দুনিয়া ঘুরে। কয়েক বছর আগে কাঠমান্ডু না কোথায় দুর্যোগে আটকা পড়ায় ভারতীয় বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার তাদের উদ্ধার করে। সেই মিলুর গুরগাঁওয়ে এক বিশাল বাড়ি। ওর চাপাচাপিতেই সরকারি ব্যবস্থা বাদ দিয়ে এবার গুরগাঁওয়ে উঠেছিলাম। সেখানে সুবিধা ছিল ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর খুব কাছে, ১০ মিনিটের পথ। ৯ আগস্ট ঢাকা ফিরেছি। যাওয়ার পথে বিমান ছিল অন টাইম, কিন্তু ফেরার পথে দুই ঘণ্টা লেট। তবে মহিলা পাইলট ক্যাপ্টেন শাহানার বিমানে প্রথম উঠেছিলাম। শাহানা আমার প্রিয় ছোট বোনের নাম, তাই সেদিন খুবই ভালো লেগেছিল, গর্ব হয়েছিল। আমাদের মেয়েরাও আকাশে জাহাজ উড়াতে পারে। পরের দিন ১০ আগস্ট ছিল রাখি বন্ধন। '৭৮ সালে মিলু আমায় ভাই ফোঁটা দিয়ে রাখি বেঁধেছিল। ৭-৮-৯ সারা দিন ক্ষণে ক্ষণে নানা চ্যানেলে পাকিস্তানের মেয়ে গুজরাটের বউ কমর মোহসীন নরেন্দ্র মোদির রাখী বোনের ঝলক দেখাচ্ছিল। কমর মোহসীন ৩৩ বছর আগে পাকিস্তান থেকে গুজরাট এসে বিয়ে করে বেশ ভালোই আছে। এক সময় গুজরাটের গভর্নর শ্রী স্বরূপ সিং তাকে মেয়ের মতো দেখাশোনা লালন-পালন করতেন। গভর্নর ড. স্বরূপ সিং চলে যাওয়ার সময় শ্রী নরেন্দ্র মোদিকে বলে গিয়েছিলেন কমর মোহসীন আমার মেয়ে, ওকে তুমি দেখে রেখ। সেই থেকে কমর মোহসীন নরেন্দ্র মোদির বোন। ১৮ বছর সে শ্রী মোদির হাতে রাখি বাঁধে। দিল্লিতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদির এমন সব অনেক চমকপ্রদ ঘটনা শুনেছি। যেদিন দিল্লি যাই তার পরদিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি নেপাল সফর করেন। যাওয়ার পথে এক নেপালি বাচ্চা নিয়ে যান। যাকে তিনি বহু বছর ধরে দেখাশোনা করেন, লেখাপড়া করান। কত অসহায় মেয়েকে দেখাশুনা করেন, হোস্টেলে রেখে লেখাপড়া করান- এক এক করে তার নানা রকম সামাজিক কর্মকাণ্ডের খবর বেরুচ্ছে। কিছু মানুষ বিশ্বাস করছে, কিছু প্রচার বলে উপহাস করছে। কিন্তু সব কিছু যে ফেলে দেওয়ার মতো নয় তা তার কার্যকলাপে দিন দিন ফুটে উঠছে। বারবার বহুবার কমর মোহসীনের ভাই ফোঁটার খবর দেখে গুরগাঁওয়ে মিলুর বাড়িতে মনে হচ্ছিল, এই সেদিন এই ছোট্ট মেয়ে শিলিগুড়ি থেকে ডেকে এনে ধান দুর্বা দিয়ে ভাই ফোঁটা দিয়ে আমার হাতে রাখি বেঁধেছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মুসলমান বোন কমর মোহসীন ১৮ বছর, আমার হিন্দু বোন মিলু রাখি বাঁধছে ৩৬ বছর। সেই বোনের বাড়ি ছোট ভাইয়েরা দলবল নিয়ে থেকেছে। আমি কখনো থাকিনি, তাই গিয়েছিলাম। ৯ আগস্ট ফেরার পথে দুপুর ১২টায় সে আমায় অগ্রিম রাখি বেঁধেছিল। ঢাকায় ফিরে তার সেই রাখি পরম যত্নে যজ্ঞের ধনের মতো আলমারিতে তুলে রেখে দিয়েছি। যাতে অনন্তকাল সে রাখি মানুষে মানুষে জাতিতে জাতিতে ভালোবাসা হয়ে থাকে।
বলেছিলাম, বঙ্গবন্ধুর তিরোধানের দিন আপনি ছিলেন না, আমি ছিলাম, আমরা ছিলাম। যারা জাসদের রাজনীতি করেছে, রাজনৈতিকভাবে বিরোধিতা করেছে তাদের প্রতি আমার খুব একটা অনুযোগ অভিযোগ নেই, এখন করলেও থাকবে না। কিছু দিন আগে জনাব মাহমুদুর রহমান মান্না জাসদের দুই রূপ তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। আমিও তার সঙ্গে খুব একটা অমত করি না। গণতান্ত্রিক দেশে ভিন্নমতের রাজনীতির প্রতি সম্মান না দেখানো অগণতান্ত্রিক মনোভাবের লক্ষণ। জনাব শাজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব, মেজর জলিল, মাহমুদুর রহমান মান্না, আক্তারুজ্জামান- এরা যেমন রাজনৈতিক বিরোধিতা করেছে, অন্যদিকে জিয়াউর রহমানের অধীনে যুদ্ধ করা মুক্তিযোদ্ধা, পরবর্তীতে অতি বিপ্লবী কর্নেল তাহের, হাসানুল হক ইনু, শাজাহান খান, মঈনুদ্দিন খান বাদলরা সশস্ত্র পন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে নিদারুণ অন্যায় করেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী জাসদের ভূমিকা নিয়ে আগামী সংখ্যায় কিছু লিখতে চাই, সময় হলে দয়া করে একটু দেখবেন।
লেখক : রাজনীতিক।