গোটা দেশটাই আজ ইনটেনসিভ কেয়ারে। শেখ হাসিনা আজ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল, অভূতপূর্ব এবং অনভিপ্রেত আড়াই-তিন হাজার বছর আগের বাদশাহদের চাইতেও ক্ষমতাধর। কী সংগঠন, কী প্রশাসন, কী সংসদ, কী কার্যনির্বাহী পরিষদ কোথাও তার কোনো সিদ্ধান্ত এমনকি ভুল সংশোধনেরও অধিকার কারও নেই। রোমান সভ্যতায় রোমান সম্রাট ও সক্রেটিসের সময়কালেই গ্রিসের সংসদেও বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রশ্নে বাক-বিতণ্ডা, তর্ক-বিতর্ক কখনো কখনো প্রচণ্ড রূপ ধারণ করত। প্লেটোর শিক্ষক সক্রেটিস আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছরেরও আগে সংসদে দাঁড়িয়ে (তখন পুরো সংসদই সক্রেটিসের বিচারকার্য পরিচালনা করছিলেন) অকুতোভয়, মেরুদণ্ড খাড়া করে সগৌরবে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে যে অভিভাষণটি দিয়েছিলেন তা কেবল এই আড়াই হাজার বছর ধরে নিরবচ্ছিন্ন নয়, অনন্তকাল ধরে পৃথিবীর ইতিহাসে সত্যের প্রতি অর্ঘ্য প্রদানের জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হয়ে রইবে। বিচারে রায় হয়েছিল সক্রেটিসকে হেমলক বিষ পান করে মৃত্যুবরণ করতে হবে, অবশ্য তিনি দেশান্তরিত হতে চাইলে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রয়োগ করা হবে না। এই রায়ের বিরুদ্ধে অত্যন্ত মৃদুভাষী সক্রেটিস যে গুরুগম্ভীর অভিভাষণটি দিয়েছিলেন তা শুধু কালজয়ী নয়, সত্যাশ্রয়ীদের জন্য একটি উৎসারিত অনুপ্রেরণা। মৃদুভাষী সক্রেটিস বলেছিলেন, 'সম্মানিত পারিষদ, আমি রাজনীতিক নই, বাকচাতুর্যে নিজের অভিমতকে চমৎকারভাবে উপস্থাপিত করে সপক্ষে সিদ্ধান্ত প্রণয়নের ক্ষমতা আমার নেই এবং সে অভিপ্রায়ও আমার নেই। আমি নিঃশঙ্কচিত্তে বলতে চাই- মিথ্যাকে সত্যরূপে গ্রহণ করার চাইতে, মিথ্যাকে মিথ্যা ও সত্যকে সত্যরূপে গ্রহণ করে প্রত্যয়দীপ্ত চেতনায় অধিষ্ঠিত থেকে মৃত্যুবরণ আমার কাছে শুধু সম্মানজনক নয়, প্রত্যয় ও প্রতীতির বহিঃপ্রকাশ। কালজয়ী ও প্রাতঃস্মরণীয় হওয়ার জন্য নয়; সত্যকে সত্য, মিথ্যাকে মিথ্যা বলার এই গৌরব থেকে বঞ্চিত হতে আমি নারাজ বলেই হেমলক আমার কাছে মরণ-বিষ নয় বরং জীবনের অমৃত স্বাদ।' তার অতি প্রিয় শিষ্য প্লেটোর দিকে তাকিয়ে বললেন, 'আমি জানি তোমরা আমাকে ভালোবাস এবং আমার জীবন দর্শনকে সম্মান কর। শুধু তোমাদের কাছে একটি চাওয়া, আমার সন্তানরা সত্যাশ্রয়ী না হয়ে ক্ষমতার আকর্ষণে অথবা নির্যাতন-নিগ্রহের আতঙ্কে যদি আদর্শচ্যুত হয়, তোমরা তাদের অন্তর থেকে ঘৃণা কর, আমার আত্দা তাতেই তৃপ্ত হবে।' আজকের রাজনৈতিক আঙ্গিকে সক্রেটিসের এই উক্তিটি আমার অনবরত উচ্চারণ করতে এবং বার বার উদ্ধৃত করতে অনুপ্রাণিত করে এ জন্য যে, রাজনীতির সর্বাঙ্গে যে কলুষতা, যে বিবেক বিবর্জিত স্তাবকতা, দুই দলের দুই নেত্রীর স্তাবকতা এবং সত্যকে সত্য বলার প্রবণতা যখন নিঃশেষিত প্রায় তখন সক্রেটিসের উচ্চারিত অমোঘ বাণীর উৎসারিত সত্য নতুন প্রজন্মের মধ্যে অনুসরণীয় হিসেবে গ্রোথিত করা ও তাদের অকুতোভয় চিত্তে এর নির্মল প্রভাব তৈরি করা- জীবন সায়াহ্নে এটি আমার অন্তিম অভিলাষ।
সাম্প্রতিককালে সম্প্রচার নীতি ও সংসদকে বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা প্রদানের সব উদ্যোগই সমাপ্তির পথে। শেখ হাসিনার অবস্থান থেকে এই দুটি আইন নিষ্প্রয়োজন। কারণ সংসদ এবং শাসনতন্ত্র এমনিতেই তার অাঁচলে বাঁধা। সম্ভবত বহির্বিশ্বকে অবহিত করতে চান দেশের অভ্যন্তরে তিনি কতখানি লৌহমানবী। যুক্তি হিসেবে- পারিষদবর্গ অবলীলাক্রমে বলেন, বিচারপতি অভিশংসন আইনের মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সংসদের হাতে, শাসনতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত অনেক দেশেই রয়েছে, এমনকি পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতবর্ষেও রয়েছে। কিন্তু এই যুক্তির উপস্থাপকরা হয়তো অজ্ঞ অথবা বিবেকবিবর্জিত। অন্যান্য সংসদ তো বটেই, ভারতবর্ষের সংসদও কারও অাঁচলে বাঁধা নয়। উপরন্তু, ভারতবর্ষে একটি সংসদীয় রাজনীতির ঐতিহ্যও তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক সংগঠনগুলো নিজ নিজ আদর্শের আঙ্গিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। তার উপরে তাদের বিচার ব্যবস্থা পরিপূর্ণ স্বাধীন। নির্বাচন কমিশন সব বিতর্কের ঊধের্্ব। দুর্নীতি ও অপরাধ দমনে সিবিআই দুর্দমনীয়। আমেরিকাতে রাষ্ট্রপতিকে স্বয়ং ইমপিচমেন্টের আতঙ্কে ও আশঙ্কায় কখনো কখনো মারাত্দকভাবে ভুগতে হয়। আমাদের দেশে প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা, সংসদ, রাজনৈতিক সংগঠন, নির্বাচন কমিশন কোনোটিই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিতে পারেনি। বরং মূল্যবোধ অবক্ষয়ের অতলান্তে এতটাই নিমজ্জিত, এখন তার নিরপেক্ষ অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সমাজে প্রবাদ আছে- 'মাছের পতন মাথা থেকে।' সমাজ ও রাজনীতি এর ব্যতিক্রম নয়। যতই দিন যাচ্ছে সামনের দিনটি আরও কালো মেঘে ঢাকা মনে হচ্ছে।
আরেকটি যুক্তি- '৭২-এর সংবিধানে আইনটি অন্তর্ভুক্ত ছিল। '৭৩-এর সংসদে মাত্র ৯ জন বিরোধীদলীয় সদস্য থাকলেও বঙ্গবন্ধুর পৃষ্ঠপোষকতায় ও উদার গণতান্ত্রিক চেতনার আঙ্গিকে সংসদটি ছিল সম্পূর্ণ সার্বভৌম এবং বাক্-স্বাধীনতার পীঠস্থান। বিচার ব্যবস্থা দলীয় আবর্তের বাইরে ছিল। কথা বলার স্বাধীনতা এতই উদার ও উন্মুক্ত ছিল যে, তার সামনে দাঁড়িয়ে তার আদর্শ ও চেতনার উত্তরাধিকার হওয়া সত্ত্বেও বাকশালের বিরোধিতা করার সুযোগ ছিল। আর আজ সাম্প্রতিককালের বাজেট অধিবেশনই প্রমাণ করল, সত্যকে সত্য ও মিথ্যাকে মিথ্যা বলা তো দূরের কথা, বাজেটের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরারও প্রয়োজন বোধ করেননি শতকরা ৮০ জন সদস্য। আমার ধারণা, তারা বাজেটের পাতা উল্টেও দেখেননি। শতকরা ৯০ জন সংসদ সদস্য কার্যপ্রণালী বিধি সম্পর্কে অনভিজ্ঞ। শুধু স্তুতি, বন্দনা, অর্চনা ও তোষামোদ। অবশিষ্ট অল্প একটু সময় অস্তিত্ব বিবর্জিত বিএনপির (যারা সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসই করে না) শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অপরিশীলিত ও অসংসদীয় সমালোচনা এবং গালিগালাজ।
রাজনৈতিক সংকটের আরেকটি দিক হলো- আদর্শনিষ্ঠ রাজনৈতিক কর্মী বিএনপিতে আগাগোড়াই অপ্রতুল ছিল। ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে, সামরিক ব্যক্তিত্বের ঔরসে জন্ম নেওয়া প্রতিষ্ঠানটি জন্মলগ্ন থেকেই ক্ষমতাকেন্দ্রিক এবং আদর্শ বিবর্জিত নেতৃত্ব দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়। দলছুট ও নীতিবিবর্জিত ব্যক্তিদের প্লাটফর্ম ছিল দলটি। যতই দিন গেছে ততই সুবিধাবাদীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হওয়ায় প্রকৃত প্রয়োজনের দিন দেশের মানুষ ও বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করল সংগঠনটির নিদারুণ দৈন্যদশা এবং প্রদত্ত কর্মসূচির করুণ ও মর্মান্তিক চেহারা। ২৯ ডিসেম্বর বেগম খালেদা জিয়ার আহূত 'মার্চ ফর ডেমোক্রেসি'র ব্যর্থতা এতই উলঙ্গভাবে দলটির দুর্বলতা প্রকাশ করল, আন্তর্জাতিক বিশ্বের যেসব মহল ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনটিকে অগ্রহণযোগ্য মন্তব্য করেছিলেন তারাও হতবিহ্বল হয়ে পড়লেন। ফলে অপ্রতিরোধ্য হতে পারলেন শেখ হাসিনা। সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রাখার অজুহাতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বললেও নির্বাচনের পরপরই আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী ভ্রান্ত বামেরা তাকে বোঝাতে সক্ষম হলেন, তিনি অপ্রতিরোধ্য এবং তার সব চিন্তাই অলঙ্ঘনীয়। ফলশ্রুতিতে শেখ হাসিনার উক্তি, অভিব্যক্তি, উচ্চারণ, দাম্ভিকতা- সবকিছু গণ্ডি ছাড়িয়ে গেল। বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য- সব দেশের প্রতি তার চ্যালেঞ্জ বিশ্ব-রাজনীতিতে তার অবস্থান কোথায় নিয়েছে এটি নির্ধারণ না করেও বলা যায় রপ্তানির দুটি প্রধান খাত- পোশাকশিল্প ও জনশক্তি রপ্তানিতে এক বন্ধুর পথ তৈরির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
আজ বিএনপির যে বেহাল অবস্থা, তাতে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আজীবন প্রধানমন্ত্রী করার কোনো প্রয়োজন নেই। আর অন্য কোনো সাংবিধানিক সংশোধনীও নিষপ্রয়োজন। যে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের অবজারভেশনের ওপর ভিত্তি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিধানটি অপসারিত হলো, অভিশংসনটি জারির পরে দেখা গেল তিনি আইন কমিশনের চেয়ারম্যান নন, আওয়ামী লীগের আইন সম্পাদকের ভূমিকা পালনে ব্যাপৃত। এখানে এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি (কী রাজনৈতিক, কী প্রশাসনিক), যারা অন্তত সংশোধনের খাতিরেও প্রধানমন্ত্রীকে সতর্ককরণের জন্য কিছু বলা তো দূরে থাক, তার চিন্তার বিপরীতে কিছু ভাবতে পারেন। কিন্তু তার সংগঠনের দিকে তাকালে সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্তদের কী প্রতিক্রিয়া হয় জানি না; বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমার ভালোবাসা ও আনুগত্য অকৃত্রিম এবং নিষ্কলুষ বলেই আমি প্রচণ্ড আতঙ্কিত বোধ করি। সরকারবিরোধী আন্দোলন যে কোনো কারণে একটু দানা বাঁধলেই শেখ হাসিনা উপলব্ধি করবেন তিনিও কতটা নিঃসঙ্গ। তার ভ্রান্ত বাম, পারিষদবর্গ ও সুবিধাভোগীরা কোনোদিনই বিপদের সময় নেতৃত্বের পাশে থাকে না। সংসদে শেখ হাসিনার শতকরা ১০০ ভাগ সমর্থন থাকলেও তার মূল সংগঠন আওয়ামী লীগ আজ ক্রমেই বিবর্ণ হয়ে চলেছে। প্রায় এক যুগ ধরে সেখানে কোনো কাউন্সিল হয় না; কোনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই এক-দেড় যুগ ধরে। কোনো আবদার বা আর্জির আঙ্গিকে নয়, সতর্কীকরণ হিসেবে শেখ হাসিনার কাছে আমার পরামর্শ- তৃণমূল পর্যায় থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সর্বস্তরে কাউন্সিল করতে নির্বাচিত নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করুন। দলীয় এবং আন্তঃসাংগঠনিক বিরোধগুলো মিটিয়ে ফেলুন। এ ছাড়া এভাবে জোড়াতালি দিয়ে চললে ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর বিএনপির বেহাল অবস্থার মতো তাকেও বিপদের মুখোমুখি হতে হবে।
শেখ হাসিনার কাছে আমার আরেকটি পরামর্শ- শেয়ার বাজার, হলমার্ক, ডেসটিনি- এসব সমুদ্র-চুরির মামলাগুলো বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিশেষ ব্যবস্থায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করুন। নইলে প্রশাসন থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি যেভাবে প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে তা নিয়ন্ত্রণ তো করতে পারবেনই না, বরং দেশটি থেকে ন্যায়বিচার, মুক্তচিন্তা নিঃশেষিত হয়ে যাবে। সামাজিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করা কারও পক্ষেই সম্ভব হবে না। সাংগঠনিক দিক থেকে আওয়ামী লীগ ক্রমেই রক্তশূন্য হয়ে যাচ্ছে। আশ্চর্যান্বিত ও বিস্ময়াভিভূত না হয়েও পত্রিকায় পড়লাম, এরশাদ সাহেব বিএনপিকে বলেছেন- মাজা ভাঙা দল। ওদের পক্ষে রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলা অসম্ভব। উক্তিটির সঙ্গে আমি একমত হওয়া সত্ত্বেও এরশাদ সাহেবের (যিনি ৯ বছর নির্বাহী রাষ্ট্রপতি ছিলেন) উক্তির বিপরীতে তাকে কি আমরা জিজ্ঞেস করতে পারি না, আপনি আপনার বিবেকের দর্পণের সামনে দাঁড়িয়ে আপনার অবস্থানটি অবলোকন করুন। সার্বিক অর্থে রাজনৈতিক অঙ্গনে আপনার অবস্থান যে গোলকধাঁধার সৃষ্টি করেছে তা শুধু দেশীয় রাজনীতিতে নয়, বিশ্বও আপনাকে মেরুদণ্ডহীন, আদর্শবিচ্যুত এবং রাজনৈতিক ক্লাউন ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারে না। আপনার ব্যক্তিগত সমালোচনায় না গিয়েও আমি বলতে পারি, মিনিটে মিনিটে রাজনৈতিক ডিগবাজি বা ঘণ্টায় ঘণ্টায় কথা পরিবর্তন শুধু আপনার প্রতি নয়, রাজনীতিতে একটি নেতিবাচক প্রভাবকে প্রতিস্থাপিত করেছে। স্বৈরাচার হিসেবে গণআন্দোলনে আপনার সরকারের পতন হলেও আজকে আপনার যে রাজনৈতিক দুর্দশা ও নাজুক অবস্থান- তা এর আগে কখনো ছিল না। একদিকে আপনি বর্তমান সরকারের মন্ত্রীর সমমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত, অন্যদিকে বিরোধী দল হিসেবে দাবি করা স্ববিরোধিতার পথ ছাড়ুন। আপনার আত্দমর্যাদা, আত্দসম্মান ও দেশের রাজনীতিতে জটিলতা সৃষ্টি না করে রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করাই আপনার জন্য সঙ্গত ও সম্মানজনক। আপনি কবি, হাছন রাজার মতো সুনামগঞ্জের হাওরে গিয়ে পানসী নৌকায় গান বাঁধতে আপনাকে আমি বলব না। সম্ভব হলে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে দূরত্ব বজায় রেখে নতুন প্রজন্মের মধ্য থেকে তরুণ ও উজ্জীবিত সত্তাকে খুঁজতে থাকুন, যে তারুণ্যের উজ্জীবিত ও অকুতোভয় শক্তি দুটি পরিবারের দাসত্ব থেকে দেশবাসীকে অবমুক্ত করতে পারবে।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী; মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, কোনো প্রাপ্তির প্রত্যাশা নিয়ে নয়, নির্যাতন-নিগ্রহকে যারা কোনোদিনই পরোয়া করেনি, তাদের হৃদয়ের নিভৃত কন্দরে একটা অব্যক্ত কান্না পুঞ্জীভূত হচ্ছে। অবহেলিত হওয়ার কারণে দীপ্তিহীন আগুনের নিভৃত দহনে তারা আজ পদে পদে দগ্ধীভূত হচ্ছে। উপসংহারে আমার সবিনয় উপস্থাপন, আমরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছি প্রাক্তন ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশনের বিরুদ্ধে একটি সূক্ষ্ম অপপ্রচার শুরু হয়েছে, আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করার জন্য আমরা সুপরিকল্পিতভাবে সংগঠন করছি। আমরা নির্মোহ চিত্তে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের উত্তরাধিকারের একমাত্র দাবিদার। আমরা কারও বিরোধীও নই, অঙ্গসংগঠনও নই। নির্মোহ চিত্তে বাঙালি জাতীয় চেতনার উন্মেষ, তার বিকাশ, ব্যাপ্তি ও সফলতার পথ বিনির্মাণে এবং স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে মানুষের হৃদয়ের সিংহাসনে অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং একক নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত করার আমরাই সূর্যসৈনিক। আমাদের অতীত গৌরবোজ্জ্বল, আমাদের অর্জন স্বাধীনতা। মুজিব ভাই থেকে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির জনক উপাধিতে ভূষিত করার গৌরবদীপ্ত অর্জন ছাত্রলীগেরই।
৬০ দশক থেকে আমরা যারা রাজনৈতিক পথপরিক্রমণে অভিযাত্রিক- আমাদের মতাদর্শের মারাত্দক ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য ও স্বাধীনতার চেতনায় আমরা ছিলাম এক ও অভিন্ন। আজ মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা শাজাহান সিরাজ। তিনি সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাস করতেন, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের অনুসারী। আমি গণতন্ত্র ও নির্বাচনের প্রশ্নে নিষ্কলুষ চিত্ত, আপসহীন।
তবুও শাজাহান সিরাজ আমার অনুজপ্রতিম এবং আমাদের দুটি পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক অকৃত্রিম এবং তুলনাবিহীন। আমি দেশবাসীর কাছে তার রোগমুক্তির জন্য দোয়া প্রার্থনা করছি। আমি যখন তাকে দেখতে যাই তখন তিনি ছিলেন নির্বাক। জ্ঞান থাকা অবস্থায় তার স্ত্রীর কাছে তিনি তার শেষ অভিলাষ ব্যক্ত করেছেন যে- স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ৪ নেতার জন্য যেন একইসঙ্গে সমাধিস্থ করার লক্ষ্যে একটি স্থান নির্ধারণ করা হয়। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি নির্মোহভাবে প্রাপ্তি-প্রত্যাশার ঊধের্্ব আমার চিত্তকে প্রতিস্থাপিত করতে পেরেছি। তবুও অনুজপ্রতিম শাজাহান সিরাজের শেষ অভিলাষটিকে তুলে ধরা আমার নৈতিক দায়িত্ব বলে আমি মনে করছি।
লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা